কবি সাইদ সারমাদ : এখনো বেঁচে আছেন
বেঁচে থাকার প্রশ্নটা এলো– কারণ সারমাদকে মারার চেষ্টাটাই হয়েছে সবচে’ বেশি। রাজার কালহাত পড়েছে কবির মাথায়। তারপরও কি বেঁচে থাকা যায় ? সারমাদকে মারতে কোন আয়োজন বাদ রেখেছেন আওরঙ্গজেব ? রাজ্যের যোগ্য উত্তরাধিকারী (ইতিহাস তো সেটাই বলে) ভাইকে হত্যা করেছেন তিনি; কেননা, সে সারমাদের ভীষণ ন্যাওটা ছিলো। নেংটা বাবা তো সারমাদ আগেই ছিলেন, এর ওপর এবার কলঙ্ক রটলো যে, সারমাদ আসলে মুসলিম নয়। তাতে কি ! মুসলিম হতে বয়েই গেছে সারমাদের ! কিন্তু সারমাদ যেহেতু কবি, তাই কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি তার অভিব্যক্তি জানালেন অকপটে-
ও রাজা, শোনো, নেংটা আমি বটে, কিন্তু অসাধু নই তোমার মতো
মসজিদেও যেতে পারি চাইলে কিন্তু তোমার মতো মুসলিম হয়ে নয়
উপমহাদেশে এক মহাবিস্ময় ছিলেন সারমাদ। কবিতা লিখেছেন, তবে কবিদের মতো ছিলেন না মোটেই। বিবস্ত্র হয়ে ঘুরে বেড়াতেন, অথচ ধর্মের আলখেল্লা জড়ানো সূফিরা তাকে নমস্কার জানাতে কুণ্ঠিত হতো না। তিনি হিন্দুদের কাছেও গর্বের ধন বলে বিবেচিত হতেন। অথচ তার পরিচয়ের সূত্র খুঁজতে গেলে বেড়িয়ে আসে, তিনি ছিলেন মূলত আর্মেনিয়ান ইহুদি। ১৬৬১ সালে যখন বাদশা আওরঙ্গজেব তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন, তারপর থেকে অন্তত ৩৫০ বছর সারমাদকে এমনভাবে ‘নীলকুঠির চুনের গুদামে’ পুরে রাখা হয় যে, কর্পোরেট লেখকেরা কষ্ট করে তার দেহখানি আর তুলে আনার হিম্মতও পাচ্ছিলেন না। সন্দেহ নেই, আমাদের উপমহাদেশের মুসলিম কিংবা বেদীন সব ঐতিহাসিকেরা কমবেশি আওরঙ্গজেবের ভক্ত আছেন। তারও সঙ্গত কারণ আছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুই অর্থেই আওরঙ্গজেব ভারতবর্ষকে একটা বিত্ত-বৈভবের স্থানে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। সতেরো শতাব্দিতে পুরো দুনিয়ার মোট জিডিপির চার ভাগের এক ভাগ (৩৭০ বিলিয়নের মধ্যে ৯১ বিলিয়ন) আয় ছিলো তখন ভারতের। বাদশাও এই সুযোগটি যথার্থই ব্যবহার করেছেন। নিজের পিতাকে বন্দি রাখা, ভাইদের হত্যা করা এবং সবশেষে সারমাদের মতো মহাপুরুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পাপ তিনি ঢাকতে চেয়েছেন নিজের সব উন্নতির নেমক ছড়িয়ে। তাই আওরঙ্গজেবে মূর্চ্ছিত ঐতিহাসিকেরা যথেচ্ছা গুণগান গেয়ে সারমাদকে সযত্নে ছেঁটে ফেলে দিয়েছেন তাদের ইতিহাস থেকে।
১৯১০ সালে প্রখ্যাত রাজনীতিক মাওলানা আবুল কালাম আজাদের কাছে ফরমায়েশ আসে সারমাদের একটা জীবনী লিখে দেবার, লক্ষ্নৌর তানভির পাবলিশার্স সারমাদের রুবাইয়াতের সঙ্কলন প্রকাশ করবে, সেই বইয়ের ভূমিকা হিসেবে। মাওলানা বড় পরিশ্রম করে সারমাদের যেটুকু তথ্য তখন উদ্ধার করতে পেরেছিলেন, তা এর আগে আর কারো জানা ছিলো না। তবে তানভির পারলিশার্সের পক্ষেও সারমাদের সব রুবাইয়াত সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি। এরপরে আবুল কালাম আজাদের লেখা উর্দু ভাষায় সারমাদের জীবনী সংযুক্ত করে লাহোর, দিল্লি ও মুম্বাইতে কিছু সংখ্যক রুবাইয়াতের লিথোগ্রাফ করা হয়েছে। ড. রিউয়ের মতে, সারমাদের চারশ’র বেশি রুবাইয়াত ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। জানা যায়, সারমাদের কবিতার বড় একটি সংগ্রহ রয়েছে রামপুর স্টেট ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরিতে।
