আমি একটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া_রাজীব নূর



‘এখন কাউকে গালি দিতে ইচ্ছা করলে বলা যাবে- তুই একটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া!’ এটা এক সাংবাদিকের ফেসবুক পোস্ট। এরই মধ্যে তিনি পোস্টটি প্রত্যাহার করে ক্ষমা চেয়েছেন। আমি ওই সাংবাদিক বড় ভাইয়ের পোস্টে মন্তব্য করে লিখেছিলাম, ‘আপনি যদি আমাকে ভালোবাসা জানাতে চান তখনো আমি একটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া।’
উত্তরে তিনি ভালোবাসা জানিয়েছেন। আসলে বিষয়টা ভালোবাসা-মন্দবাসার মতো তুচ্ছ আলোচনার নয়। এমন কী ক্ষমা প্রার্থনায় তেমন কিছু যায় আসে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাংলাদেশের কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়।
বহুব্রীহি নাটকে এক টিয়ের ঠোঁটে ‘তুই রাজাকার’ শব্দগুচ্ছ বলিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। প্রয়াত এই কথাশিল্পীর সেই নাটুকে সংলাপ নাটক প্রচারের অনেক দিন পরে হয়ে উঠেছিল গণজাগরণের কালজয়ী স্লোগান। রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে চলা আন্দোলনের প্রধান প্রাণশক্তি ছিল এই স্লোগান। দেশের কোটি মানুষের কণ্ঠেও তখন সবচেয়ে বেশি ধ্বনিত হয়েছে ‘তুই রাজাকার’ শব্দগুচ্ছ।
রাজাকারকে ‘তুই রাজাকার’ বলার মতো ‘তুই ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ বলে গালি দেওয়া যায় না। যাকে রাজাকার বলা হলো এবং তিনি রাজাকার না হন, অভিযোগ খণ্ডনের চেষ্টা করবেন। আমার তা খণ্ডনের সুযোগ নেই, ইচ্ছেও নেই। ‘তুই ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ যদি দেশের মানুষের কাছে গালি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, তাহলে আমি ধরে নেব এ আমার জন্মের গ্লানি। রাজাকার একটা বাহিনী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সব কয়টা দালাল বাহিনীকে আমরা এক শব্দে রাজাকার বলি। ওই অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যুক্ত হয়েছিলেন, যারা বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের বহুকাল আগে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। আমরা যারা ‘তুই ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ বলে অভিহিত হচ্ছি, তারা সেখানে নিজের ইচ্ছায় জন্ম নিইনি। না, বাউনবাইরায় জন্ম নিয়েছি বলে আমি গ্লানিবোধ করি না। আমি গর্বিত আমার জন্ম বাউনবাইরা, আমার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, আমি ‘একটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া’।
আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই নিঃশ্বাসের প্রথম বায়ুটুকু নিয়েছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ে লড়াই শুরু করা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁকে কুমিল্লা শহরের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। আরো আগে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত। এক সরাইলেরই কত নাম বলা যায়। সরাইল পরগণার ইতিহাস তো একদা সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে পরিচিতি পেয়েছিল যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার থেকেও প্রাচীন। এখানে বাংলার বারো ভূঁইয়ার শীর্ষস্থানীয় ঈসা খাঁ জন্ম নিয়েছিলেন। সেদিন এই সরাইলেই লকডাউন ভেঙে এক মাওলানার জানাজা পড়তে এসেছিলেন লাখো মানুষ। পূর্ব পুরুষের গৌরব গাঁথা গেয়ে এই অপরাধের দায়মোচন হবে না। তবে জানিয়ে রাখা ভালো ওই জানাজার লাখো মানুষের জমায়েতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশপাশের অন্তত সাতটি জেলার মানুষ, বিশেষ করে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক জমায়েত হয়েছিলেন। ঢাকা থেকে অন্তত ডজনখানেক খেলাফত মজলিস নেতা উপস্থিত হয়েছিলেন।
