নিয়ম মানতে নয়, ভাঙতে ভালো লাগে :: রিয়াসাদ আজিম
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক দুর এগিয়েছে। শিক্ষার্থীরাও ভাল ফলাফল করছে। শিক্ষার্থীদের মতে, এর পুরো অবদান প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষকদের। শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়ে বলেই ভাল ফলাফল করছে। আর এই প্রাইভেট পড়ার জন্য শিক্ষার্থীরা গ্রাম থেকে ছুটে আসছে শহরে। তাদের কেউ হয় ছাত্রাবাস, না হয় ভাড়া বাড়িতে থাকছেন। প্রাইভেট হয়ে পড়েছে এক বাণিজ্যের নাম। এ যুগের শিক্ষার্থীদের ভাবটা এমন যে, ভাল ফলাফল করতে হলে প্রাইভেট পড়ার কোন বিকল্প নেই। তাদের কাছে প্রাইভেট পড়া এক মজার বিষয়। প্রাইভেটের নাম করে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বন্ধুদের নিয়ে দিব্যি ঘুরা যায়। প্রাইভেট শুরুর আগে অপেক্ষমান সময়টুকুতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা জমে বেশ। প্রাইভেট শেষে ফের বন্ধুদের নিয়ে পার্কে, ফাস্ট ফুডে খোশগল্প, সেলফি তুলার মজাই যেন আলাদা। এই প্রাইভেটের কথা বলে বাসা থেকে বের হওয়া সহজ। বেশি সময় ধরে বাইরে থাকার সুযোগও করে দেয় ‘প্রাইভেট’।
এবার মূল কথায় আসা যাক, সকলেই একটা বিষয়ে জ্ঞাত যে, সারা দেশের সরকারি কলেজগুলোতে যাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয় তারা পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) নিয়ন্ত্রিত দেশের সর্বোচ্চ পরীক্ষা বিসিএস উত্তীর্ণ। এখন প্রশ্ন হলো, বিসিএস উত্তীর্ণদের চেয়ে কি প্রাইভেট পড়ানোতে ব্যস্ত শিক্ষকদের যোগ্যতা বেশি?
যদি তাই না হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা কেন প্রাইভেটের দিকেই কেবল ঝুঁকছে? কেন কলেজের ক্লাসে অংশ নিতে তাদের ভাল লাগে না? কলেজ রেখে ছুটে চলে প্রাইভেটে?
এবার আসি অভিভাবকদের কথায়। তারা সন্তানদের হাতে কেবল খরচের টাকা তুলে দেওয়াটাকেই দায়িত্ব শেষ বলে মনে করেন। মাস শেষে সন্তানের হাতে প্রাইভেটের খরচ বাবদ মোটা অংকের টাকা তুলে দেন। কিন্তু একবারও কি আপনাদের জানতে ইচ্ছে করে না যে, আপনার সন্তান আদৌ কলেজের ক্লাসে অংশ নিচ্ছে কী না? সন্তানকে প্রতিষ্ঠানে পাঠালেই কি হলো? তাদের মনিটরিংয়ের কি কোন দরকার নেই। আপনি কি কখনো একটু সময় করে কলেজে গিয়ে খবর নিয়েছেন, আজ আপনার সন্তান কয়টা ক্লাস করেছে? কয়টায় শুরু হয় ক্লাস আর আপনার সন্তান কলেজে যাচ্ছে কখন? কলেজের কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে কোথায় সময় কাটাচ্ছে? কোথায় যাচ্ছে? কাদের সঙ্গে মিশছে?
কলেজে পুরোদমে ক্লাস চলাকালে পার্কে বসে মোবাইল ফোনে সেলফি তোলায় ব্যস্ত কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয়। তারা জানায়, কলেজে ক্লাস করতে তাদের ভালো লাগেনা। তাদের মতে, কলেজে ক্লাস করে পাশ করা যাবে না। স্যাররা যা পড়ান তা তাদের বোধগম্য হয় না। নিয়মিত ক্লাস না হওয়াসহ আরো নানা অভিযোগ তাদের। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে পড়ালেখার কি হবে জানতে চাইলে তাদের সরল উত্তর, এই তো ভাইয়ার কাছে প্রাইভেট পড়ি। স্যারের ক্লাস ভালো লাগে না ভাইয়ার ক্লাস ভালো লাগে কেন জানতে চাইলে বলে, ভাইয়া অনেক ভালো করে বুঝায়। ভাইয়ার জন্যই তো এসএসসিতে এ প্লাস পেয়েছি।
কলেজের নিয়ম না মেনে ক্লাস চলাকালে অন্যত্র আড্ডা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তাদের সোজা উত্তর, আমরা বড় হয়েছি না। কলেজে পড়ি। এত আইন মেনে কি চলা যায়। এখন আমাদের আনন্দ করার সময়। বন্ধুদের সাথে মজা করার সময়। এত আইন টাইন মানতে ভাল লাগে না। মজা করতে ভালো লাগে। ঘুরতে ভালো লাগে। আর আমরাতো নিয়মিত প্রাইভেট পড়ে কোর্স আদায় করছিই, ফলে ভালো রেজাল্ট তো করবোই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্বনামধন্য একজন সাহিত্যের শিক্ষক আক্ষেপ করে বললেন, আমরা যারা কলেজে পড়াই, তাদের চেয়ে কি প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষকদের যোগ্যতা বেশি। তিনি বিশ্বাস করেন নিয়মিত ক্লাস করলে কোন শিক্ষার্থীকেই প্রাইভেট পড়তে হবে না। শিক্ষকরা একটি ক্লাসে ৪৫ মিনিট সময় পান। ক্লাস শুরুর ৩০ মিনিট পর্যন্ত ক্ষণে ক্ষণে শিক্ষার্থীরা ক্লাশরুমে ঢুকতে থাকে। এতে করে শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নষ্ট হয়। বিলম্ব করে আসার কারণ জানতে চাইলে তারা সেই ‘প্রাইভেট’ এরই অযুহাত দেখায়।
অবশ্য এ অবস্থার জন্য আমি প্রাইভেট বা প্রাইভেট শিক্ষকদের দায়ি করছি না। দায়ি করছি শুধুমাত্র প্রাইভেট নির্ভর হওয়ার অসুস্থ্য মানসিকতাকে। প্রাইভেট আমরা পড়বো, কিন্তু কলেজের ক্লাসে নিয়মিত অংশ নিয়ে বাকি যে সময় হাতে থাকবে সে সময়টুকুতে আরও ভাল বোঝার জন্য প্রাইভেটের শরণাপন্ন হবো।
সবশেষে বলতে হয়, এখনো আমাদের সমাজে এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যাদের প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য নেই। তবে কি তারা ভালো রেজাল্ট করে না?