[ধসে যাওয়া রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপের তৃতীয় তলা। ঘুটঘুটে ‘কবরের’ আঁধার চারদিকে। একে একে খসে পড়ছে পলেস্তারা, ইট-সুড়কি-বালি। আহতদের গগনবিদারী আর্তচিৎকার। ছড়ানো ছিটানো মৃতদেহের স্তুপ। কিছুক্ষণের মধ্যে নেমে আসে রাজ্যের নিরবতা। একজন উদ্ধারকর্মীর প্রবেশ।]
উদ্ধারকর্মী : এইখানে কেউ কি আছেন? শুনতে পাচ্ছেন আমাকে? মুর্দা : জি, এইতো আমি আছি, কিছু বলার থাকলে আমাকে বলতে পারেন। এই যে, এখানে। আর এক তলা, দুই তলার দিকে যাবেন না। ওদিকে আমার সহকর্মী ভাই-বোনেরা শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। চেচামেচি করবেন না দয়া করে।
উদ্ধারকর্মী : ওহ, যাক! আপনি বেঁচে আছেন এখনো! চলুন আপনাকে উপরে নিয়ে যাই … অক্সিজেনের অভাব। তাপও সহ্যসীমার বাইরে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বেশিক্ষণ এখানে থাকাটা ভয়ংকর হতে পারে … মুর্দা : বেঁচে আছি মানে! কে বলেছে? আমি টোটালি ফেডআপ … আর, কোথায়ইবা যেতে বলছেন? আর ইউ লুকিং ফর গলিত লাশ অর জীবিত? উদ্ধারকর্মী : জি। আপনাকেই নিতে এসেছি। এই দেখুন, ৯ তলার সুড়ঙ্গ করে তৃতীয় তলায় এসে আপনাকে পেলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য! আপনি শ্রমিক হয়েও দেখছি শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা ও ইংরেজি বলে যাচ্ছেন। কি করে বলুনতো! মুর্দা : শুদ্ধ বাংলা আর ইংরেজি বলাতেও কি আপনাদের তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি? ভাষাটা আপনাদের ভদ্রলোকদের কাছে থাকতে থাকতে রপ্ত করেছি আর কি। আর একটি কথা। আমি দেহান্তরিত হয়েছি গতকালই। আমাকে এখন বড়জোর গলিত লাশ বলতে পারেন। আর হ্যাঁ, এখানে আর কি চান? আমরাতো এখন ভোটের অধিকারহীন। সুতরাং ওই বাজারেও অচল মাল আমরা। উদ্ধারকর্মী : জি … আমার মন্তব্য নাই এ ব্যাপারে মুর্দা : শুনুন, আমি এবং আমরা আর ফিরব না। রানা প্লাজার ২৮ হাজার টন সভ্যতার বর্জ্র এখন বুকে নিয়ে দিব্বি ভাল আছি। আমার মা-বোন, বাবা-ভাইয়েরা সবাই ভাল আছে, দেখুন তাকিয়ে, কংক্রিটে চ্যাপ্টা হয়ে কতো সুন্দর করে ওরা ঘুমোচ্ছে। দুনিয়া নিয়ে কোনো টেনশন নাই এখন। কারো কোনো হুমকি নাই, কাজে যোগ না দিলে চাকরি খোয়াবার ভয় নাই। আর শুনুন, এসেই যখন পড়েছেন, কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাবেন দয়া করে … উদ্ধারকর্মী : জি, বলুন। অবশ্যই জবাব দেব। অন্তত চেষ্টা করব। মুর্দা : আচ্ছা, ভবন ধসের ঘটনায় দোষ কি শুধু সোহেল রানার? উদ্ধারকর্মী : লোকজনতো তা-ই বলছে। তার ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ হচ্ছে। মুর্দা : ১ নম্বর আসামি সোহেল রানা তো একা করেনি এই অপরাধ ২. মুরাদ জং, সাভারের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ৩. কবির হোসেন সরকার, ইউএনও