Main Menu

একুশের চেতনার সাহস, প্রতিরোধ গর্জন … আল আমীন শাহীন

+100%-

জীবন পথে গোধূলী লগ্নে দাঁড়িয়ে রফিকুল ইসলামের অনেক কিছুই অস্পস্ট। মোটা কাঁচের চশমা, হাতের লাঠি এখন সহায়তা করে চলতে। চোখে ঝাপসা হয়েছে দিন দিন, অনেক কিছু অস্পস্ট দেখেন। দূরের কিছু দেখতে কষ্ট হয়, বয়সে চোখের জ্যোতি কমলেও মনের স্মৃতি অমলিন। পুরনো স্মৃতিগুলো মনের ভেতরের পর্দায় স্পস্ট দেখেন তিনি। বছর ঘুরে এমনই ফাল্গুন মাস এলে তিনি ঘুরে বেড়ান শহীদ মিনারে, খোলা মাঠে কৃষ্ণচূড়ার গাছের ছায়ায়। একাকীই চোখের সামনে উল্টে যান স্মৃতিপটের বীরত্ব গাঁথার গৌরবের নানা অধ্যায়। ভাষার আন্দোলন,মুক্তির সংগ্রাম, সেই মিছিল, লাঠি চার্জ, চোখের সামনে রক্তাক্ত লাশ সেই কান্না মাতম আর লাল সবুজ পতাকা দেখে কান্না ভুলে বিজয়ের হাসি। স্মৃতি হাতড়ে মনে তুলে আনেন বছরে বছরে খালি পায়ে প্রভাতফেরী, মহান একুশের অমর গান, পুষ্পাঞ্জলি।
মসজিদে ফজর নামাজ আদায় করে, সরকারী কলেজের সামনের মাঠে খালি পায়ে হেঁটে কয়েক চক্কর দিয়ে এক সময় বিশ্রাম নেন শহীদ মিনারের সিঁিড়তে বসে। তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ শহীদ মিনারের দিকে। পুরনো বন্ধুদের কথা মনে পড়ে যায়। বন্ধু বন্ধনের নানা স্মৃতি কত গল্প , নানা স্মৃতি কথন। সাথের বন্ধ’রা একে একে সবাই অদৃশ্য, চলে গেছে না ফেরা দেশে। এখন চারপাশে নতুন মুখ, নতুন মানুষ, তাদের চলা বলা গলা সব মনোযোগ দিয়ে দেখেন।
এইতো সেদিন শহীদ মিনারের একটি সিঁড়িতে বসে ছিলেন রফিকুল ইসলাম। একদল শিশু কিশোর শহীদ মিনারে এসে ভীর করেছে, শিশুদের হাসি হৈলোল্লার আনন্দ মনে দেখছেন রফিকুল ইসলাম। কাছে ডেকে এনে তাদের আদর করারর ইচ্ছে হলো তাঁর, ডাকলেন, একটি শিশুকে। ডাকের উত্তরে শিশুটি কাছে আসলো , এসেই বল্লো, “হামকো” , পরে বল্লো “কিয়া হ্যায়”? পাশের আরেক শিশু বল্ল “চলো চলো ঘরমে, ও আদমি পিটেগা”, ভাগ- ভাগ ” বলে সে ছেলেটি চলে গেল। অবাক হলো রফিকুল ইসলাম এই কচি কচি শিশুগুলোর মুখের দিকে। তাদের মুখে অনেক ভিনদেশী হিন্দী শব্দ। কাছে আসা শিশুটিকে বল্লেন,“ এই এসব তোমাকে কে শিখিয়েছে ”? শিশুটি বল্ল “কার্টুন আর টিভি থেকে শিখেছি”। বিরক্ত হলেন রফিকুল ইসলাম , ঘরে ঘরে হিন্দী ভাষার কার্টুন, আর সিরিয়েল দেখে শুধু এই শিশুরাই নয় গৃহিনীরাও হিন্দী বলতে মজা পায়। অনেক পিতা মাতা তাদের সন্তানরা ভাল হিন্দী বলে বলে উচ্ছা¦স ও প্রকাশ করে। একে অপরে দেখা হলে অনেকে,একজন আরেকজনকে গর্ব করে বলেন, “জানেন ভাবী, আমার ছেলে মেলেগুলো ভাল হিন্দী বলে, বাংলা বলতেই চায় না।” ভাল ভিনদেশী ভাষার প্রতি শিশু এবং অনেক অভিভাবকের এমন আগ্রহ আর অন্যভাষার আগ্রাসনের কথা ভেবে, দীর্ঘশ্বাস ফেল্লেন রফিকুল ইসলাম। শিশুটিকে চলে গেল।
