Main Menu

সুরঞ্জিত বাবুর ঘুষের ৭০ লাখ টাকার

+100%-

 

ঐ এল বৈশাখ, ঐ নামে গ্রীষ্ম, খাইখাই রবে যেন ভয়ে কাঁপে বিশ্ব!

রবি ঠাকুরের বৈশাখের আহ্বানকে সুকুমার রায় এভাবেই পূর্ণতা দিয়েছেন। বৈশাখ আমার এবং আমাদের প্রাণে দুর্বার আকাংখার সঞ্চারণ করে। ‘এসো হে বৈশাখ’ বলে রবি ঠাকুর আমাদের নববর্ষকে যেমন এক ভিন্ন মাত্রা দান করেছেন, ঠিক তেমনি প্রিয় নজরুল কাল বৈশাখী ঝড়ের বেগে বিপ্লবের প্রেরণা যুগিয়েছিলেন।

শত শত বর্ষ পেরিয়ে বাংলা সন আজ পরিণত। আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ইতিহাস এবং ঐতিহ্যে মিশে বাংলা নববর্ষের বর্ণাঢ্য উদযাপন প্রমাণ করে বাংলা সংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধ এবং উচ্চমানের। আমদের চেতনার গভীরতা ছড়িয়ে আছে জাতীয় জীবনের প্রতিটি উৎসব-পার্বণে। অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয়’র মিশ্রণে সৃষ্ট বাংগালী জাতিকে সমৃদ্ধ করেছে বঙ্গ, গৌড় ও রাঢ় জনপদ। নিজস্বতায় অনন্য আমদের ভাষা ও সংস্কৃতি, তাই পহেলা বৈশাখে এলে আমরা স্বকীয় সত্ত্বায় আলোকিত হই, স্বাদ নেই শিকড়ের।

বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ বাংলাদেশ এবং ভারত বর্ষের একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত সৌরপঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সৌরদিন গণনা শুরু হয়। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির চেয়ে ৫৯৩ বছর কম হলেও বাংলা সন কিন্তু তারুণ্য ধরে রেখেছে। জন্মকালেই বাংলাসনের বয়স ছিল ৯৬৩ বছর।
বাংলা সনের প্রবর্তক মোগল সম্রাট আকবর দিল্লীর রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থেকেই এ দেশে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। তারই নির্দেশে রাজ জ্যোতিষী আমীর ফতেহ উল্লাহ শিরাজী ৯৯৮ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘বাংলা সন’ এর উদ্ভাবন করেন। প্রতাপশালী বাদশাহ আকবরের ৯৬৩ হিজরীতে অর্থাৎ (১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে) দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করার দিনটিকে স্মরণীয় রাখার জন্য বাংলা সন চালু করা হয়। নতুন চালুকৃত এই বর্ষপঞ্জিই পরবর্তীতে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন হিসেবে পরিচিত হয়।

বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হযেছে নক্ষত্রমন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে । এই নাম সমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ “সূর্যসিদ্ধান্ত” থেকে। বাংলা মাসের এই নামগুলি হচ্ছে –
বৈশাখ – বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
জ্যৈষ্ঠ – জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
আষাঢ় – উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নাম অনুসারে
শ্রাবণ – শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
ভাদ্র -উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুসারে
আশ্বিন – অশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
কার্তিক – কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
অগ্রহায়ণ(মার্গশীর্ষ) – মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
পৌষ – পুষ্যা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
মাঘ – মঘা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
ফাল্গুন – উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
চৈত্র – চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে

বাংলা সন অন্যান্য সনের মতোই সাত দিনকে গ্রহণ করেছে এবং এ দিনের নামগুলো অন্যান্য সনের মতোই তারকামন্ডলীর উপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে।
সোমবার হচ্ছে সোম বা শিব দেবতার নাম অনুসারে
মঙ্গলবার হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের নাম অনুসারে
বুধবার হচ্ছে বুধ গ্রহের নাম অনুসারে
বৃহস্পতিবার হচ্ছে বৃহস্পতি গ্রহের নাম অনুসারে
শুক্রবার হচ্ছে শুক্র গ্রহের নাম অনুসারে
শনিবার হচ্ছে শনি গ্রহের নাম অনুসারে
রবিবার হচ্ছে রবি বা সূর্য দেবতার নাম অনুসারে
বাংলা সনে দিনের শুরু ও শেষ হয় সূর্যোদয়ে । ইংরেজি বা গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির শুরু হয় যেমন মধ্যরাত হতে ।