সবচে’ আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই যে আমরা কবিকে সারমাদ বলে ডাকি, সেটাই যে তার নাম, তা-ও নিশ্চিত হওয়া যায় না। সারমাদ নাকি কখনো কারো কাছে তার নাম বলেন নি। লোকেরা তাকে, বিশেষ করে তার ভাবশিষ্য আভাই চাঁদ সম্ভবত তাকে সারমাদ বলে ডাকতো। হতে পারে সেই থেকেই তিনি সারমাদ। কোথাও কোথাও তার নামের শুরুতে ‘সাইদ’ যুক্ত পাওয়া যায়। আবার অনেকে বলেন সারমাদ কাশানি। হতে পারে, যেহেতু ১৬৩১ সালে আর্মেনিয়া থেকে হিন্দুস্তানে বাণিজ্য করতে এসেছিলেন তিনি, তাই তার ভাষা শুরুতে কেউ বুঝতে পারে নি। তখনই পরিচয় হয় আভাই চাঁদের সাথে। এই আভাই চাঁদ সম্পর্কে হেনরি জর্জ কিন লিখেছেন– সিন্ধুর পাড়ে ‘থাথান’ নামে একটি ছোট্ট শহরে একজন ধনবান হিন্দু রাজার পুত্র ছিলো আভাই চাঁদ। ভ্রমণের এক পর্যায়ে সারমাদ এই বালকের প্রেমে পড়েন। নাসরাবাদির মতে, সারমাদের শিষ্যত্ব গ্রহণের পর আভাই চাঁদ পিতা-মাতা, ঘর-বাড়ি, ধন-সম্পদ সব ফেলে ভিখারি সেজেছিলেন। একজন হিন্দু ফকিরের মতো সঙ্গী হয়েছিলেন সারমাদের। সারমাদের মৃত্যুদণ্ডের পরপরই আভাই চাঁদেরও মৃত্যু হয়েছিলো গুরুর শোকে। অথচ আওরঙ্গজেবের দরবারি মোল্লারা এ কারণে সারমাদের প্রতি সমাকামিতার অভিযোগ করতেও ছাড়ে নি। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখেছেন, প্রকৃত পক্ষে আভাই চাঁদের সঙ্গই সারমাদের হৃদয়ে প্রেমের বীজ বুনে দিয়েছিলো। প্রথমে তা মানবপ্রেমের ছলে ভেতরে জন্ম নেয়, পরে সেটা ঐশ্বরিক অবস্থান তৈরি করে। সারমাদ তার ‘ফানা’ কবিতায় এ কথাটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন হয়তো–
প্রেমের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে আমি অধিষ্ঠিত হয়েছি যখন
তখনই মানুষের করুণার কারাগার থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি
আর জ্বলন্ত মোমের মতো গলেছি যখন এই উজ্জ্বল সভায়
তখনই জ্বলে জ্বলে ঐশ্বরিক রহস্যের আলোতে স্নাত হয়েছি
কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, এত বড় বুজুর্গই যখন হবেন তিনি, তাহলে বস্ত্রহীন থাকবেন কেনো ? যদিও এ প্রশ্ন তৎকালে হাজারো বার তাকে শুনতে হয়েছে। তবু যারা তার বিরোধী ছিলো, তারা তাকে শেষমেশ পাগল ঠাউরে নিয়েই খালাস। আর যারা তার ভক্ত, তারা তার থেকে যে আবে হায়াত লাভ করতো, তা গলধ:করণ করতে গিয়েই হিমশিম খেতো; অন্যকিছু জানতে চাইবার সাধ্য তাদের ছিলো না। তারপরও আওরঙ্গজেব ঘোষণা দিয়েছিলেন– আমার রাজ্যে কেউ নগ্ন হতে পারবে না। বোঝাই যায়, এই ঘোষণা কেবল সারমাদকে জব্দ করার উদ্দেশ্যেই ছিলো। নইলে দিল্লিতে তখন সবাই নগ্ন হতে উন্মুখ ছিলো, তেমন তো নয়। অনেকে মনে করেন, বাদশার এ আদেশ অমান্য করার অপরাধেই সারমাদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও গূঢ় কারণ যে আছে, তা সাধারণের কানে না পৌঁছানোরই কথা। যেমন– একবার আওরঙ্গজেব দিল্লীর পথে বেরিয়েছেন, পথের ধারে তখন বসে আছেন সারমাদ। তিনি সেখানে থামলেন এবং নির্দেশ দিলেন সিপাইদের যে, তাকে যেনো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
সারমাদ রুষ্ট হয়ে বললেন, যদি তুমি মনে করো যে আমার নগ্নতাকে ঢেকে রাখা প্রয়োজন, তবে তুমি কেনো তোমার মনকে আমার থেকে ঢেকে রাখো না?