হঠাৎ কারো ডাকে ভাবনা ভাঙ্গলো। ১৭/১৮ বছরের এক তরুণ পাশে দাঁড়িয়ে বলছে, আঙ্কেল একটু সরে বসবেন,আমরা একটা পিক নেব সেলফি। ছেলেটির সাথে দুটি মেয়ে কাছাকাছি বয়সী। রফিক সাহেব তাদের দিকে তাকালেন, ছেলেটির সুন্দর মুখ কিন্তু চুল আর পোষাকে খুশী হলেন না তিনি,আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। ছেলেটি আবার বল্ল, আমরা মোবাইলে কয়েকটা পিক তুলে চলে যাব,মেয়েগুলো বলছে, ওয়াও কি নাইস সিনারী।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন রফিক সাহেব। হেঁেট কিছু দূর গিয়ে কলেজ মাঠে বসে পড়লেন। সেখান থেকে দেখছেন ছেলেমেয়েগুলো কি করছে। তারা একসময় জুতো পড়ে শহীদ মিনারে উঠে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলছে। মুখে অনর্গল ইংরেজী ভাষা এবং কিছু বিকৃত শব্দ। স্মাইল স্মাইল, নাইস- এ্যাগেইন , ওয়াও, জোস- জোস, প্লিজ সেন্ড,শেয়ার মি, শেয়ার ইট এইসব শব্দ ভেসে আসছে শহীদ মিনার পাদদেশ থেকে। ক্ষোভে জ্বলছে রফিক সাহেব, সারা শরীরে রাগের কাঁপুনী। কম্পিত হাতে সাথে থাকা লাঠিটা বারবার শক্ত করে ধরছেন। তাকালেন আকাশের দিকে, আর মনের মাঝে তখন তিনি দেখছেন, এই ছেলেটির বয়সী যখন ছিলেন তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা কি করতেন? কি করেছেন। একই বয়সে এই ছেলে মেয়ে গুলো কি করছে। উনার মনে তখন মিছিল সেই শ্লোগান “ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,মাতৃভাষা বাংলা চাই , বাংলা আমার মায়ের ভাষা, মোদের গৌরব , মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা”। অমর গানটিও মনে বাজছে, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।
এই ভাবনার মাঝেই ঘটে গেল একটি ঘটনা। হঠাৎ সরগোল দুটি মোটর সাইকেল নিয়ে আসা বেশ কয়েক তরুণ এসে পূর্বের সেই ছেলেটিকে পিটাচ্ছে, একটি গুলিরও শব্দ হলো, ছেলেটির সাথে থাকা দুটি মেয়ে পালিয়ে গেছে। ছেলেটি একসময় আহত হয়ে ছুটে আসছেন রফিক সাহেবের দিকে। এসেই উনার কাছে আশ্রয় চাইলো , চাচা- চাচা ,বাাঁচান বাঁচান , ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আঘাতে ছেলেটি মাগো মাগো বলে কাতরাচ্ছে। বসা থেকে লাঠি ভর করে উঠে দাঁড়ালেন রফিক সাহেব। লাঠিটা হাতে নিয়ে ছেলেটির পিঠে দিলেন দুএক ঘা। পরে লাঠিটা উঁচু করে শক্ত হাতে ধরে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে। থাম থাম । আর এগুবে না। জোর ধমক, আর এগুবে না। রফিক সাহেবের জোর ধমকে ছেলেগুলো দাঁড়াল। পড়ন্ত বয়সে রফিক সাহেবের কণ্ঠ তখন প্রকম্পিত। তিনি চিৎকার করে বলছেন , নতুন প্রজন্ম , মুরব্বীদের সামনে মারামারি বেহায়াপনা বেয়াদপী , রক্ত আর প্রাণ নিয়ে খেলা। আর না আর এগুবে না। তোমাদের মতো বয়স আমারও ছিল , তারুণ্য আর যুব শক্তি আমরা এভাবে নষ্ট করিনি, আমাদের বন্ধু বান্ধব ছিল, একে অপরে লড়াই করিনি, নিজেদের রক্ত নিয়ে খেলা করিনি। আমরা দেশের জন্য ভাষার জন্য শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছি, প্রাণ রক্ত দিয়েছি। শহীদ মিনারে এসে মারমারি, শহীদ মিনারকে অবমাননা, আমাদের ত্যাগের প্রতি অশ্রদ্ধা মেনে নেব না।
