Main Menu

ইলিয়াস আলী নিখোঁজ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তোলপাড়

+100%-
বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ঘটনা গত কয়েকদিন ধরেই বেশ ফলাও করে প্রচার হচ্ছে দেশের দেশের প্রায় সবকটি গণমাধ্যমে। বিষয়টি নিয়ে সরব আল জাজিরা, গার্ডিয়ান, রয়টার্স, নিউইয়র্ক টাইমস ও এএফপির মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও। এ ঘটনায় বিএনপির ৩ দিনের হরতালের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। বার্তাসংস্থা রয়টার্স সার্বক্ষণিক হরতাল ও আন্দোলন-সংগ্রামের আপডেট সংবাদ প্রচার করছে। রয়টার্স জানিয়েছে, ‘ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের প্রতিবাদে সিলেটসহ সারা দেশ উত্তাল।’

‘পলিটিক্যাল ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স প্লেগ বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশে রাজনৈতিক নিখোঁজের মহামারী) শিরোনামে আল জাজিজার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে গত বছরে বাংলাদেশে প্রায় ১০০ মানুষ গুম হয়েছে, যাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে আছেন সিলেট অঞ্চল থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী। ইলিয়াসের স্ত্রী নিশ্চিত যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণেই নিরাপত্তা বাহিনী তাকে অপহরণ করেছে। এ ঘটনায় বিরোধী দল বিএনপি ও দলটির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের মিত্ররা রোববার থেকে দেশজুড়ে অবরোধ শুরু করেছে। বিক্ষুব্ধ বিরোধী নেতাকর্মীরা যানবাহন পুড়িয়েছেন, স্কুল, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও দোকান বন্ধ রয়েছে। রাস্তায় নেতাকর্মীরা বলছেন, তাদের শত শত সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, ইলিয়াস আলীকে ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিবাদ চালিয়ে যাবেন।

নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজ লিখেছে, ‘২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে বিএনপির আরেক নেতা, ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর চৌধুরী আলম নিখোঁজ রয়েছেন। গত দুই বছরেও তিনি কোথায় আছেন বা তার কী পরিণতি হয়েছে, সে সম্পর্কে পুলিশ কোনও হদিস দিতে পারেনি।’ নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধে বলা হয়, ‘শেখ হাসিনার সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয় পায়। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি, বৈষম্য বৃদ্ধি ও সম্প্রতি কয়েকজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তার সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস করেছে।’ বার্তাসংস্থা পিটিআই বলছে, ‘ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারে অভিযানের নির্দেশ দেওয়া হলেও এর প্রতি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের আস্থা নেই।’

প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় সন্দেহের আঙুল তোলা হচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দিকে। গত কয়েক মাসে ২০ জনেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গ্র“পগুলো এসব ঘটনায় র‌্যাব ও পুলিশকে দায়ী করেছে। ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং কয়েকজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মিলে ২০০৮ সালে বিপুল ভোটে জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকারের জনপ্রিয়তা বেশ হ্রাস পেয়েছে। একজন সিনিয়র রাজনীতিবিদকে গুম করার প্রতিবাদে প্রধান বিরোধী দল হরতাল ডাকলে প্রধান প্রধান নগর ও শহরগুলোয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপির অন্যতম সংগঠক ইলিয়াস আলী মঙ্গলবার রাতে বাসা থেকে বের হওয়ার অল্প সময় পরেই নিখোঁজ হন। পুলিশ তার পরিত্যক্ত গাড়ি ও মুঠোফোন উদ্ধার করে। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী গত কয়েক মাসে ২০ জনের বেশি নিখোঁজ হয়েছে, যা গত বছরের মোট সংখ্যার প্রায় অর্ধেক। তাদের অনেকেই বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী। আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইন গ্র“পগুলো র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও স্থানীয় পুলিশকে দায়ী করেছে। র‌্যাব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী গ্র“প বা সহযোগীদের হাতে নিখোঁজ অনেকে মারা যায়।