আওরঙ্গজেব তখন নিজেই ঘোড়া থেকে নেমে এসে পাশে পড়ে থাকা সারমাদের কম্বলটি তার গায়ে তুলে দিতে গেলেন এবং তখনই দেখতে পেলেন– কম্বলের নীচে তার পরিবারের সদস্যদের রক্তাক্ত কাটা মাথার স্তূপ, যাদের তিনি হত্যা করেছেন। হতভম্ভ হয়ে তিনি সারমাদের দিকে তাকালেন।
সারমাদ হেসে বললেন– এখন তুমিই বলো, আমি কী ঢাকবো? তোমার পাপ না আমার নগ্নতা?
অবশ্য সারমাদকে নগ্নতার কারণে একবার কাজির দরেবারেও হাজির হতে হয়। মোল্লা কাওয়ি তখন প্রধান কাজি। কাজি জিজ্ঞেস করলেন– তোমার এত জ্ঞান, এত প্রজ্ঞা, তাহলে নগ্ন থাকো কেনো?
সারমাদ উত্তর দিলেন– কী করি, শয়তান আমার ওপর কাওয়ি (পরাক্রান্ত) হয়ে আছে।
তারপর তিনি আবৃত্তি করলেন–
আমার দীর্ঘাঙ্গি প্রিয়, আমাকে রেখেছে হেলায় ফেলে
মদিরায় ছল ছল তার চোখ হুঁশ কেড়ে নিয়েছে আমার
নিজেরই বুকে আগলে রেখে নিজেই তাকে খুঁজে ফিরি
সে এক আশ্চর্য ডাকাত রে ভাই,
রেখে সব অমূল্য ধন, কেড়ে নেয় শুধুই বসন
এরপরও কি বাদশা তাকে হত্যার আদেশ দিতে পারেন ? তাহলে কোন কারণে সারমাদকে মারতে চেয়েছিলেন তিনি ? ইতিহাস বারবারই দারাশিকোর প্রসঙ্গ টেনে এনেছে সারমাদের আলোচনার প্রতিটি অনুষঙ্গে। একটু বাড়াবাড়িই মনে হয়। দারাশিকো শিষ্য ছিলেন সারমাদের, যেমন আরো অজস্র শিষ্য ছিলো তার। দারাশিকো ‘উপনিষদের’ ৫২টি অনুচ্ছেদের ফার্সি তর্জমা করেছেন, সেটা ইউরোপ ছাড়িয়ে বহুদেশে পঠিত হয়েছে, তাতে সারমাদের কী! আসলে অনেকেই ভাবতো, সারমাদ হয়তো হিন্দু হবেন। তবে মুসলিম মানসের প্রতিও তার টান আছে বরাবর। তাই দারাশিকো গুরুর মর্জি বুঝে হিন্দু-মুসলিমে একটি বৃহৎ ঐক্যের সম্ভাবনার সন্ধান করেছিলেন। এবং এইটাই ছিলো দারাশিকোকে হত্যা করার পক্ষে মোল্লাদের কার্যকর ফতোয়া আর আওরঙ্গজেবের মোক্ষম অজুহাত। এসবের সাথে আদতে সারমাদের কোনো যোগসূত্র ছিলো না। তবে একদিন দারাশিকো সারমাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ভবিষ্যতে কোনোদিন সিংহাসন লাভের সম্ভাবনা তার আছে কি-না। সারমাদ বলেছিলেন– আল্লাহ আপনাকে চিরদিনের মতো সার্বভৌমত্ব দান করবেন। এবং আমার এ ভবিষ্যৎবাণী বিফল হবে না। লোকে বলে– এ ভবিষ্যদ্বাণীর পরই আওরঙ্গজেব সারমাদের প্রতি বেশি বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিলেন। এবং দারাশিকোর কারণেই সারমাদ হিন্দুস্তানে বিশাল এক রাজনৈতিক অবস্থান পেয়েছিলেন। এই হিসেবে দারাশিকো ও সারমাদের সম্পর্কটা এমন এক জটিল সমীকরণে এসে দাঁড়ায় যে, আসলে দারাশিকোর কারণে সারমাদ, নাকি সরামাদের কারণে দারাশিকো– এর সুরাহা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
যদিও দারাশিকোর চিঠি থেকে গুরুর প্রতি শিষ্যের উঁচুদরের শ্রদ্ধার নিদর্শন পাওয়া যায়। দারাশিকো লিখেছেন–
আমার পির ও শিক্ষাগুরু,
প্রতিদিন আমি আমার শ্রদ্ধা আপনার উদ্দেশ্যে পাঠাতে চাই। কিন্তু সে ইচ্ছে আমার রয়ে যায় অপূর্ণ। আমি যদি আমি হয়ে থাকি, কেন তাহলে কোনো কিছুতেই আমার কোনো পরিকল্পনা নেই? যদি আমি না হয়ে থাকি আমি, তাহলে কী আমার অপরাধ? যদি ইমাম হোসেনের হত্যাকাণ্ড আল্লার ইচ্ছাতেই ঘটে, তাহলে ইয়াজিদ কে? আর যদি আল্লার ইচ্ছাতে তা না ঘটে থাকে, তাহলে, আল্লাহর যা ইচ্ছে তাই তিনি করেন এবং সে-ই আদেশ তিনি দেন, যা তিনি চান– এর অর্থ কী দাঁড়ায়। দেখা গেছে, শ্রেষ্ঠ নবী অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে প্রায়শই যুদ্ধে গেছেন। যে কোনো ধরনের পরাজয় ইসলামের সৈনিকদের মানসিকতার ওপর আঘাত হানতো। বিশিষ্ট পণ্ডিতগণ বলেছেন, ওটা হলো পশ্চাৎপসারণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য তাহলে কোন শিক্ষাটা জরুরি?
মাত্র দুই লাইনের একটি কবিতার মাধ্যমে সারমাদ দারাশিকোর এ চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন–
প্রিয় রাজপুত্র, যা পড়েছি, সব ভুলেছি আমরা,
মনে আছে শুধু বন্ধুর উপদেশ, বারে বারে তাই তা-ই পাঠ করে যাই।
সারমাদের হত্যার পেছনে আরও একটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়, তা হলো, তার কবিতা। পৃথিবীতে কবিতার জন্যে কারাবন্দি হওয়ার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। কিন্তু ঠিক কবিতার জন্যে শহিদ হতে হয়েছে, আমাদের উপমহাদেশে অন্তত সারমাদের আগে কারো ভাগ্যে এমনটি ঘটেছিলো কিনা জানা নেই। বাদশার দরবারের মোল্লাদের চটাতেই কি না কে জানে, সারমাদ আবৃত্তি করে বসেন অভূতপূর্ব এক কবিতা। সেই কবিতা শুনে দরবারি মোল্লাদের মনে হলো– এটা মুহাম্মদের স. মেরাজ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট উপহাস। অথচ সবাই জানে, সুফিরা আসলে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে ঐক্যে বিশ্বাস করেন এবং এই মতবাদে আপত্তিকর কিছু রয়েছে বলে মনেই করেন না। যাই হোক, কবিতার বক্তব্য কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে নি আওরঙ্গজেবের পারিষদবর্গ। সারমাদ লিখেছিলেন–
সত্যের রহস্য যে জানে
সে বিশাল আকাশের চেয়েও বিশালতর হয়ে যায়
মোল্লারা বলে, মুহাম্মাদ মেরাজে গিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করেছেন
কিন্তু সারমাদ বলে, বেহেশতই নেমে এসেছিলো মুহাম্মদের করতলে
সেইদিন থেকেই দিল্লির রাজ দরবাদের সারমাদ কাফের ‘উপাধি’ পেয়ে বসেন।
সারমাদকে নিয়ে এছাড়াও বহুমিথ ছড়িয়ে আছে মরমি সাধকদের মুখে মুখে। সেই মিথের কাহিনী ধরে এগোলে মনে হয়, এতকিছুর পরও সুচতুর আরঙ্গজেব সারমাদকে মৃত্যুদণ্ড দিতে বিলম্ব করছিলেন। যেহেতু সারমাদ বেশ পণ্ডিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন ততদিনে। আরবি ও ফার্সি ভাষায় তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। সেকালের সুপরিচিত পণ্ডিত-শিক্ষক মোল্লা সদরুদ্দিন শিরাজি, মির্জা আবুল কাসিম ফান্দারসাকিসহ আরও অনেক বিখ্যাত পণ্ডিতের কাছে তিনি বিজ্ঞান ও দর্শন পড়েছিলেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মার্সম্যান বলেন– আর্মেনিয়ানরা ভারতকে দিয়েছে সারমাদের মতো একজন শক্তিশালী কবি। তার মেধার কারণেই সতের শতাব্দির মধ্যভাগে গুণী সাধক ও পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে তার সুনাম ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধু ভারতে নয়, তখনকার সময়েও বিশ্বের অনেক দেশেরই সৌন্দর্য পিপাসু মহৎ ব্যক্তিগণ তার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতেন। এমনকি যে ভাষার কবিদের কবিতার সৌন্দর্যে আজও বিশ্ব বিমুগ্ধ সেই ফার্সি ভাষার কবি ফেরদৌসি, নিজামি, সাদি, হাফিজ, জামি ও খৈয়ামের দেশে তার নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হতো।
তাই বাদশা জানতেন, যেনতেন মানুষ সারমাদ নয়। তাকে রুটিনমাফিক শাস্তি দেয়া চলবে না। অতএব একদিন কায়দা করে তাকে ধরে বসলেন তিনি দিল্লি শাহি মসজিদের চত্বর থেকে। নামাজের সময় হয়েছে। বাদশা তাকে ডাকলেন– আসো, সারমাদ, নামাজে আসো।
সারমাদ সঙ্গে সঙ্গে কোত্থেকে এক কাপড় জোগাড় করে এনে বাদশার পাশেই দাঁড়িয়ে গেলেন। বাদশা অবাক হবার পূর্বেই বোধহয় মোয়াজ্জিন ইকামত বলে দিয়েছে। ইমাম যথারীতি তাকবির দিয়েছেন এবং নামাজের কেরাতও রীতিমতো পাঠ করছেন। প্রথম রাকাতটা সারমাদ কোনোমতে উসখুস করে কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় রাকাতে বারংবার পদাঘাত করছেন মসজিদের মেঝেতে। পদাঘাত করছেন আর বলছেন– “এই দ্যাখ, তোর খোদা আমার পায়ের নীচে।”
ব্যস। গোঁড়া আওরঙ্গজেব আর কোনোকিছুতেই পরোয়া করলেন না। কাফের ঘোষণা দিয়ে সারমাদকে মৃত্যুদ- দিলেন। প্রচলিত আছে যে, মোগল সম্রাজ্য ধ্বংস হয়েছে সারমাদের অভিশাপে।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখেছেন, আজকাল হয়তো লোকে মুখের কথার ইতিহাস গুরুত্ব দেবে না। তবে চাক্ষুস সাক্ষীদের জবানবন্দিতে জানা যায়, জল্লাদকে সামনে দাঁড় করিয়ে বাদশা বললেন– ওকে কালেমা পড়তে বলুন। সারমাদ শুধু ‘লা ইলাহা’ বললো। বাকি অংশ পাঠ করতে বলা হলে তিনি বলেন যে, আমার আধ্যাত্মবোধ ও উচ্চতা এর বেশি সায় দেয় না। আমি এখনো ‘না’-এর স্তরে আছি; ‘হ্যাঁ’ পর্যন্ত পৌঁছতে পারি নি।
জল্লাদ যখন দণ্ড কার্যকরণ স্থানে নিয়ে এলো, সারমাদ উপস্থিতমত নিজের ২৪টি রুবাইয়াত আওড়ে গেলেন। শেষ সময় ঘনিয়ে এলো। নিয়মানুযায়ী হত্যা করার আগে দণ্ডিতের মাথা কালো কাপড়ে ঢেকে নিতে হয়। জল্লাদ কাপড় দিয়ে সারমাদের চোখ বেঁধে দিতে চাইলে সারমাদ ইঙ্গিত করলেন, চোখ না বাঁধার জন্য। এরপর তিনি হাসলেন। বললেন–
খোলা তলোয়ার হাতে বন্ধু এসে দাঁড়িয়েছে কাছে
এসো এসো, কীসের এত অস্বস্তি তোমার?