লাঠি উঁচিয়ে তিনি এগুচ্ছেন সামনের দিকে , দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো উনার অগ্রসরতায় আর এগিয়ে আসতে পারলো না। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে থমকে আছে তারা । অন্যদিকে রফিক সাহেবের বজ্র কণ্ঠ। “আমরা বায়ান্নতে প্রতিরোধ করেছি, একাত্তরে লড়াই করেছি। আমাদের মনে গৌরবের সাহস। সামনে আসলে একজনও রক্ষা পাবে না।” বুকের সিনা উচু করে রফিক সাহেব বলেই যাচ্ছেন , আমরা সুন্দর সুখী ভবিষতের স্বপ্ন দেখে নিজেদের জীবন বাজি রেখেছি। আর স্বাধীন দেশে প্রিয় ভাষা নিয়ে তোমাদের অপকর্ম আর মেনে নেয়া যায় না। আর মানবোও না। যুদ্ধের সময় আমাদের কাছে তেমন অস্ত্র ছিল না, ছিল বুক ভরা সাহস, আর আগামীর সুন্দর স্বপ্ন। লাঠি নিয়েই আমরা এগিয়েছি চেতনার সাহসে। সেই স্বপ্ন সাহসের কাছে পরাজিত হয়েছে হানাদাররা। এখনও বায়ান্নের চেতনা, উনসত্তরের বুকের গর্জন, আর একাত্তরের সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেতনা রয়েছে বুকে। অসুন্দরের আগ্রাসন রুখতে বেশী কিছু নয়, আমার হাতের এই লাঠিই যথেস্ট। সামনে আসলে এই লাঠি দিয়ে পিটিয়ে চামড়া তুলে দেবো। পিছু হটছে আক্রমণকারী ছেলেরা। একসময় দেখা গেল বৃদ্ধ বয়সী কয়েকজন এসে দাঁড়িয়েছে রফিক সাহেবের পাশে। রফিক সাহেব চিৎকার করছেন তখনো। আর চুপ নয় , এখন থেকে আবারো প্রতিরোধ, অসুন্দরের বিরুদ্ধে, অসুন্দর বিনাশে, নতুন স্বপ্নে, ফেলে আসা দিনের চেতনার সাহসে।রফিক সাহেব এগিয়েই আসছেন, পিছু হটছে দাঙ্গাবাজ ছেলেগুলো। রফিক সাহেবের কণ্ঠের তেজ ভিন্ন রকম, তিনি বলছেন, অনেক ত্যাগ, অনেক প্রাণ -রক্তে এই বাংলাদেশ, এই ত্যাগকে স্মরণ রাখার জন্যই শহীদ মিনার, শহীদ স্মৃতি সৌধ, এইসব স্থানকে অবমাননা কোনভাবেই মানবো না। রফিক সাহেবের পেছনে এবার দাড়িয়েছে একদল তরুণ। আমরাও আছি আপনার সাথে।
রফিক সাহেবের দু পা শরীরে অন্যরকম দোলা, জোর পায়ে তিনি এগুচ্ছেন। বলছেন, চুপ থাকি বলে সীমা অতিক্রম, কোনভাবেই আর মানবো না। রক্তে গড়া বাংলা শব্দের বিকৃতি, শহীদ মিনারে মারামারি অসম্মান, যেই করবে তাকে ছাড়বো না। দেখতে দেখতে অনেকেই এখন রফিক সাহেবের পেছনে। একসময় আক্রমণকারীরা ভয়ার্ত হয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে চলে গেল। রফিক সাহেব গিয়ে বসলেন শহীদ মিনারে আগের জায়গায়। শহীদ মিনারের দিকে তাকালেন, উনার চোখে মুখে শরীরে প্রতিরোধের সাহস, যুদ্ধের দাবানল , চেতনার আগুন।
একসময় প্রথমে মারখাওয়া ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়ালো মাথা নীচু করে, “মাফ করে দিন চাচা আমিও ভুল করেছি। ” রফিক সাহেব ছেলেটির দিকে তাকালেনও না, বল্লেন, যাও সামনে থেকে। ভুল শুধু ভুল, আমাদের স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ করে শুধু ভুলই করবে, আর আমরা চুপ হয়ে থাকবো। আমরা এখনও মরিনি। যতদিন বাঁচবো ততদিনই আমাদের ত্যাগের আসনে আমরা বসা থাকবো,প্রতিদিন আসবো শহীদ মিনারে, যাব স্মৃতিসৌধে, অতন্দ্র প্রহরী হয়ে পাহাড়া দিব আমাদের স্বপ্ন ত্যাগের স্মারককে। নতুন ভাবে নতুন প্রজন্ম গড়ার স্বপ্ন জয়ে আবারো যুদ্ধ করবো। রফিক সাহবেরে সঙ্গে জড়ো হয়েছে যারা তারাও সমস্বরে বলে উঠলেন, “আমরাও আছি আপনার সাথে”।
————————
লেখক : সম্পাদক নতুনমাত্রা, সহ সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া টেলিভিশন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব






Shares