সাভার ৪. আমিনুল ইসলাম, নিউ ওয়েভ বাটন ও নিউ ওয়েভের মালিক ৫. মাহমুদুর রহমান তাপস, চেয়ারম্যান নিউ ওয়েভ স্টাইল ও নিউ ওয়েভ অ্যাপারেলস ৬. বজলুস সামাদ আদনান, মালিক, নিউ ওয়েভ স্টাইল ও নিউ ওয়েভ অ্যাপারেলস ৭. মো. আমিনুল ইসলাম, মালিক, ফ্যান্টম অ্যাপারেলস, ফ্যান্টম ট্যাক লিমিটেড ৮. আনিসুজ্জামান ও ডেভিড মেয়র রেকো, এমডি, ফ্যান্টম টেক লিমিটেড ৯. মো. আনিসুর রহমান, মালিক, ইথার টেক্সটাইল লিমিটেড ১০. এমতেমাম হোসেন, নির্বাহী প্রকৌশলী, সাভার পৌরসভা ১১. মোহাম্মদ আলম, সহকারী প্রকৌশলী, সাভার পৌরসভা। এবং ১২. ওসি, সাভার থানা। এরা কি অন্যায় করেনি? উদ্ধারকর্মী : জি, বুঝলাম। বিষয়টি গভীরের। মুর্দা : না এখনো বুঝেন নাই। আপনারা জ্ঞানী মানুষজন বুঝলে দেশের আজ এই দশা হতো না। উদ্ধারকর্মী : লজ্জা দিবেন না। একটু আগেও দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আপনার এমন যুক্তিপূর্ণ কথায় কেমন যেন স্বস্তি পাচ্ছি। শ্বাসকষ্টটাও আর নেই। মুর্দা : আরো কয়েক ঘন্টা থাকেন। আরো আরাম বোধ করবেন। এই যেমন আমার এখন আর শ্বাসকষ্ট নাই। উদ্ধারকর্মী : জি, তা-ই মনে হচ্ছে এখন। মুর্দা : আর হাঁ, উপরে যে নামগুলো বললাম, দোষ শুধু তাদেরও না। উদ্ধারকর্মী : বলেন কি!? তাহলে দোষটা কার? মাথায় চক্কর মারল কিন্তু। মুর্দা : চক্কর ছাড়াচ্ছি। দোষ এই দেশের সোশ্যাল সিস্টেমের। রানা প্লাজার দুই সুতি/তিনসুতি (কমদামি) রড আর তৃতীয় ক্যাটাগরির সিমেন্ট দিয়ে তৈরি ভিত যেমন মজবুত ছিল না। এই দেশের সোশ্যাল সিস্টেমের ভিতও মজবুত না। ‘জং’ ধরা। এই সিস্টেমের খোলনলেচে একেবারে পাল্টাতে হবে। পারবেন? উদ্ধারকর্মী : কি বলছেন এসব! এতো দেখি মহাবিপ্লবী কথা বলছেন! মুর্দা : না শুনেই লাফ দিলেন। আগে শুনুনতো। আমরা এতগুলো মানুষ প্রাণ দিলাম, তারপরও আপনাদের হুঁশ নাই? আপনারা শুধু বলতে চান; শুনতে চান না। তাজরীনের ওদের সাথে একটু আগেই কথা হল। ওরাও বাংলার শ্রমজীবীদের জন্য একটি আকুতি জানিয়ে গেল। ওরা কোটি টাকা, বাড়ি ও গাড়ি চায়নি। শুধু প্রিয় মুখগুলোরকাছে একবার ফিরে যেতে চেয়েছিল। পারেনি; দরোজা বন্ধ করে রেখেছিল মালিকেরা। তাই কয়লা হতে হলো তাদের। উদ্ধারকর্মী : জি, বলে যান। আমি শুনছি। আপনাদের কথা শুনতেই হবে … মুর্দা : আপিন কি কখনো মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, এমনকি প্রতিবেশি দেশ ভারতে এমন ঘটনা দেখেছেন? দেখেননি। শ্রমজীবী মানুষদের ডেকে এনে এ রকম একটা ঝুঁকিপূর্ন ভবনে কাজ করানো এই দেশেই শুধু সম্ভব। কারণ, ওই যে বললাম, সিস্টেমের গলদ। কোনো সরকারই আমাদের জীবন নিয়ে ভাবে না। আমরা শুধু তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার উপকরণ-ভোট। ভোটের অনেক শক্তি, কিন্তু আমাদের শক্তি নাই। কোনো সরকারই এই ঘুণে ধরা সিস্টেমটা ভাঙে না। আরেকটা কথা, রানা কি