যে সাজেই সাজো তুমি, আমি তোমারে চিনি।
এরপর আওরঙ্গজেবের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে বিদ্রূপ করে বললেন–
হাঙ্গামার আওয়াজ শুনে চিরঘুম থেকে উঠে চাইলাম
দেখলাম, চারপাশে চলছে অশুভ শক্তির রাজ
তাই আবার ঘুমিয়ে গেলাম
আওরঙ্গজেবের দরবারের ধারাভাষ্যকার আকিল খান রাজি লিখেছেন যে, জল্লাদ যখন তলোয়ার ওপরে তুললো, সারমাদ তখন অবিচল কণ্ঠে বললেন-
বন্ধুর কাছে বন্ধুর নগ্নতা নিতান্তই ধূলিসম
এ নিয়ে তারা কখনো করে না খেদ,
কিন্তু নগ্নতাও কারও জন্য হয় কাল
তরবারির আঘাতে ঘটে শিরোচ্ছেদ
সারমাদের একজন শিষ্য ছিলেন শাহ আসাদুল্লাহ, মৃত্যুর আগে তিনি কাছে গিয়ে বললেন– আল্লাহর নাম জপ করুন, এখন আপনার মৃত্যু হচ্ছে। মাথা উঠিয়ে সারমাদ তার দিকে তাকালেন। বললেন–
বহুকাল কেটে গেছে হাল্লাজের গল্প বলার পর
এবার আমি বধ্যভূমিতে আনবো নতুন বিভা
সারমাদের মাথা কাটার পর দেখা গেলো দিল্লী জামে মসজিদের সিঁড়ি বেয়ে তার রক্ত এবং কাটা মাথা থেকে আওয়াজ বেরুচ্ছে– ‘ইল্লাল্লাহ’। জীবিত ও নিহত সারমাদ যেন কলেমার সত্যকে তার জাগতিক অবস্থানভেদে প্রকৃতরূপে উচ্চারণ করলেন। যে খোদাকে তিনি দেখেন নি, সে খোদার মহিমা দেখিয়ে গেলেন অবিস্মরণীয়রূপে। আর লজ্জিত ও মর্মাহত হলেন আওরঙ্গজেব স্বীয় অজ্ঞতায়। কেননা, পরে সারমাদের এক গুরুর পরামর্শে মসজিদে তার পদাঘাতের স্থান খুঁড়ে দেখা গেলো, অনেকগুলো স্বর্ণমুদ্রা গচ্ছিত সেখানে। আর ইমাম জানালেন, অর্থকষ্টের কারণে নামাজে তার মন বসছিলো না সেদিন। বাদশা বোধহয় তখনি বুঝতে পেরেছিলেন, সারমাদকে প্রকৃত অর্থে মারা সম্ভব নয়। চিরকালই বেঁচে থাকবেন তিনি। আওরঙ্গজেব, আলমগিরের অযুত আলোর নীচে কালো দাগ হয়ে রয়ে যাবে এই ইতিহাস।
তা-ই হয়েছে। যদিও সারমাদের জন্মসাল নিয়ে মতান্তর রয়েছে, হতে পারে ১৫৯০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন, অথবা অন্য কোনো সময়। কিন্তু জন্ম নিলেই কি সবার মরণ হয় ? হতে পারে দিল্লি জামে মসজিদের সামনে সারমাদ-বধের দিন নজির বিহীন লোকের সমাগম ঘটেছিলো; যারা সারমাদের মৃত্যুর সাক্ষী। কিন্তু তবু কি সারমাদের অমরত্বে তারা বাধা হতে পেরেছে ? হতে পারে, সারমাদের সমাধিও তৈরি হয়েছে, হোক তা শাহি মসজিদ থেকে মাত্র ১৭২ কদম দূরে, অথবা তারই একসময়ের গুরু সুফি হারেভারে শাহের পাশে। তারপরও কি হলফ করে বলা যায়, সারমাদ এখন আর বেঁচে নেই ?