Main Menu

টর্নেডোয় নিহত ২৩, সবকিছু হারিয়ে হতবিহব্বল, খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন

+100%-

মনিরুজ্জামান পলাশ : শুক্রবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টর্নেডোর তান্ডবে লন্ড ভন্ড হয়ে যাওয়া গ্রামের মানুষ সব কিছু হারিয়ে হতবিহব্বল হয়ে পড়েছে। শনিবার সকালে সদর উপজেলার চিনাইর গ্রামে একটি বাঁশ ঝাড় থেকে এক মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়। এনিয়ে মৃতের সংখ্যা ২৩-এ দাঁড়িয়েছে। বিধ্বস্ত এলাকার মানুষ ঘর বাড়ি সহায় সম্বল হারিয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর বসবাস করছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত ও আহতদের পরিবারকে সহযোগিতার ঘোষনা দিলেও এখনো বেশির ভাগ এলাকায় সরকারী সাহায্য পৌছেনি বলে জানিয়েছে ক্ষতিগ্রস্তরা। টর্নেডো বিধ্বস্ত এলাকার গ্রামগুলোর মানুষ বিভিন্ন স্থানে তাদের ঘর ও আসবাবপত্রের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছে। বিধ্বস্ত গ্রামগুলোতে একদিকে চলছে স্বজন হারানোর বেদনা অন্যদিকে সহায় সম্বল হারিয়ে স্তম্বিত। ক্ষতিগ্রস্থদের আর্তনাতে এলাকার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। সকলেই যেন স্বান্তনা দেবার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। ১৪-১৫ মিনিট স্থায়ী টর্ণেডোতে জান মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে কি পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তা এখনও নিরূপন করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরসহ ৩টি উপজেলার প্রায় ২১টি গ্রাম টর্ণেডোর তান্ডবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সর্বত্রই ধ্বংস ও ক্ষতের চিহ্ন। গ্রামগুলো হচ্ছে সদর উপজেলার রামরাইল, উরশিউড়া, জারুলতলা, ভাতশালা, পাতিহাতা, পাইকপাড়া, চিনাইর, চান্দি, সোহাতা, বাসুদেব, খেউয়াই, ফুলবাড়িয়া, চান্দপুর, কোড্ডা, বিজয়নগর উপজেলার সিংগারবিল, পত্তন এবং আখাউড়া উপজেলার আমোদাবাদ গ্রাম।

 

 

ক্ষতিগ্রস্থ বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের অনেক বসত বাড়ি ঘর টর্নেডোর তান্ডবে মাটির সাথে মিশে গেছে। লন্ড ভন্ড হয়ে পড়ে রয়েছে গাছপালা, বিদ্যুতের খুঁটি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে ঘরের ব্যবহার্য আসবাবপত্র। গ্রামের অসংখ্য গবাদি পশুর মৃত দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। গ্রামের সংযোগ সড়কগুলোতে গাছ পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। গ্রামগুলোতে চলছে হাহাকার। পরিবারগুলোতে চলছে কান্নার রোল। এদিকে অধিকাংশ পরিবার তাদের একমাত্র আবাসস্থল হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছে। অবস্থান করছে খোলা আকাশের নিচে।

সরজিমনে গিয়ে দেখা যায়, যে দিকে দিয়ে টর্নেডোর তান্ডব বয়ে গেছে সে দিকের পিচের সড়কগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। গ্রামের রাস্তার উপর পড়ে রয়েছে বৈদ্যুতিক তার। চিনাইর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ৩৩ হাজার কেভি ভোল্টের বিদ্যুতের তার ছিড়ে আছড়ে পড়ে আছে। ৪টি পুকুরের মাছ মরে ভেসে উঠেছে। একটি ট্রান্সফরমার বিদ্যুতের খুঁটিসহ ভেঙ্গে পড়ে আছে। শুধুমাত্র চিনাইর গ্রামেরই ৪জনের মৃত্যু হয়েছে।

জনৈক আনোয়ার মিয়ার বিল্ডিংয়ের দোতলার ছাদ টর্ণেডোর আঘাতে কমপক্ষে ৩’শ গজ দূরে আছড়ে পড়েছে।

গ্রামের মুক্তার হোসেন জানান, বিকেলে বাজারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি আকাশে আগুনের কুন্ড ধেয়ে আসছে। কিছুনের মধ্যে তা বিধবংসী রূপ ধারন করে এলাকায় আঘাত হানে।

প্রত্যদর্শী উরশিউড়া গ্রামের মোঃ সালেক মিয়া জানান, জেলা কারাগারের পশ্চিম প্রান্তে আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার দূরবর্তী সদর উপজেলার বার আউলিয়া বিল থেকে বিকেলে এর উৎপত্তি হয়ে মুহুর্তের মধ্যে প্রচন্ড শক্তি ধারন করে। প্রায় ৫’শ ফুট প্রশস্ত হয়ে এটি দ্রুত গতিতে পূর্ব দিকের গ্রামগুলোর উপর আঘাত হানে।

ভাতশালা গ্রামের কৃষক মোজাম্মেল জানান, বোরো ধানের একরের পর একর ধানী জমি টর্নেডোর আগুনের তাপে পুড়ে গেছে। পাশপাপাশি গ্রামের বেশির ভাগ বাঁশের ঝাড় আগুনের তাপে জ্বলে গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ভাদেশ্বরা গ্রামের আবু তাহের জানান, বিকেলে সে হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দ শুনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আগুনের ঘূর্ণিয়মান আগুনের কুন্ড দেখতে পায়। সে আরো জানায়, এসময় বিভিন্ন বাড়ি ঘরের টিনের চাল, বেড়া, গাছপালাসহ আসবাবপত্র আকাশে পাখির মত উড়তে থাকে। তখন গ্রামের মানুষ আশ্রয়ের জন্য দিকবেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। এ ঘটনার পর থেকে আশপাশ এলাকার লোকজন ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামগুলোর সহায়তায় এগিয়ে আসে। তারা উদ্ধার তৎপরতার পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে সাধ্য অনুযায়ী খাবার, কাপড় ও ওষুধের সরবরাহ করছে। এদিকে চিনাইর আব্দুর রউফ কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে ১০টি পরিবার শুক্রবার রাতেই অবস্থান নেয়।

টণের্ডোতে নিহতরা হচ্ছেন সুলতানপুরের উরশিউরা গ্রামের ডলি, রানী দে (৩০), পাতিরহাতা গ্রামের লাভলী বেগম (৩০), চিনাইর গ্রামের লালু চৌধুরী (৬৫), আঙ্গুরা বেগম (৫৮), হুসনা বেগম (৬২) রোকেয়া বেগম (৫৫), আমেনা বেগম (৪২), শিশু মায়েশা (২ মাস), ভাতশালা গ্রামের আজমল মোল্লা (৩৬), মাহমুদুল হক (৪২), এমদাদুল মোল্লা (৩৯) কবীর (৩৫), কোড্ডা গ্রামের রানা মিয়া (২২), চান্দি গ্রামের ফজলু মিয়া (৭০), তাজুল ইসলাম (৫০), দোবলা গ্রামের নাজমা বেগম (২৫), রামরাইলের আবু তাহের (৬৫), জেলা কারাগার রক্ষী মাকসুদুল আলম (২৯), নিলা আক্তার (১৬) ইয়াছমিন (৩২), অজ্ঞাত শিশু (০২ বছর), পত্তন গ্রামের বাবলী বেগম (২১)। অন্যদিকে টর্ণেডোতে গুরুতর আহত শতাধিক ঢাকা, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে প্রেরন করা হয়েছে।

শনিবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অবঃ) এবিএম তাজুল ইসলাম এমপি, আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপি ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র, আ, ম, উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী এমপি, দূর্যোগ ও ত্রান ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাউল আলম, মহাপরিচালক আব্দুল ওয়াজেদ, বিজিবি’র কুমিল্লা সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল একেএম সাইফুল ইসলাম ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।

এদিকে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা তিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন এবং ত্রান সহায়তা প্রদান করছেন।

এদিকে কুমিল্লা সেনাবাহিনীর ২টি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’র ১টি, জেলা পুলিশের ১টি, সিভিল সার্জনের ২টিসহ ৬টি মেডিকেল টিম তিগ্রস্থ এলাকায় চিকিৎসা কাজে সহায়তা করছে।

ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারদের মধ্যে সরকারী ভাবে প্রত্যেক মৃত ব্যক্তিকে ২০ হাজার টাকা, আহতদের ৬ হাজার টাকা, ২ বান্ডিল টিন, ক্ষতিগ্রস্থ ৫’শ পরিবারের মধ্যে ৩০ কেজি করে চাউল দেয়া হচ্ছে। সরকারী হিসেবে আহতের সংখ্যা ