স্মরণ: এটিএম ওয়ালী আশরাফের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী
“শুনেছি সেদিন তুমি, এঁকেছিলে জন্মভূমি, তুমিই স্বপ্নের নায়ক! তুমিই নেতা! তুমিই পিতা! ধন্য তোমার জীবন”
—অ্যাড. মীর হালিম, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
হ্যালো, আশরাফ ভাই! “শুনেছি সেদিন তুমি, এঁকেছিলে জন্মভূমি”! তুমিই স্বপ্নের নায়ক! তুমিই নেতা, তুমিই পিতা! ধন্য তোমার জীবন।
আজ ১৯ নভেম্বর। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ (বাঞ্ছারামপুর)-এর সাবেক সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বপ্নদ্রষ্টা মরহুম এটিএম ওয়ালী আশরাফকে। আজ তাঁর ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর ভক্ত, অনুসারী ও স্বজনদের হৃদয় নিবেদন এক পঙক্তিতে “শুনেছি সেদিন তুমি, এঁকেছিলে জন্মভূমি, তুমিই স্বপ্নের নায়ক! তুমিই নেতা! তুমিই পিতা! ধন্য তোমার জীবন।”
তাঁর ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় ছয়ফুল্লাকান্দি ইউনিয়নের মাছিমনগর গ্রামে তাঁর কবরস্থানে এটিএম ওয়ালী আশরাফ স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
১৯৩৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ডোমরাকান্দি গ্রামে চাকুরীজীবী পিতা: আলহাজ্ব মোঃ আতিক উল্লাহ ও গৃহিণী মাতা নূর জাহান বেগমের ঘরে জন্ম নেওয়া এই ক্ষণজন্মা পুরুষ মাত্র ৫৭ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে রেখে গেছেন অনাড়ম্বর ও কর্মময়তার ছাপ। সাধারণ মানুষের আফসোস, “ওয়ালী আশরাফের মত এমন গুণী নেতা আর আসবে না” যা তাঁর কর্মময় সফল জীবনের শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি।
নানাবাড়ি ও মামার কর্মস্থল দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুরে কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। সেখান থেকেই ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর বরিশাল বি.এম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীনই রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি; তিনি তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার জন্য একসময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গ্রেফতারও হন।
শিক্ষাজীবন শেষে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বসেরা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বৃটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি)’তে কাজের সুযোগ পেয়ে লন্ডন পাড়ি জমান আমাদের অজপাড়া গাঁ ডোমরাকান্দির আশরাফ! কর্মজীবনে তিনি এমন একটি কাজ করেন, যা ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয়! ১৯৬৯ সালে তাঁর সম্পাদনায় লন্ডনে প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক জনমত’, যা বিদেশের মাটিতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রথম বাংলা পত্রিকা হিসেবে পরিচিত। এটি তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রসর চিন্তার পরিচয় বহন করে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এই ‘সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকা’র মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন, সংবাদ প্রচার এবং লেখালেখি অব্যাহত রাখেন। তিনি লন্ডনভিত্তিক বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে প্যারিসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমাবেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বলিষ্ঠ বক্তব্য তুলে ধরেন। তাঁর এই অনবদ্য ভূমিকার জন্য পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়। আজ ৩০ বছর পরও বিভিন্ন বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা বিস্মৃত প্রায় ওয়ালী আশরাফকে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কণ্ঠস্বরের স্থপতি হিসেবে সম্মান জানায়!
স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতে বেশি মনোযোগ দেন ওয়ালী আশরাফ। তিনি ধীরে ধীরে মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’তে যোগ দেন। নব্বইয়ের দশকে আপোসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। তিনি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন মা, মাটি ও মানুষের নেতা। বাঞ্ছারামপুর থেকে তিনি পরপর দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন: ১৯৮৮ সালে (চতুর্থ জাতীয় সংসদ): স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোমবাতি প্রতীকে এবং ১৯৯১ সালে (পঞ্চম জাতীয় সংসদ): বিএনপি থেকে ধানের শীষ প্রতীকে। তিনি তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
জননেতা ও স্বপ্নদ্রষ্টা ওয়ালী আশরাফের অমর কীর্তি হলো বাঞ্ছারামপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে তাঁর দূরদর্শী পরিকল্পনা। নব্বইয়ের দশকে তিনি বাঞ্ছারামপুরের মানচিত্রে একটি প্লাস (+) চিহ্ন এঁকে বলেছিলেন-চার দিক দিয়ে এই জনপদ রাজধানী ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর, শিল্প শহর নরসিংদী ও বাণিজ্যিক মহানগরী চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত হবে।
তাঁর সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবতার পথে: ঢাকা-আগরতলা সংযোগ মহাসড়ক হচ্ছে তাঁর আঁকা পথ ধরেই। বর্তমানে কড়ইকান্দি-বিশনন্দি ফেরিঘাটে ৫ম মেঘনা সেতুর বাস্তবায়নের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তার বীজ তিনি সেই দিনেই বপন করে গেছেন। উনার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হচ্ছে এবং তাঁর মৃত্যুর ৩১ বছর পর সারাদিন লঞ্চ জার্নির পরিবর্তে সড়ক পথে দ্রুত ২-৩ ঘন্টায় বাঞ্ছারামপুরে পৌঁছানো এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা।
এছাড়াও, তিনি বাঞ্ছারামপুর সরকারী কলেজকে আর্থিক সংকটের হাত থেকে বাঁচাতে ১৯৭৮ সালে নিজে নগদ ২০,০০০/- টাকা (যা আজকের দিনে বিপুল অঙ্কের সমান) অনুদান দেন, যা আজও কলেজের অনার বোর্ডে স্বর্ণাক্ষরে লেখা। তিনি বাঞ্ছারামপুর প্রেসক্লাব স্থাপনেও উৎসাহ প্রদান করে সাংবাদিকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেন।
নেতা আশরাফ ছিলেন মাটির মানুষ। নির্লোভ, সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত জীবনের এক দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ তিনি। কৃষক-শ্রমিক-জনতার সাথে সহজে মিশে যাওয়া, জমির আইলে বসে খাবার খাওয়া, হোক্কা টানা বা প্রখর স্মৃতিশক্তির জোরে কাউকে একবার দেখার বহু দিন পর নাম ধরে ডাকা—এগুলোই ছিল তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য। শহরে স্যূট বুট পরলেও গ্রামে গেলে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরতেন। জুতা, হাত ঘড়ি আর ছাতা ছিল সঙ্গী। পাইপ যোগে সিগারেট টানার ছবিটা আজো দৃষ্টি নন্দন! চেহারার সাথে পাঞ্জাবি গোঁফটা যেন যেন অসাধারণ নবাবী স্টাইল! ফ্যাশন ও স্টাইলের অপূর্ব সমন্বয়ে সাধারণ পরিবেশ থেকে রাজকীয় আয়োজনে নিজেকে খুব সহজেই মানিয়ে নেওয়া বা নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন আমাদের প্রিয় আশরাফ ভাই।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ সালে রেবেকা সুলতানা রোজিকে (পরবর্তীতে রেবেকা ওয়ালী) বিয়ে করেন। অতিথিপরায়ণ এই দম্পতি ছিলেন সুখী দাম্পত্য জীবনের উত্তম উদাহরণ। ১৯৯০ সালে তাঁরা সস্ত্রীক পবিত্র হজব্রতও পালন করেন। এই দম্পতির তিন সন্তান—রাইকা ওয়ালী খান, মৌলি সামিরা ওয়ালী রহমান ও রুদ্র তৌহিদ ওয়ালী—বর্তমানে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
মাত্র ৫৭ বছর বয়সে, সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১৯ নভেম্বর, ফুসফুসের জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে তিনি চিকিৎসা গ্রহণপূর্বক সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে ছয়ফুল্লাকান্দি ইউনিয়নের মাছিমনগর গ্রামে শাহ রাহাত আলী দরগা মসজিদের পশ্চিম পাশে কবরস্থ করা হয়। পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রীকেও তাঁর পাশেই সমাহিত করা হয়।
দুর্ভাগ্যবশত, দীর্ঘ রাজনৈতিক অবহেলায় তাঁর এই বীরোচিত নেতার কবরটি পদ্ধতিগতভাবে অবহেলার শিকার হয়। স্বৈরাচারী আমলে নামফলক মুছে হয়, পরিবেশ হয়ে ওঠে অপরিচ্ছন্ন। এটিএম ওয়ালী আশরাফের মত একজন মুক্তিযোদ্ধা ও দুইবারের সাবেক এমপির কবরের এমন দশা তাঁর অনুসারীদের ব্যথিত করে।
সম্প্রতি তাঁর স্মৃতি সংসদ ও পরিবারের উদ্যোগে কবরের প্রাথমিক সংস্কার কাজ হলেও, তাঁর নামে বাঞ্ছারামপুরে মহিলা কলেজ, মাদ্রাসা, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, ইয়াতিমখানা, অটিজম বা স্পেশাল স্কুল, প্রেসক্লাব ভবন, পাবলিক লাইব্রেরি, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ইংলিশ ভার্সন স্কুল, সাধারণ স্কুল/কলেজ ও বিভিন্ন পাবলিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার স্বপ্ন আজও অধরা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আক্ষেপের বাণী, “যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না”, এই প্রেক্ষাপটে বাঞ্ছারামপুরের ক্ষেত্রেও কি প্রতিফলিত হতে থাকবে?
আমরা যারা তাঁর আদর্শিক উত্তরাধিকার, আমাদের উচিত বর্ষা কিংবা সুদিন বা পদ-পদবী নির্বিশেষে এই পূর্বপুরুষদের প্রতি দায় স্বীকার করা এবং তাঁর অসমাপ্ত স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে এগিয়ে আসা। এটিএম ওয়ালী আশরাফ স্মৃতি সংসদকে গতিশীল করা এবং তাঁর নামে প্রতিষ্ঠান স্থাপন করাই হতে পারে তাঁর প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এটিএম ওয়ালী আশরাফ অমর হোক। স্মৃতি সংসদ জিন্দাবাদ।
নিবেদনে: অ্যাডভোকেট মীর হালিম
সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ
(সদস্য, এটিএম ওয়ালী আশরাফ স্মৃতি সংসদ, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম)