গার্ডিয়ানের পক্ষ থেকে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর গার্ডিয়ানকে বলেন, নিখোঁজ হওয়ার আগে তার স্বামী সিলেটে বিএনপির হয়ে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘সে (ইলিয়াস) আমাকে বলেছিল যে, সরকারের সমালোচকদের তালিকা সরকার করছে। সে সরকারের জন্য হুমকি। না হলে তাকে এভাবে তুলে নেওয়া হতো না।’ পত্রিকাটিতে বলা হয়, ১৬ কোটি মানুষের এই দেশটিতে নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে নিখোঁজের ঘটনাটি ঘটেছে। গত সপ্তাহে পুলিশ ও বিরোধী কর্মীদের মধ্যে রাস্তায় রাস্তায় সংঘর্ষে ৩০ জনের বেশি আহত হয়।

‘দ্য বেঙ্গল টাইগারস ইন দ্য র কেজ’ শিরোনামে ‘শ্রীলংকা গার্ডিয়ান’ লিখেছে, ভারতীয় ‘র’ বিরোধীদলীয় ১০০ জন নেতাকে খুন-গুম করতে আওয়ামী লীগের ১০০ ক্যাডারকে ৬ মাস মেয়াদি সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তারাই ইলিয়াসসহ অন্যদের গুম করেছে। পত্রিকাটি লিখেছে, গত জুন থেকে দেরাদুনের ট্রেনিং নেওয়া এসব ক্যাডারদের গুপ্তহত্যা ও অপহরণের কৌশল শেখানো হয়েছে। ‘ক্রুসেডার-১০০’ ছদ্ম নামে পরিচিত এসব ক্যাডার রাজনীতিবিদ, মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের হত্যা ও গুম করার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে আসার পর আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদ, মিডিয়া কর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের একটি তালিকা দেওয়া হয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, এ তালিকায় ৮৩ ব্যক্তির নাম রয়েছে, যাদের ক্রুসেডার-১০০ ‘সাফ’ করবে। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ১০০ ক্রুসেডারকে ঢাকার গুলশান ও বারিধারা এলাকার কিছু ভবনে রাখা হয়েছে। বিএনপির সদ্য নিখোঁজ নেতা এম ইলিয়াস আলীর নামও ক্রুসেডার-১০০ এর তালিকায় ছিল। শ্রীলংকা গার্ডিয়ানের নয়াদিল্লিস্থ সূত্র আরও কিছু নাম জানিয়েছে। এর মধ্যে আমান উল্লাহ আমান, মির্জা আব্বাস, সাদেক হোসেন খোকা, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, হাবিবুন নবী সোহেল, আব্দুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, সাইফুল আলম প্রধান, আসম আব্দুর রব, মুফতি ফজলুল হক আমিনী ও মাওলানা ফজলুল করিম। আওয়ামী লীগ ও ‘র’ এসব লোককে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে খতম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব ব্যক্তির অস্তিত্ব আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া : শুধু গণমাধ্যম নয়, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে পশ্চিমা বিশ্বেও। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সংসদ নেতা স্যার জজ ইয়ং এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এবং তা নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য রিচার্ড ফুলার ও অ্যানমেইন ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে লিখিতভাবে অবহিত করেন। জবাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানান, তার সরকার বিষয়টিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এ ছাড়া ইলিয়াস আলীসহ সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক ‘নিখোঁজ’-এর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা।

এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইইউর ঢাকা কার্যালয় থেকে গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালকসহ বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রতিক গুমের ঘটনায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্বিগ্ন। আমরা আশা করি, সর্বশেষ এ গুমের ঘটনাসহ ইতিপূর্বে হওয়া গুমের ঘটনাগুলোতে সরকার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের ব্যবস্থা করবে। আমরা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানাই এবং সংঘর্ষের পরিবর্তে সংলাপের মাধ্যমে সব বিরোধের সমাধানে পৌঁছানোর জন্য আহ্বান জানাই।’



(পরের সংবাদ) »



Shares