Main Menu

নয়নের মাঝখানে সাইফুল … আবুল খায়ের টিটু

+100%-

পুরো নাম মো. সাইফুল ইসলাম রিপন। আমরা ব্যাচম্যাটরা সাইফুল নামেই ডাকতাম। হ্যা, ডাকতাম। সাইফুল নেই আজ এক বছর হল। গত বছর ১৯ অক্টোবর চলে চিরতরে চলে যায় বন্ধু আমার। বন্ধুবিয়োগে কীভাবে শোকগাথা লিখতে হয় আমার জানা নেই। কিন্তু আমার বয়সী কোন বন্ধুবিয়োগ মেনে নেয়া, বিশ্বাস করা অত্যন্ত কঠিন। অবেলার সকল মৃত্যুই মেনে নেয়া কঠিন। সে কারণে সাইফুলের চলে যাওয়ার এক বছর পরও তার চলে যাওয়া আমার কাছে অবিশ্বাস্যই ঠেকে।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে সাইফুলের সাথে আমরা ইংরেজি বিভাগে পড়তাম। সে থেকে পরিচয়। বন্ধুত্ব। নিপাট ভদ্র ছেলে সাইফুল ছিল বন্ধু অন্তপ্রাণ। আমরাও কম জ্বালাতাম না। সাইফুলের আব্বা একজন পোস্ট মাস্টার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত)। সে সূত্রে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন পোস্ট অফিসে চাকুরি করেছেন। যখন যেখানে চাকুরি করেছেন, বন্ধুরা সবাই গিয়ে চমকের নামে যন্ত্রণা দিয়েছি সাইফুলকে, তার পরিবারকে। কিন্তু কখনোই বিরক্ত হয়নি।

আমাদের অনার্স পড়াকালীন যে কজন কম্পিউটারে দক্ষ ছিল সাইফুল তাদের অন্যতম। তাই কম্পিউটারের কোন সমস্যা হলে সে সমাধানের দায়িত্ব সাইফুলের। ইংরেজি বিভাগে পড়াকালীন একটি সংকলিত বই প্রকাশের কাজে হাত দেন শ্রদ্ধেয় মাহবুব স্যার। সেই বই কম্পোজ এবং ছাপার কাজ অতি আনন্দের সাথে করেছিল সাইফুল। আমরা ঘুরাঘুরি করতে পছন্দ করতাম। সাইফুলও। ক্রিকেট খেলা পছন্দ করতাম। সেতো রীতিমতো তারকা খেলোয়াড়। বিভাগের শিক্ষা সফরে আমরা গিয়েছিলাম সোনারগাঁও হয়ে ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে। সাইফুল ছিল আমাদের সাথে। সাইফুলের ইয়াসিকা ক্যামেরাতেই কনিকা রীলে আমরা ছবি তুলেছিলাম। সেই নেগেটিভ থেকে আমরা সবাই ছবি বানিয়েছিলাম।

অনার্স শেষ করে সাইফুল চলে গেল ঢাকায়। ঢাকায় গিয়ে সে ব্যবসা প্রশাসন নিয়ে পড়াশোনা করে। পরবর্তীতে আইন বিষয়েও পড়াশোনা করে এডভোকেট পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়। ঢাকায় যাওয়ার পর থেকে নিয়মিত যোগাযোগটা কমে গেল। অনেকদিন, অনেকবার ফোন দিয়েও তাঁকে পাওয়া যেতনা। হঠাৎ একদিন পেয়ে যেতাম। কথা শেষ হতনা। আমি কুমিল্লায় পড়া শেষে ঢাকা হয়ে লন্ডন। সেখান থেকে ফিরে ফেনীতে চাকুরি শুরুর পর আবার যোগাযোগ নিয়মিত হয় সাইফুলের সাথে। তখন সে থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।

কুমিল্লার মোগলটুলীর আনছারিয়া রেস্তোরাঁয় আমাদের বন্ধুদের একটি ইফতার আয়োজন হয় প্রতি রোজায়। নিরুদ্দেশ বন্ধুকে কাছে পেলে সবার ভাল লাগবে এ বিশ্বাসে সাইফুলকে বললাম একবার আসাতে। ২০১৬ সালের ইফতারে সাইফুল উপস্থিত হয়ে সবাইকে চমক দিয়েছিল। ঠিক যেমনটা আমরা দিতাম তাঁর বাসায় উপস্থিত হয়ে। তাঁকে পেয়ে সবার কি উচ্ছ্বাস! গল্প যেন শেষ হয়না। যোগাযোগ কেন নিয়মিত নয়, এ অনুযোগ শুনতে শুনতে সাইফুল ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। নিয়মিত হবে এমন কথা দিয়েই বিদায় নিয়েছিল।

শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ জনপদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাইফুলের সৃজনশীল কাজের চর্চা ও বিকাশ। নিয়মিত ছড়া লেখা, মঞ্চে আবৃত্তি ও অভিনয় করা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমিসহ অন্যান্য সংগঠনে কাজ করা ছিল তার পেশাগত কাজের বাইরে ব্যস্ততা। তাঁর শখের মধ্যে আরো ছিল বিভিন্ন দেশের মুদ্রা সংগ্রহ করা, মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশিত আলোকচিত্র সংগ্রহ করা, পুঁতি দিয়ে ছবি আঁকা, বাংলা লেখকদের প্রথম গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের কপি সংগ্রহ করা, বাজারশূণ্য হয়ে যাওয়া গ্রন্থ সংগ্রহ করা, লিটল ম্যাগাজিন বের করা ইত্যাদি। আমাকে বহুবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমি আয়োজিত সাত দিনব্যাপী বৈশাখী উৎসবে অংশ নিতে। কিন্তু একই সময়ে আমার পেশাগত এবং সাংগঠনিক ব্যস্ততা থাকায় কখনো যেতে পারিনি সে উৎসবে। না যেতে পারার এ ব্যর্থতা- বেদনাটা আরো বাড়িয়ে দেয়। প্রতি বছর আয়োজনে কী কী থাকছে, কারা অতিথি থাকছেন সবই আমার সাথে শেয়ার করত। তার মুখ থেকে শুনেই পরিচিত হয়েছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রথিতযশা সংগঠক কবি জয়দুল হোসেন, লেখক মানবর্দ্ধন পাল, কবি দেবব্রত সেনসহ কয়েকটি নামের সাথে। দূর থেকে হয়েছিলাম সাহিত্য একাডেমির একজন অনুসারী, ভক্ত।

আমাদের সর্বশেষ আলাপে ছিল দেশে ফিরলে কুমিল্লা ও ফেনীতে মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র প্রদর্শনী করবো। সর্বশেষ আলাপে স্বাস্থ্যের অবনতি নিয়ে বলেছিল। সুইডেন থেকে মুদ্রা এবং ইংরেজি অনুদিত ছড়ার বই চেয়েছিল। নেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু তা আর হলনা। হবেও না কোনদিন। বহুমাত্রিক প্রতিভাবান এ ছড়াকার সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ করতে করতে হয়তো স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হতে পারেনি। সাথে ছিল ভুল চিকিৎসার ধকল। তাই অকালে তাঁকে হারিয়েছি আমরা। পরিবারের এ অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার কোন সুযোগ নেই। দেশে গিয়ে তাঁর রাজপুত্র ছেলে আরাতকে দেখতে গিয়েছিলাম। অল্পবয়সী স্ত্রী মৌনি ভাবীর মুখে সাইফুলের শেষ বেলার সংগ্রাম এর কথা শুনে এসেছি। অনুভব করেছি ভাবীর সংগ্রামের কথাও। সাইফুলের অসুস্থ বাবার সাথেও কথা হয়েছে। শুধু সাইফুলকে দেখিনি। সাইফুল নেই, আবার সাইফুল চারপাশেই বিরাজমান। “নয়নসম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই”। সাইফুলের বেলায়ও তাই। সাইফুলে অবর্তমানে তাঁর কাজগুলো তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে আরো কিছুকাল। তাই পরিবার ও বন্ধুরা মিলে আমরা সবাই সাইফুলের সৃজনশীল কাজগুলোর যদি একটি সংকলন প্রকাশ করতে পারি, তাহলে হয়তো তাঁর কাজগুলো বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচবে। অনুপ্রেরণা দিবে উত্তর প্রজন্মকে।

প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে অনেক অনেক প্রীতি ও দোয়া সাইফুল। পরপারে ভাল থাকিস।
মিস য়্যু বন্ধু।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক (সুইডেনে শিক্ষা ছুটিরত), ফেনী ইউনিভার্সিটি। ইমেইল: khayert2@gmail.com.






Shares