চলে গেলেন কবি ও শিক্ষক কাজী আবিদ হোসেন
মোঃ তারিকুল ইসলাম সেলিম:: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃতি প্রধান শিক্ষক ও কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ্ ‘র উত্তরসূরির একজন “কবি কাজী আবিদ হোসেন মারা গেছেন(.ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। দীর্ঘদিন তিনি বাধর্ক্যজনিত রোগে ভোগছিলেন। গত রাত ১:৩০মিনিটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে মধ্যপাড়া নিজ বাস ভবন “মিলন আলয় “তে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মানুষ গড়ার এই মহান কারিগরের মৃতুতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সর্বত্রই শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
কাজী আবিদ হোসেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আশুগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী নাওঘাট গ্রামে ১৯৪২ সালের ১১ জুলাই সম্রান্ত কাজী বাড়িতে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা কাজী আলতাফ হোসেন ছিলেন ব্রিটিশ পিরিডে সরকারী চাকুরীজীবি। মাতা এবাদুন্নেছা মুনসুফা ছিলেন একজন অতি সাধারণ গৃহিনী। তাঁর মা গ্রামীন জীবনে অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করলেও মূলত তিনি ছিলেন অসাধারণ শিক্ষানুরাগী। মায়ের ইচ্ছেই কৈশোরকালে কাজী আবিদ হোসেনের নাওঘাট সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবনের হাতেখঁড়ি। ১৯৫৭ সালে তালশহর এ এ আই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাশের পর ১৯৬০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে আই এ এবং ১৯৬২ সালে বি এ পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে বি এড করেন। ১৯৬৩ সালে ফিল্ম সেন্সর বোর্ডে ইউ.ডি.সি হিসাবে পেশা জীবন শুরু করলেও কিছুদিন পরে আখাউড়া দেবগ্রাম গর্ভমেন্ট হাই স্কুলে সহকারি শিক্ষক হিসাবে বাস্তব জীবনে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। এখানে শিক্ষকতা কালেই স্থানীয় মায়াবী সিনেমা হলে ‘স্কুল মাস্টার’ ‘মরিচিকা’ সহ তাঁর ৫/৬ টি নাটক মঞ্চস্থ হয়। এরপর বদলী হন সুনামগঞ্জ জুবিলী হাই স্কুলে। ১৯৭১ সালে ওখান থেকে প্রথম দিকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঐতিহ্যবাহী অন্নদা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। অন্নদা হাই স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতার পরে ১৯৯৭ সালে জানুয়ারীতে চাঁদপুর মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহন করেন এবং একই বছর অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের জুন মাসে আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা হাই স্কুলে ফিরে আসেন। এখানর থেকে ১৯৯৯ সালের ৮ই জুলাই অবসর গ্রহণ করেন। ছান্দসিক কবি আব্দুল কাদির পারিবারিক কুটুম সূত্রে চাচা ও কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ নিকটত্মীয় অর্থাৎ ভাই। তাই পারিবারিক কারণে কিছুটা সাহিত্যের জগতে তাঁর প্রভাব ছিল। ছোট বেলা থেকেই কাজী আবিদ হোসেন সাহিত্য চর্চা করতেন। দৈনিক কচি কাঁচার আসরে তাঁর প্রথম লেখা ছাপা হয়।
এরপর দৈনিক আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান ( দৈনিক বাংলা ), মাহেনও পূবালী, মাসিক সুরমা সহ অনেক পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। প্রথম দিকে গল্প দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও পরবর্তীতে মননশীল কবিতা, প্রবন্ধ লিখে যশস্বী হয়েছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “সোনার পাখি” ( ২০০৭ ), ছোট গল্প “চারদিক ” (২০১৫ )। এছাড়া চলচ্চিত্র কাহিনী গোধুলীর প্রেম, আলোচিত প্রবন্ধ Our Education and its aim. অনুবাদ গ্রন্থ্ ম্যাক্সিম গোর্কির রূপকথা, অগ্রন্থিত গল্প, নাটক, কবিতা, প্রবন্ধ, সংখ্যাও কম নয়। ২০০৭ সালে কবি কাজী আবিদ হোসেনের ‘সোনার পাখি’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, প্রবান্ধকার ও নজরুল গবেষক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ্’র হাতে পাওয়ার পর ভূয়ষী প্রসংশা কুড়িয়েছিলেন তিনি। প্রসঙ্গ কথা তিনি বলেন কাজী আবিদ হোসেন ভাবনা-চিন্তা, ধ্যান-ধারণায় ও আত্মসত্তার আবিষ্কারে এবং পরলৌকিক চিন্তা-চেতনায় বাউল সম্রাট লালন ফকির ও অন্যান্য সাধকদেরই উত্তরসূরি। আমার নিজ গ্রামের নাওঘাট-এর বাসিন্দা এই নিভৃতচারি ও প্রচার বিমূখ কবি পাদ-প্রদীপের আলোয় আসার চেষ্টা করেননি। আমি আশা করবো অনুজ-প্রতীম, প্রীতিভাজন কাজী আবিদ হোসেন কাব্য-চর্চ্চা অব্যাহত রাখবেন এবং ছন্দোবদ্ধ কবিতা রচনায় অধিকতর মনোযোগী হবেন। তাঁর কবিতায় ছন্দের নিপুণ চালে সমাজের নানা দিক গুরুত্ব পেয়েছে।
শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও নাট্যকার হিসাবে তিনি অনেক পুরষ্কার ও পদক পেয়েছেন। ১৯৮২ সালে ন্যাশনাল এডমিনিস্ট্রেশন এক্সটেনশন এন্ড রিসার্চ ( নিয়েরার ) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হতে সার্টিফিকেট অব মেরিট কতৃক Essay Competition এ দু’ দুই বার কৃতিত্ব অর্জন করেন।
আমি মানুষ গড়ার এই মহান কারিগরের বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি….আমিন
লেখক- লোক-সাহিত্যনুরাগী রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠক