তালশহর রেলস্টেশন বন্ধ ? নেই কোন ট্রেন স্টপিজ !
মোঃ তারিকুল ইসলাম সেলিম।। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তালশহর রেলওয়ে স্টেশনে এখন বন্ধ রয়েছে সব ধরনের ট্রেনের (স্টপিজ) যাত্রা বিরতি। এতে এজনপদের প্রায় ৭৫-৮০ হাজার মানুষ মারাত্মক যোগাযোগ সংকটে পড়েছে। যাতায়াতের সীমাহীন কষ্টে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে জনজীবনে। জনসাধারনের যাতায়াত অসুবিধা ছাড়াও স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়েছে। শত শত শিক্ষার্থীদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত বিঘ্নিত হচ্ছে। এখানে একটি মাত্র ট্রেনের যাত্রা বিরতি ছিল। আরো দুই তিনটি ট্রেনের যাত্রা বিরতির জন্য বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে যখন দাবি জোরদার হচ্ছে। ঠিক ঐ মুহুর্তে একটি ট্রেনেরও যাত্রা বিরতি বাতিল করেছে রেলবিভাগ। কিছুদিন আগে তিতাস কমিউটার ও চট্রলা এক্সপ্রেস সহ একটি আন্তঃনগর ট্রেন থামানোর জন্য সামাজিক সংগঠনগুলো মানববন্ধন করেছে। পত্র-পত্রিকাতেও লেখালেখি হয়েছে। দেশে প্রাণঘাতী করোনার প্রার্দুভাবে সে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। তালশহর রেলস্টেশন নিয়ে জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিকদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। এনিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। স্টেশন থাকার পরও যাত্রীসেবা থেকে বঞ্চিত এজনপদের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য স্টেশনটি এখন বিষফোঁড়া হয়ে দাড়িঁয়েছ।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়; ঔপনিবেশিককালে ভারতবর্ষের পূর্ববাংলায় ১৮৮৫ সালে রেলওয়ে বা রেলগাড়ির আগমণ ঘটে। তারপরই পূূর্ববাংলায় দ্রুত রেলওয়ে বিস্তার লাভ করে। রেলওয়ে আগমণের ফলে গ্রাম শহরে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। নতুন ব্যবসা কেন্দ্র, বাজার সৃষ্টি হয়। ১৮৯২ সালের ১৮ই মার্চ ইংল্যান্ডে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে (এবিআর) কোম্পানির রেজিষ্ট্রেশন হয়। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর স্থাপিত হয় চট্রগ্রামে। এই কোম্পানিই পূূর্ববাংলার পূর্বাঞ্চলীয় রুট ও আসামে রেলওয়ে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯১০ সালে ১ এপ্রিল আখাউড়া- মেঘনা নদীর তীরে আশুগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করে। কিন্তু মাঝ খানে মেঘনা নদী থাকায় অপর পাড় ভৈরব বাজারের সাথে ওয়াগন ফেরির মধ্যেমে যোগাযোগ হত। ১৯১৫ সালের ১ এপ্রিল আশুগঞ্জ থেকে ওয়াগন ফেরির উদ্বোধন করা হয়। তখন থেকেই মেঘনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের আলোচনা শুরু হয়। আশুগঞ্জ ও ভৈরব বাজারের মধ্যে দিনে মাত্র দু’বার ফেরি চলাচল করে যা দ্রুত পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বাঁধাস্বরুপ। এছাড়া আশুগঞ্জ থেকে ভৈরব বাজারের মধ্যে ওয়াগন ফেরির মাধ্যমে ইবিআর ও এবিআর এর মধ্য যোগাযোগ ছিল সময় সাপেক্ষ ও ব্যয় বহুল। এ সমস্যা নিরসনে ও বাণিজ্যিক দিক দিয়ে রেলওয়ে, ব্যবসায়ী এবং জনগণ সকলের লাভবানের কথা চিন্তা করে ১৯৩৭ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জ সেতু নির্মান করা হয়।
১৯১৪ সালে তালশহর রেলওয়ে স্টেশন চালু হয়েছিল। ঐদিনই আখাউড়া-তালশহর- আশুগঞ্জ সেকশনে ট্রেন চলাচল শুরু করে। এ সেকশনে তালশহর আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানীর খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রেলস্টেশন ছিল। সর্বাদিক গুরুত্বের বিবেচনায় কোম্পানীটি পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী প্রথমে ৮টি লাইন বসানো হয়। পরবর্তীতে স্টেশনটিকে আরো সম্প্রসারিত করার ব্যবস্থা রাখা হয়। রেলওয়ে জোন পূর্বাঞ্চলীয় জংশনগুলোর পর তালশহর রেলওয়ে স্টেশনটি ছিল সবচেয়ে ব্যস্ত। যৌবনের জৌলুস হারালেও স্টেশটির চিত্র দেখলে এখনো বুঝা যায়। তালশহর স্টেশন ক্যাটাগরিতে বি গ্রেড অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণীর একটি রেলস্টেশন। পাশবর্তী আশুগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের সকল কার্যক্রম তালশহর ও ভৈবর বাজার স্টেশন থেকে কন্ট্রোল করা হয়। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনটিতে ট্রেন না থামার কথা নয়; তবে কি অঘোষিত বন্ধ রয়েছে তালশহর রেলস্টেশন! তা-না হলে যাত্রী পরিবহনে সকল ধরনের ট্রেনের যাত্রা বিরতি বন্ধ কেন ? এমন প্রশ্নই এখন জনমনে উঁকি দিয়েছে। যদিও রেলওয়ে কতৃপক্ষ তেমন কোন ঘোষনা দেয়নি। আশুগঞ্জ স্টেশনের মতো ভাতশালা স্টেশনের কার্যক্রমও আখাউড়া-পাঘাচং স্টেশন থেকে কন্ট্রোল করা হয়। ভাতশালা স্টেশনটি দেখলে বুঝার কোন উপায় নেই; এটি একটি রেলস্টেশন। এক রুমের ছোট একটি পাকা ঘর ছাড়া এখানে কোন কর্মকর্তা, কর্মচারি, টিকেট কাউন্টার পর্যন্ত নেই। ট্রেনের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষা কিংবা উঠা-নামাও তেমন চোখে পড়ে না; অথচ ভাতশালা স্টেশনে কর্ণফুলি এক্সপ্রেস ও তিতাস কমিউটার সহ বেশকয়টি ট্রেনের যাত্রা বিরতি আছে।
ঢাকা -চট্রগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-নোয়াখালী ও চট্রগ্রাম-ময়মনসিংহ রুটে তালশহর রেলওয়ে স্টেশন দিয়ে চলাচলকারী ট্রেনেগুলোর মধ্যে সূবর্ণ এক্সপ্রেস, মহানগর প্রভাতী\গোধুলী এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস, উপকূল এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস, তূর্ণা এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেস, বিজয় এক্সপ্রেস, সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, ময়মনসিংহ এক্সপ্রেস, কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, সুরমা মেইল, ঢাকা\চট্টগ্রাম মেইল, ঢাকা\নোয়াখালী এক্সপ্রেস, কুমিল্লা কমিউটার, তিতাস এক্সপ্রেস, চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেন প্রতিদিন নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলাচল করছে। এখানে আগে যাত্রী পরিবহনে ৮ জোড়া লোকাল ও মেইল ট্রেনে যাত্রা বিরতি ছিল। সব সময় ৩-৪টি মালবাহী ট্রেন পার্কিংয়ে থাকত। নিয়মিত সাল্টিং করত এক থেকে দুটো ট্রেন। এখানে যাত্রা বিরতি থাকা ট্রেনগুলোর মধ্যে এসএসকার এক্সপ্রেস, চাঁদপুর ও বাল্লা লোকাল সহ ৩ জোড়া ট্রেন একযুগ পূর্বেই রেলওয়ে কতৃপক্ষ বন্ধ করে দিয়েছে।
মুজিববর্ষের সূচনা লগ্নে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ১১০ বছরের পুরানো রেলওয়ে স্টেশনটিতে কোন রকম পূর্বঘোষণা ছাড়াই মালিকানাধীন কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ট্রেনও যাত্রা বিরতি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে শতবছরের অধীক সময় মুখরিত থাকা তালশহর রেলওয়ে স্টেশন এখন যৌবন হারিয়েছে। ফলে অযত্ন ও অবহেলায় অনেক মূলবান জিনিসপত্র নষ্ট হচ্ছে। তালশহর রেলওয়ে স্টেশনে কোন ট্রেন না থামায় কারণে স্টেশন মাস্টাররাও এসে থাকতে চায় না। তারা কিছুদিন কর্মস্থলে যোগ দিয়ে উপরস্থ কর্মকর্তাদের সাথে লবিং করে অন্যস্থ চলে যাচ্ছে।
তালশহর স্টেশনে মেইল ও লোকাল ট্রেনগুলোর যাত্রা বিরতি বাতিল করার কারণে আন্তঃনগর ট্রেনে দুই তিন স্টেশন পরপর ভ্রমণকারী যাত্রীদের প্রচুর চাপ পড়েছে। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে মানসম্মত যাত্রীসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। দূরপাল্লার যাত্রীদের সাথে লোকাল যাত্রীদের প্রায়ই ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষি ঘটনা। চলাচলে অঞ্চল ভিত্তিক সুবিধা না পাওয়া এবং প্রভাব বিস্তারের মনোভাবের কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। এ ব্যাপারে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের সেবা ও নিরাপত্তা রক্ষায় ময়মনসিংহ এক্সপ্রেস, কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, সুরমা মেইল, ঢাকা\চট্টগ্রাম মেইল, ঢাকা\নোয়াখালী এক্সপ্রেস, কুমিল্লা কমিউটার, তিতাস এক্সপ্রেস, চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোর তালশহর স্টেশনে যাত্রা বিরতি দিলে এজনপদে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসবে অমূল পরিবর্তন। এজনপদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটবে। যাতায়াত সুবিধা ভোগ করতে পারবে সাধারণ মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাবনার বাংলাদেশে দীর্ঘ দিনের বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে নতুন ছন্দে ফিরবে তালশহর রেলওয়ে স্টেশন। অন্যদিকে রেলওয়ে যাত্রী সেবার মান ও নিরাপত্তা অনেকাংশে উন্নতি হবে।