বাংলাদেশের বাইরে ছয়তলার অনুমতি নিয়ে নয় তলার এমন ভবন বানাতে পারতো? পারতো না। এখানে টাকা দিলে বাঘের দুধও পাবেন। শাদাকে কালো করতে পারবেন। সব অসম্ভবের দেশ। সবকিছুর মূলে কিন্তু ওই যে বললাম ব্যাড সিস্টেম-এর দুষ্টু-চক্র। রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার চরম এমন নজীর পৃথিবীতে আর নেই। উদ্ধারকর্মী : বারবার এই সিস্টেমের কথাটা বলছেন। এই সিস্টেম ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না এখনো। জটিল মনে হচ্ছে। একটু খোলাসা করে বলতেন যদি। মুর্দা : আপনার জানার আগ্রহ মুগ্ধ করল আমাকে। কেউ আমাদের কথা শোনে না। হাঁ, বলছি। জিনিসটা একেবারেই পরিস্কার। রানা প্লাজার কথাই ধরুন। এই পাঁচতলা ভবন রানা ৯ তলা ক্যামনে বানালো? হাঁ, ঠিক ধরেছেন। উপরে যে ১২ জনের নাম বললাম, তার সাথে আরো যোগ করে নিতে পারেন, সাভার পৌর মেয়র রেফাতউল্লাহ, ভবনের মালিকের নিয়োগ দেওয়া স্থপতি এটিএম মাসুদ রেজা নকশা করে অনুমোদনের জন্য সাভার পৌরসভা কার্যালয়ে দাখিল করেছিলেন, তিনি। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট ৭ নং ওয়ার্ড কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলী খান সুপারিশসহ প্রত্যয়ন প্রদান করেন, তিনি। এরপর সাভার পৌরচেয়ারম্যান, পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফরজানা ইসলাম ও উপ সহকারি প্রকৌশলী রকিবুল হাসান তদন্ত করে এ নকশা অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করেছিলেন, তেনারা। উদ্ধারকর্মী : জি, বিষয়টা আস্তে আস্তে পরিস্কার হচ্ছে। মুর্দা : আরো পরিস্কার হবে। এই যে এতগুলো লোক অন্যায়টা করেছিল, কীভাবে তারা এটা পারল? সহজ উত্তর। সিস্টেম ঠিক নাই। এমন দুই নম্বরি সিস্টেম পৃথিবীর আর কোথাও নাই। এ দেশে ট্রাফিকে লালবাতি জ্বলে, এরপরও গাড়ি ঠেলে সিগনাল ক্রস করতে চায়। অসহায় পুলিশ ভায়েরা এসে লাঠি নিয়ে দাঁড়ায়, এরপর গাড়ি থামে। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবেন? অনেক দেশে লিখিত আইন নাই, দেশ চলে পানির মতো। কোনো সংকট নাই, দুর্নীতি নাই। আমাদের আইনের অভাব নাই, বহু আইন। কথায় কথায় আইন তৈরি হয়। কিন্তু যে আইনের প্রয়োগ নাই সেই আইন বাড়িয়ে লাভ কি? উদ্ধারকর্মী : বুঝতে পারছি। মুর্দা : ৪২ বছরে আমরা সকল দলরেই ভোট দিয়ে দেখেছি। সবাইরে পরীক্ষা করা শেষ। কেউ কথা রাখে নাই। তারা নূণ্যতম পাশ নম্বর শতকরা ৩৩ নম্বরও পায় নাই। কারণ তারা কেউ সিস্টেম ঠিক করে নাই। দুবৃত্তায়নকে তারা লালন করেছে। মানুষের সামনে মূলা ঝুলিয়ে নির্বাচনে পাশ করে গেছে। উদ্ধারকর্মী : খুব হতাশার। ৪২ বছর কম সময় নয়। মুর্দা : আপনি কি জানেন, এই মুহুর্তে রাষ্ট্রয়াত্ব ও বেসরকারি খাতের কমপক্ষে ছয়টি ব্যাংক তাদের পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে বিপুল অংকের ভুয়া ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ করেছে। তাদের এখন বিশাল অংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। বিষয়টি এমন যে, আমানতকারীর টাকা গিয়ে উঠেছে অতিলোভী শিল্পমালিক-গার্মেন্ট মালিকদের পকেটে। এরা আবার রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই বিদেশেই রেখে আসে। দেশে আনে না। তাদের সেখানেই বাড়ি-গাড়ি আছে। তাদের ছেলেপুলেরা সেখানেই পড়ালেখা করে। আর এই দেশে কিছু অসচেতন তরুন-যুবা তাদের ফাঁদে পা দিয়ে রাজপথে রক্তের হোলিখেলার রাজনীতি করে। মূর্খরা এটা বুঝতে পারে না। আচ্ছা বলেনতো, ৯০ সালের পর ছাত্র রাজনীতির কোনো কল্যাণ কি দেশবাসী পেয়েছেন? লাশ উপহার ছাড়া? জরিপ লাগবে না। দেশের ৭০ লাখ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন। এদের প্রোফাইলে গেলে দেখবেন, এরা কেউ রাজনীতি পছন্দ করেন না। মাত্র ১% হবে, তারা পছন্দ করেন। কেন এমন হলো? উত্তর একটাই, নষ্ট দুষ্টু চক্র সেই সিস্টেম। উদ্ধারকর্মী : ভয়ংকর সত্য! ভয়ংকর তথ্য। মুর্দা : আরো আছে। আমাদের মজুরি নিয়ে কতো কেচ্ছা হয়। মজুরি কত? ৩০০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে কি শরীরের পুষ্টির জোগার হয়? একজন শ্রমিকের কাজ করতে গড়ে প্রতিদিন ২৩০০ ক্যালরি দরকার। এ জন্য মজুরি কম করে হলেও ৮ হাজার টাকা প্রয়োজন। শ্রমিকরা পান মাত্র ৩০০০ টাকা। পুষ্টিহীন শরীরে কিভাবে হাত চলবে তাদের? এরচেয়ে মরে গেছি, খাওয়া-পরার চিন্তা নাই। আফসোস একটাই, আমাদের তৈরি পোশাক বিক্রি করে মিলিয়ন ডলার ওনারা আয় করে যদি সেগুলো পুরোটাই দেশে আনতেন। দেশের উন্নয়ন হতো। আমাদের কোনো আফসোস থাকতো না। উদ্ধারকর্মী : সাংবাদিকরাতো বিষয়গুলো গভীরে গিয়ে তুলে আনতে পারতো। মুর্দা : সাংবাদিকদের কথা বলবেন না। ৭০ ভাগ সাংবাদিক অসাধু। তারা কেউ মালিকপক্ষের দাস, কেউবা কর্পোরেটের। তাদের নিজস্ব মেরুদণ্ড নাই, নিজের কথা নাই, একেকজন তোতাপাখী। গণমানুষ-শ্রমজীবীদের কথা লিখলে তাদের লেখনীর ধার থাকে না। আমোদের মালিকদের নিয়ে লিখলে নাকি মিডিয়া তাদের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন পায় না। আমরা রদ্দি মাল। তবে কখনো কখনো আমরা গুরুত্বপূর্ণ নিউজ এলিম্যান্ট হয়ে উঠি। যেমন তাজরীনের আগুন। টানা একমাস আমরা নিউজের লিড সাপ্লাই দিছি। এখন রানা প্লাজা। দেখেন না, টিভিগুলো রাতদিন লাইভ দেখাচ্ছে। টিআরপি বাড়ছে। ভালতো, ভাল না? আর দেখেন, সাংবাদিকরা তাদের মালিকদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কতটা সচেতন। তারা উদ্ধার করার আগে ছাদের ফুটো দিয়ে ক্যামেরা-মাইক্রোফোন ঢুকিয়ে দিয়ে সাক্ষাৎকার নেয়। লাইভ দেখায়। ইন্টারপ্রিটেটিভ এবং ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিংয়ের সাথে এবার যোগ করতে পারেন