নভেম্বরে চার হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা! সার্টিফিকেট মামলার পলাতক আসামি ২ লাখ কৃষক
সদ্য বিদায়ী ২০১৩ সনের শেষ সময়ে ৭০ দিন হরতাল ও অবরোধের মুখে পড়ে দেশ। ২০১৩ ঈসায়ী সনের নভেম্বর মাসে কৃষক আমন কাটা শুরু করে। কৃষকের ধারণা ছিল আমনের দাম বাড়বে। কিন্তু টানা অবরোধ ও হরতালের কারণে ধানের দাম কমে আসে মণপ্রতি ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকায়। যদিও এ বছর ১০ শতাংশ বেশি আমন উৎপাদন হয়েছে। অবরোধের কারণে কমপক্ষে ১ কোটি কৃষক পরিবার আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়বে। এসব কৃষকের মধ্যে অনেকে ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু পণ্য বিক্রি করতে না পারায় বা লোকসানের কারণে ব্যাংকের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন।
কুষ্টিয়ার পোড়াদহের কৃষক মোশাররফ হোসেনের মতে, শীতের সবজি উৎপাদনের পর বিক্রি করা যাচ্ছে না। ঢাকায় নেয়ার ব্যবস্থা নেই। অবরোধ চলছে। উৎপাদন খরচের ৫০ ভাগও দাম পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেক কৃষক লোকসানের মুখে পড়ে ঋণখেলাপি হচ্ছেন। ২০১৩ ঈসায়ী সনের শুধু নভেম্বর মাসেই ঋণের টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ৪ হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি ব্যাংক মামলা করেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও অনির্দিষ্টকালের অবরোধে চরম লোকসানে পড়ে এসব কৃষক খেলাপি ঋণের তালিকায় চলে আসেন। ঋণের টাকা ফেরত না পেয়ে ব্যাংকগুলো তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিচ্ছে।
আরও জানা গেছে, উৎপাদনের আগে সার পাওয়া যাচ্ছে না। সময় মতো সারের অভাবে পণ্যের উৎপাদন কম হচ্ছে। সবমিলে চরম লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। অন্যদিকে নির্ধারিত সময়ে ব্যাংকগুলো টাকা ফেরত না পেয়ে মামলা করছে। কৃষকের লোকসান হলে তিনি কিভাবে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করবেন- এমন প্রশ্ন রাখেন মোশাররফ। কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের একটি প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শুধু নভেম্বর মাসে কৃষকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মামলা করার সংখ্যা হচ্ছে ১৫৬১টি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে ১০৬১ কৃষকের বিরুদ্ধে। অপরদিকে অগ্রণী ব্যাংকের পক্ষ থেকে করা হয় ৯৬৭টি মামলা এবং জনতা ও সোনালী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকগুলোও সাধারণ কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিছুদিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার পালশা গ্রামের বর্গাচাষী আজিজার রহমান (৬০) ১০ হাজার টাকা ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে না পারায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।
জানা গেছে, আজিজার আলু চাষের জন্য ১২ বছর আগে উপজেলার জনতা ব্যাংক জামালগঞ্জ শাখা থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সে বছর আলুর দর কম থাকায় চাষাবাদের খরচ তুলতে পারেননি তিনি। এরপর অভাব-অনটনের কারণে ব্যাংকের ঋণ আর পরিশোধ করতে পারেননি। সেই টাকা সালে সুদাসলে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৭০৩ টাকায়। এই টাকার জন্য জনতা ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক তার বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করে। আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
অপরদিকে অভিনব পদ্ধতিতে পার পেয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রভাবশালী ও বিত্তশালী ঋণখেলাপিরা। ব্যাংকারদের যোগসাজশে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ঋণ সমন্বয় করার পাশাপাশি খেলাপিরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছে। তারা আদালতে রিট করে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের নাম স্থগিত করিয়ে নিচ্ছে। এ সুবাদে তারা ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ নিয়মাচারকে পাশ কাটিয়ে অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণের সুযোগ নিচ্ছে। শুধু এটিই নয়, শত শত কোটি টাকার ঋণ পরিশোধের দায় থেকেও তারা নিজেদের মুক্ত রাখতে সক্ষম হচ্ছে। এভাবে ৩৩৬ বড় খেলাপি ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হওয়া থেকে অব্যাহতি পেয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। চোখের সামনে ঋণশৃঙ্খলা ধ্বংস হলেও কিছুই করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি আদালত সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে।
ব্যাংকারেরা বলেছে, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়েছে। আদালত ব্যাংকের পক্ষে রায় দেয়ার পরেও খেলাপিরা উচ্চ আদালতে রিট করছে। ফলে ব্যাংক প্রাথমিকভাবে রায় পেলেও খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। আবার সিভিল আটকাদেশ আইনের ৩৪ ধারা অনুযায়ী ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে আটকাদেশ দেয়ার পরেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তা যথাযথভাবে কার্যকর করছে না। এ ছাড়া আইনগত জটিলতার কারণে বন্ধকী সম্পত্তির স¦ত্ব ব্যাংকের অনুকূলে ন্যস্ত করা যাচ্ছে না। এর ফলে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক কাঙ্খিত হারে সফলতার মুখ দেখছে না।
কিন্তু মামলার জালে আটকা পড়েছে সারাদেশের ২ লাখ কৃষক। কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, কৃষি শ্রমিকের দুষ্প্রাপ্যতা, উৎপাদন খরচ জোগাড়ে কৃষকের অবস্থা এমনিতেই বেশ খারাপ। এ সময় সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা কৃষি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে।
বলাবাহুল্য, একই দেশে এ বৈষম্যের প্রতি আমরা তীব্র প্রতিবাদ করছি। ১০ হাজার টাকার কৃষকের ঋণী কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা হবে, ওয়ারেন্ট বের হবে আর কৃষক পালিয়ে বেড়াবে অপরদিকে একই দেশে হাজার হাজার কোটি ঋণ খেলাপি শুধু নয় বরং লোপাটকারীরাও পার পেয়ে যাবে এমনকি উল্টো নতুন করে ঋণ পাবে দেশে এ বৈষম্য কী করে বরদাশত করা যায়?
প্রতিভাত হয় সরকার জনগণের সরকার নয়। সরকার প্রভাবশালী, বিত্তশালী, দলীয় রাজনৈতিক সরকার। সরকার সংবিধান লঙ্ঘনকারী সরকার। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সরকার সংবিধান পালন করেনা। ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার তাদের নেই। একথা সরকারকেও উপলব্ধি করতে হবে। জনগণকেও জনসচেতন হতে হবে।