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা সন সংশোধন উদ্যোগ নেয়া হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ সালে। পরবর্তীতে সরকারিভাবে এই সংশোধন গ্রহণ করা হয়।

এক হাজার বছর পূর্বে রচিত চর্যাপদ এ বৌদ্ধ কবিদের যাপিত জীবনের নানা অনুসঙ্গে নববর্ষ উদযাপনের কোন বর্ণনা দেখা যায় না। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।

আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করে। রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানান। ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণরূপে গণ্য হয়ে আসছে।

এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল থিম হচ্ছে সমুদ্র বিজয়৷ তাই, সমুদ্র বিজয়ের প্রতীকী রূপ হিসেবে শোভাযাত্রায় থাকবে ৪০ ফুট দীর্ঘ একটি সাম্পান। এর আশে-পাশে থাকবে হাতি, ঘোড়ার বহর৷ থাকবে সৈন্য-সামন্তও৷ এছাড়া বাংলার বীরত্বকে প্রকাশ করার জন্য থাকবে বাঘের প্রতিকৃতি। বাংলার বিজয়, গৌরব, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি এবারের শোভাযাত্রায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গটিও৷

পুরাতনের সাথে নতুনের সংযোগে সারাদেশে একযোগে পালিত হয় বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। রঙে রঙে রঙিন হয়ে যায় সারা দেশ। শহরের রাস্তায় আকা হয় আল্পনা গ্রামে-গ্রামে মানুষ মেতে উঠে আপন সংস্কৃতিতে। বৈশাখের সকালে পান্তা-ইলিশ যেন আজ চমৎকার একটি অণুষংগ হয়ে গেছে আমদের বাংগালিআনাকে ফুটে তোলার। জিবে জল আনা ইলিশের নানা পদ পহেলা বৈশাখকে করে তোলে অনন্য। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে আদিবাসীরাও পালন করে বৈসাবি উৎসব। নববর্ষের প্রথম দিন ত্রিপুরাদের বৈশুখ, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসব সম্মিলিতভাবে বৈসাবি নামে উদযাপিত হয়।

নববর্ষের অনুসঙ্গ হিসেবে আরও রয়েছে কালবৈশাখী ঝড় এবং বৈশাখী মেলা। বাংলা নববর্ষের মধ্য দিয়েই কালবৈশাখীর সূচনা। সচরাচর এপ্রিল-মে মাসে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ঝড় কালবৈশাখী নামে পরিচিত। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ৩ শতাধিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ১ দিন থেকে মাসব্যাপি এসব মেলায় হা-ডু-ডু, কুস্তি লড়াই, লাঠিয়াল নাচ, পুতুল নচি, সার্কাস, মোরগ লড়াই, ঘুড়ি ওড়ানো, ষাড়ের লড়াইসহ মজার মজার আয়োজন থাকে। একসময় এসব মেলায় জনপ্রিয় অনুসঙ্গ ছিল বায়োস্কোপ বাক্স। কিন্তু এখন এটি আর দেখা যায় না। তবে অনেক জায়গায় পুতুল নাচ, সার্কাসের আয়োজন করা হয়।

বাংলা সন মনে রাখা নিয়ে বেশ জটিলতা দেখা যায়। তবে ইংরেজি সন থেকে বাংলা সনের তারিখ বের করা যায়। পহেলা বৈশাখে প্রাণে টানে আমরা সবাই এক হয়ে যাই। ছোট-বড় ভেদাভেদ ভুলে উন্মোচিত হয় বৃহত্তর চেতনা। এই জেগে ওঠা উন্মেষ এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটুক প্রতিদিন দেশের সব স্থানে সবার হৃদয়ে। সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা!{jcomments on}






Shares