সিরিয়াস রিপোর্টিং। হা হা হা … উদ্ধারকর্মী : দয়া করে অট্টহাসি থামান। আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যেতে চাইছে। মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে … থামুন ভাই.. মুর্দা : এই টুকুতেই এই অবস্থা। এই ট্রাজেডির বিচার নিয়ে সামনে হয়তো দেখবেন কৌতূক নাটক। তখন আপনারও অট্টহাসি পাবে। সবাই হাসবে। ষোলকোটি মানুষ হাসবে। সইতে পারবেন তো সেই প্রলয় হাসি? শুধু হতাশ হইয়েন না। এ দেশে আশারও অনেক দৃষ্টান্ত আছে। এই যে আপনারা জীবন বাজি রেখে আমাদের শ্রমজীবী মা-বাবা-ভাই-বোনদের প্রাণ বাঁচালেন, দেশবাসী কাঁদল। সবাই কাধে কাধে মিলিয়ে যেভাবে আমাদের উদ্ধার করলেন… এটাতো বিরল ঘটনা। আমাদের মতোই খেটে খাওয়া যুবক হাবিব, বাবু একাই বাঁচালেন ৩০ জনকে। সেনা কর্মকর্তা আশরাফ। চৌকস অফিসার। পেশাগত কারণেই তাদেরতো আবেগ থাকার কথা না। একজন সেনা কর্মকর্তা যাকে কিনা প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়েছে নির্ভয়, পেশাদার করে। তাদেরকে আবেগ সাধারণত ছুতেঁ পারে না। অথচ সেই সেনা কর্মকর্তাটিও বাচ্চার মতো হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠেন যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করে শেষ মূহুর্তে এসে পোশাক শ্রমিক শাহীনুরকে আর বাঁচাতে পারলেন না। শাহীনুর বেগমকে বাঁচানোর কথা দিয়েছিলেন আশরাফ। কিন্তু উদ্ধার কাজের শেষ পর্যায়ে রাত সাড়ে ১০টায় ধ্বংস্তুপের নিচে আগুন ধরে গেলে মারা যান শাহীনুর। তাকে বাঁচাতে না পেরে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। অচেনা সেই যুবকটির কথা মনে আছে কি? যে যুবক, ধ্বংসম্তুপ থেকে উদ্ধার পেয়ে ফিরে এসেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ডাক্তাররা তাকে চিকিৎসা দেয়। জ্ঞান ফিরেই সে আবার যেতে চায় মৃত্যুফাঁদ সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার কংক্রিটের কবরে। বলে ওঠে ”আমি ছাড়া আরো দুইজন ওইখানে আটকা পড়ে আছে, জায়গাটা আমি ছাড়া কেউ চিনবো না, আমারে একবার যাইতে দেন আপা, তারা বাইচা আছে, আমি চিকন মানুষ, আমি পারুম ঢুকতে…।” সত্যিই সর্বস্তরের মানুষ কাধে আজ মিলিয়েছে কাধ, আমরা এমন এক জাতি, আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি। ১৬ কোটি মানুষ স্রেফ গুটিকয়েক নষ্ট অতিলোভী মানুষের জন্য ভুল পথে হাটতে বাধ্য হচ্ছি। ভুল রাজনীতি আমাদের শেষ করে দিল, নইলে রানা গংদের মত লোকেরা এই ধরনের দুঃসাহস কই পায়? উদ্ধারকর্মী : হৃদয় বিদারক। সত্যিই, বিপদ এলে বন্ধু চেনা যায়, শত্রুও চেনা যায়। মুর্দা : ঠিক বলেছেন। এই যে উদ্ধারকারীরা; তারা কিন্তু ঠিকই বুঝতে পেরেছেন আমরা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখি। আমরা বঞ্চিত। এ কারণেই তারা আমাদের জন্য জীবন বাজি রেখেছেন। আমরা কৃতজ্ঞ। উদ্ধারকর্মী : রানাকে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিচার নিশ্চয়ই হবে। মুর্দা : বিচার! হা হা হা (অট্টহাসি)। রানার স্যুটকেসে দুইটা বোতল দেখেছেন তো? এখন বুঝে নেন। আর গ্রেপ্তারের কথা বললেন। ওটাতো আত্মসমর্পনও হতে পারে। পরে মিডিয়া শো। অন্ধ মিডিয়া… বন্ধ চোখে যা দেখে তা-ই লেখে। ভেতরে যেতে পারে না। মুরোদ নেই। ইনভেস্টিগেশান নেই। উদ্ধারকর্মী : হাঁ। আমাদের অনুসন্ধানি রিপোটিংয়ের অভাব রয়েছে। সে যাই হোক, আমাদের এক মন্ত্রী বলেছেন, আহতদের চিকিৎসার সব ব্যয় বহন করবে সরকার। এটাতো স্বস্তির বিষয়। মুর্দা : হা হা হা (অট্টহাসি)। আগে বলেন, শাবল, হাতুড়ি, টর্চলাইটই যেখানে সরকার সরবরাহ করতে পারে না, সেখানে চিকিৎসাব্যয়ভার কতটা বহন করবে সরকার? জবাবটা আপনিই দেন। উদ্ধারকর্মী : জি আমার দুঃশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিলেন। মুর্দা : দুশ্চিন্তার কিছু নেই। চলছে চলবে, যদি না দুষ্টু সিস্টেমের নষ্ট চক্র না ভাঙতে পারেন। আচ্ছা ধরুন তো, আমেরিকা নয়, নিদেন পক্ষে এই রানা যদি মালয়েশিয়াতেও এই ভবন নির্মানের চিটারি করার চেষ্টা করতো, পারত কি? পারতো না। তাহলে মালয়েশিয়ার সাথে আমাদের পার্থক্য কি? পার্থক্যটা সিস্টেমের। ওদেরটা সলিড সিস্টেম। আমাদের ‘জং’ ধরা সিস্টেম। আমাদের দেশে মাহাথির মোহাম্মদের মতো একজন দেশপ্রেমিক শ্বৈরাচারের জন্ম হয়নি। দুর্ভাগ্য আমাদের। ১৯৭১-এর আগে মালয়েশিয়া আমাদের চেয়ে পিছিয়ে ছিল, চার দশকে অনির্বাচিত-নির্বাচিত শ্বৈরাচারের হাতে পড়ে আমরা পিছিয়ে গেছি হাজার বছর। উদ্ধারকর্মী : আফসোস বাড়ালেন … মুর্দা : আফসোস কইরেন না। সময় এখনো আছে। আচ্ছা, একটা অলুক্ষণে কথা বলি। (সৃষ্টিকর্তা না করুন) যদি এমন হতো যে সব অসাধু অতিমুনাফালোভী শিল্পপতি-গার্মেন্ট মালিকরা বৈঠক করতে সমবেত হয়েছিলেন রানা প্লাজার মতো এরকম একটি ভবনে। সেটা ধসে পড়লে আপনাদের মতো এতো গণমানুষ কি উদ্ধার অভিযানে নামতো? নামতো না। পুষ্টিহীন-বঞ্চিত এই আমরাই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখি। আপনাদের মতো সাধারণ মানুষরাই তা-ই আমাদের উদ্ধারে এসেছেন। তবে অনেক সৎ আর ভাল শিল্পপতি-মালিকও আছেন। এ থেকেও কিন্তু আলো খুঁজে নিতে পারেন। নষ্ট রাজনীতিকদের দিকে তাকালে হতাশা বাড়বে। উদ্ধারকর্মী : জি, নষ্ট রাজনীতির অবসান দরকার। আত্মকল্যাণমুখী নয় জনকল্যাণমুখী রাজনীতি দরকার এখন। মুর্দা : ঠিক ধরেছেন। একটা কথা মনে এল। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের কথাতো এখনো ভোলেননি? এমন একজন নিঃস্বার্থ নির্মোহ রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে শোক ঘোষণায় ২৪ ঘন্টা বিলম্ব হলো। যখন সরকার দেখল, বিরোধী নেত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নের্তৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করেছেন, তখন সরকারের মনে হলো রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা দরকার। এখানেও নষ্ট রাজনীতি। বোঝেন আমাদের রাজনীতি কোথায় গেছে। উদ্ধারকর্মী : আপনার কথায় অকাট্য যুক্তি। কাউন্টার দিতে পারলাম না। কথা অনেক হলো, এবার চলুন আপনাকে উদ্ধার করে উপরে নিয়ে যাই। মুর্দা : আপনিও দেখছি দেশের আর সবার মতো গোল্ডফিশের স্বভাবের। একেবারে বিস্মৃতপ্রবণ। মাত্র এক ঘন্টা আগেই কিন্তু বলেছি, আমি জীবিত কেউ নই। মারা গেছি গতকালই, দেখছেন না থেতলানো শরীরে চাপচাপ মরা রক্ত। ভুলে তো যাবেনই। আপনারা ভুলে যাবেন এই আমাদেরকেও। যেমনটা ভুলে গেছেন ২০১২ সালে অন্যতম আলোচিত কেলেঙ্কারির ঘটনা পদ্মাসেতু দুর্নীতির চক্রান্ত। শেয়ারবাজারের ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার লুটপাট, সোনালী ব্যাংকে হলমার্কের দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকার জালিয়াতি। সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনির নৃসংস হত্যাকাণ্ড, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত সহকারী ওমর ফারুকের গাড়িতে বিপুল অংকের অর্থ পাওয়ার ঘটনা। ঘটনার পর থেকেই নিখোঁজ সুরঞ্জিতের এপিএস ফারুকের গাড়ি চালক আজম খান। ভুলে গেছেন আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তুবা গ্রুপের মালিনাকাধীন তাজরীন ফ্যাশনস নামের একটি ৮ তলা পোশাক কারখানা ভবনে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে জীবন্ত পুড়ে মারা যাওয়া ১২৪ জন শ্রমিককে। পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্বজিৎ দাস নামের এক দরিদ্র দর্জি দোকানিকে। বিশ্বজিৎকে হত্যা করে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। ভুলে গেছেন ১৫ বছর ধরে হাজতে থাকা দেশের অন্যতম শীর্ষ সস্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাসের মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি। ভুলে গেছেন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান ইস্যু। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে সে রাতে নিখোঁজ হওয়া তার গাড়িচালক আনসার আলীও আর ফেরেননি। অথচ সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদে ‘নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের’ কথাটা স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা তাদের নিরাপত্তা ‘সুনিশ্চিত’ করতে পারেনি। অশেষ কৃতজ্ঞতা। আপনি যান, আমাদের জন্য দোয়া করবেন। নিশ্চিন্তে থাকবেন আপনারা দেশবাসী। আমরা আর বেতন-ভাতার দাবিতে বিক্ষোভ করে অযথা আপনাদের শান্তি নষ্ট করব না। এই ছোটলোক আমরা চিরদিনের জন্য চুপ হয়ে গেলাম। লিখেছেন, লুৎফর রহমান হিমেল, সম্পাদক, পরিবর্তন ডট কম |