জানাজায় অংশ নিতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা, সিলেটের বিয়ানীবাজার থেকেও লোক এসেছিলেন। বিয়ানীবাজার থেকে আদৌ কেউ এসেছিলেন কিনা জানা নেই আমার। ইচ্ছে করেই লিখলাম, সেখানকার এক স্থপতি ও লেখকের লেখা পড়ার পর মনে হয়েছিল, তাকে জিজ্ঞেস করি মাওলানা আনসারীর বাড়ি, সরাইল না হয়ে বিয়ানীবাজার হলে জানাজার ভিড়টা কি কম হতো? মাওলানা জুবায়ের আহমেদ আনসারী খেলাফত মজলিস নামে যে সংগঠনের সিনিয়র নায়েবে আমির ছিলেন, কাল যদি ওই পর্যায়ের কেউ বিয়ানীবাজার কিংবা বরগুনায় মারা যান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আনসারীর জানাজায় অংশগ্রহণকারীরা যে একটি সংগঠিত শক্তি এবং শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই এই সংগঠনের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মে সরাইলে আনসারীর জানাজা হলো, তার পাশের উপজেলা নাসিরনগরে তাঁর জন্ম।
১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে ইসলামী ঐক্য জোটের প্রার্থী হয়েছিলেন এই মাওলানা জোবায়ের আহমেদ আনসারী। মিনার মার্কা নিয়ে নির্বাচন করে ১৬৬৮ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছিলেন তিনি। ওই আসনে তখন মোট ভোট ছিল এক লাখ ২১ হাজার ১০৫ টি, প্রদত্ত ভোট ৯১ হাজার ৫৫৬।
বিষবৃক্ষ তো রোপণ করা হয়েছিল সত্তরের নির্বাচনেই। সরাইল আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ শেখ আবু হামেদকে বাদ দিয়ে এলাকায় তখন পর্যন্ত আগন্তুকপ্রায় তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। এই ঠাকুর হলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার একজন কুশীলব। পরে বারবার নির্বাচনে জামানত হারানো ফজলুল হক আমিনী বিএনপির সঙ্গে জোট করে ২০০১ সালে এখান থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সরাইল ও নাসিরনগরে আমিনী ও আনসারীর খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা কোনো কালেই ছিল না। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামানত হারানো এই আনসারীর জানাজায় আকস্মিক লাখো মানুষের জমায়েত হয়ে গেল, আর প্রশাসন বুঝতেই পারল না, এটা একটা আষাঢ়ে গল্প। নিশ্চয়ই তার একটা প্রস্তুতি ছিল। তাই জানা দরকার ভৈরব, মাধবপুর, কুমিল্লা পার হয়ে কীভাবে সরাইল-আশুগঞ্জে এত লোক এলেন?
আমার বন্ধু কথিত কাঁটাতারের বেড়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘিরে রাখা গেলে এই জানাজায় এমন লাখো মানুষের জমায়েত হতো না। আরে ভাই এই সব কল্পিত বেড়া আপনাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতাকেই প্রকট করে। এতকাল ধরে যে দেশে একটা এককেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়নি, বরং ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মান্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার স্বীকৃতি দেয়, তখন তো মৌলবাদের উত্থান ঘটবেই।
মানছি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাদের উত্থান বেশি হয়েছে, কিন্তু নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়? ব্রাহ্মণবাড়িয়াও একদিনে এমন হয়নি।
১৯৮৭ সালে ভাদুঘর গ্রামে রিজভী-ওহাবি সংঘাত দিয়ে কওমি মাদ্রাসা-নির্ভর ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির উত্থান হয়।
ওই সময় পৌর এলাকার গ্রামটিতে অনেকগুলো বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই স্মৃতি এখনো গভীর বেদনার মতো বাজে আমার বুকে। সেই শুরু। আমরা ব্যর্থ হয়েছি এবং ব্যর্থতার গ্লানি নিয়েই বলি ‘আমি একটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া’।
লেখক সাংবাদিক