Main Menu

শবে বরাতের আছে, শবে বরাত নেই!

+100%-

sab barat.pngঅতি সম্প্রতি ইলমী অঙ্গনে শবে বরাতের ব্যাপারে একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে যে, শবে বরাতের ফজিলত প্রমাণের জন্য কোরআনের কোনো আয়াত অথবা কোনো সহিহ হাদিস আছে কি না। আমাদের দেশের এক শ্রেণীর ওলামায়ে কেরাম মিডিয়ার মাধ্যমে বলছেন, শবে বরাতের ফজিলত প্রমাণের জন্য কোরআনের একটি আয়াত ও একটি সহিহ হাদিসও নেই। কোরআন হাদিসে যেটি আছে সেটি শবে কদরের বেলায় প্রযোজ্য; শবে বরাতে বেলায় নয়। সাধারণ মানুষ মিডিয়ার এসব আলোচনা শুনে বিবৃতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যান। এতবছর যাবত পালন করে আসা বিধানটিকে সরাসরি অস্বীকারই করে দেয়া হচ্ছে! মানতে একটু কষ্ট হয়। হাতের নাগালে ওলামায়ে কেরামকে পেলে একটু যাচাই করে নেয়ার চেষ্টা করেন। তাই বিভ্রান্তির অবসান হওয়া দরকার।

পবিত্র কোরআনের সুরা-দুখানের দুই থেকে চার নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি একে বরকতপূর্ণ রাত্রিতে অবর্তীণ করেছি। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।’ এখানে ‘বরকতপূর্ণ রাত’ বলতে যদিও অনেকের কাছে শবেকদরকে বুঝানো হয়েছে; তবে হজরত ইকরিমা (রা.)সহ বেশ কয়েকজন সাহাবি তাফসিরবিদ বলেন, ‘বরকতপূর্ণ রাত’ বলে শবেবরাত অর্থাৎ শাবান মাসের পনের তারিখের রাত্রিকেই বুঝানো হয়েছে। সুতরাং যদি বলা হয় যে, ‘শবে বরাতের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে কিছুই পাওয়া যায়নি’ তাহলে যেসব সাহাবি ‘বরকতপূর্ণ রাত’ বলতে শবেবরাতকে বুঝিয়েছেন তাদের কথা কি একেবারে ফেলে দেয়া হয় না? একদল সাহাবির মতকে গ্রহণ করতে গিয়ে অপর একদল সাহাবির মতকে একেবারে ফেলে দেয়া সাহাবিদের সঙ্গে বেয়াদবির শামিল। একদল তাফসির বিশেষজ্ঞ সাহাবায়ে কেরামের কথাকে এভাবে ফেলে দেয়ার কি কোনো যুক্তি আছে? যারা শবেবরাত নিয়ে তুলনামূলক অধ্যয়ন করেছেন তাদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট যে, শবেবরাতের ব্যাপারে একদু’টি নয়; বরং একাধিক সহিহ হাদিস রয়েছে। যেগুলো সর্বসম্মতিক্রমে ‘সহিহ’ ও নির্ভরযোগ্য। তাছাড়া ‘হাসান’ ও ‘দয়িফ’ পর্যায়ের হাদিসের তো অভাব নেই। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, ‘হাসান’ হাদিসও সহিহ ও নির্ভরযোগ্য। কারণ তা সহিহ হাদিসেরই প্রকার। আর ‘দয়িফ’ বা দুর্বল হাদিস একাধিক সূত্রে বর্ণিত হলে বা একই বিষয়ে একাধিক দুর্বল হাদিস পাওয়া গেলে তাতে এমন শক্তি অর্জন হয় যে, তা ‘সহিহ’ হাদিসের স্তরে উন্নীত হয়ে যায়। তাছাড়া দুর্বল হাদিসটি যদি অত্যধিক দুর্বল না হয় এবং দুর্বল হাদিসটির বিরোধী কোনো ‘সহিহ’ হাদিস না পাওয়া যায়, তাহলে তা ফজিলত প্রমাণের ক্ষেত্রে, ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে ও রিকাক বা চিত্তবিগলনের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। এমনকি বিধি-বিধানের ক্ষেত্রেও দয়ীফ হাদিসের সমর্থনে শরিয়তের অন্য কোনো দলিল থাকলে অথবা সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের কোনো আমল বা ফতয়া থাকলে কিংবা সাহাবি-তাবেয়ীর যুগ থেকে সেই হাদিসের ওপর আমল অব্যাহত থাকলে সেই দয়ীফ হাদিস শুধু গ্রহণযোগ্যই নয়; বরং অনেক ক্ষেত্রে তা মুতাওয়াতির বা অনেক সূত্রে বর্ণিত হাদিসের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এটি সব ওলামায়ে উম্মতের সর্বস্বীকৃত সিদ্ধান্ত। (আল আজবিবাতুল ফাযিলা, আল্লামা ইবনে কায়্যিম রহ. কৃত কিতাবুর রূহ, পৃষ্টা ১৬, ইমাম যারকাশী রহ. কৃত আন নুকাত, ১/৩৯০, হাফেজ শামসুদ্দীন সাখাবী রহ. কৃত ফাতহুল মুগীছ, ১/৩৩৩)

সুতরাং কোনো হাদিসকে ‘দয়িফ’ বা দুর্বল আখ্যা দিয়ে ফেলে দেয়ার অবকাশ নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, শবেবরাতের ফজিলত প্রমাণের জন্য গাদায় গাদায় হাদিসের প্রয়োজন নেই। শুধু একটি সহিহ হাদিসই শবে বরাতের ফজিলত ও মাহাত্ম প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। অথচ শবেবরাতের ফজিলত প্রমাণের জন্য একটি নয়; একাধিক ‘সহিহ’ হাদিস রয়েছে। আমাদের দেশে যে সম্প্রদায়টি শবেবরাতের ফজিলত অস্বীকার করেন, তাদেরই মান্যবর গবেষক আলেম আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) তার লিখিত “সিলসিলাতুল আহাদিসিস্ সহিহা” গ্রন্থে এ ব্যাপারে সর্বমোট আটটি হাদিস উল্লেখ করেন। প্রতিটি হাদিসের সাথে তিনি হাদিসের মান নিয়েও আলোচনা করেন। (যদিও লেখকের দাবি, এ বিষয়ে তিনি একটিমাত্র হাদিস উল্লেখ করেছেন) সর্বশেষ তিনি হজরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করে সামগ্রিকভাবে সব হাদিসের ওপর মন্তব্য করেন-“শবেবরাত সম্পর্কীয় হাদিসের ব্যাপারে সার কথা হলো, শবেবরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো সামষ্টিকভাবে নিঃসন্দেহে সহিহ। হাদিস অত্যধিক দুর্বল না হলে আরও কম সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত হাদিসও সহিহ বলে বিবেচিত হয়। হজরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত এই হাদিসের মানও তাই। অতএব ‘ইযাহুল মাসাজিদ’ গ্রন্থ প্রণেতা আল্লামা কাসেমী সাহেব কতিপয় হাদিসবিশারদদের উদ্ধৃতিতে যা লিখেছেন যে, ‘শবেবরাতের ফজিলতপূর্ণ কোনো সহিহ হাদিস নেই’ তার এই কথার ওপর আস্থা রাখা উচিত হবে না। তবে কেউ যদি এমনটা বলেই ফেলেন তাহলে বুঝতে হবে অতি চঞ্চলতা হেতু এবং হাদিসের বিভিন্ন সূত্র অন্বেষণে যথাযথ প্রচেষ্টা সীমিত হওয়ার কারণেই এমনটা ঘটেছে। আসলে আল্লাহ তায়ালা তাওফিক দাতা।” (সিলসিলাতুস সহিহা ৩/১৩৮-১৩৯)

তাছাড়া শবেবরাতের ফজিলতের ব্যাপারে হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল কৃর্তৃক বর্ণিত হাদিসটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সকল ওলামায়ে কেরামের সম্মতিতে তা সহিহ বলে স্বীকৃত।

হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে (শাবানের ১৪ তারিখ বিদাগত রাতে) সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক বিদ্বেষী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান ১২/৪৮১, হাদিস নং ৫৬৬৫) উল্লেখিত হাদিসটি আরও পাওয়া যায়, ইমাম তাবরানী , কাবীর (২০১০৯ হাদিস নং ২১৫), আওসাত (৭/৬৮ হাদিস নং ৬৭৭৬, বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান (৫/২৭২ হাদিস নং ৬৬২৮) ইত্যাদি হাদিস গ্রন্থে।

হাদিসটি সহিহ বলেই আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান হাদিসটিকে সহিহ কিতাবে নিয়ে এসেছেন। এবং তিনি হাদিসটি উল্লেখ করার পর মন্তব্য করেন, ‘হাদিসটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বর্ণিত অন্যান্য হাদিসের সমর্থনে ‘সহিহ’ বলে বিবেচিত।’ অনেকে বলেছেন, হাদিসটি ‘হাসান’। হাসান হলেও হাদিসটি সহিহ। কারণ ‘হাসান’ হাদিস ‘সহিহ’ তথা নির্ভরযোগ্য হাদিসেরই একটি প্রকার। যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) কর্তৃক বর্ণিত এই হাদিসটিকে আরও ‘সহিহ’ বলেছেন আরব বিশ্বের বিশিষ্ট গবেষক ইমাম হাফেজ নূরুদ্দীন হায়সামী (রহ.) তার নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ “মাজমাউয যাওয়ায়েদ” এ। তিনি তার গ্রন্থে এই হাদিস উল্লেখ করার পর মন্তব্য করেন, ‘ইমাম তাবরানী স্বীয় হাদিস গ্রন্থ ‘কাবীর’ ও ‘আওসাত’ এ হাদিসটি সংকলন করেছেন। উভয় গ্রন্থে হাদিসের বর্ণনাকারী ‘সিকাহ’ বা নির্ভরযোগ্য। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫)

আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) মুয়াজ ইবনে জাবালের হাদিস উল্লেখ করার পর বলেন, ‘হাদিসটি সহিহ, সাহাবায়ে কেরামের বিশাল অংশ বিভিন্ন সনদে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, যা একটি অপরটিকে সুদৃঢ় করে।’ (সিলসিলাতুল আহাদিসিস্ সহিহা৩/১৩৫)

এ বিষয়ে শুধু একটি দুটি নয়; বরং এক ডজনেরও বেশি হাদিস বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থে পাওয়া। যার কিছু ‘সহিহ’, কিছু ‘হাসান’ ও কিছু ‘দয়িফ’ বা দুর্বল।

সুতরাং ‘আর হাদিসের কিতাবগুলোতেও তেমন শক্তিশালী তথা সহিহ কোনো বর্ণনা নেই’ এ কথা বলে বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। বরং এ বিষয়ে বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম থেকে হাদিস বর্ণিত আছে। এখানে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো। হজরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.), হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.), হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.), হজরত আয়েশা (রা.), হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) হজরত আবু সা’লাবা (রাঃ), হজরত আবু হুরায়রা (রা.), হজরত আউফ ইবনে মালেক (রা.), হজরত কাছীর ইবনে র্মুরাহ (রা.), হজরত উসমান ইবনে আবীল আস (রা.) ও হজরত আলী ইবনে আবী তালিব (রা.) প্রমুখ। এ ছাড়া দেশ ও বিদেশের বহু খ্যাতিমান আলেম শবেবরাতের হাদিসগুলোকে সহিহ ও গ্রহণযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি শবেবরাতের মর্যাদা অস্বীকার করার ব্যাপারে যাদের অবস্থান খুবই শক্ত, সে সম্প্রদায়ের মান্যবর ওলামায়ে কেরামও শবেবরাতের হাদিসকে সহিহ ও গ্রহণযোগ্য বলতে বাধ্য হয়েছেন।

মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব
শিক্ষক, জামিয়া রহমানিয়া সওতুল হেরা, টঙ্গী, গাজীপুর।






Shares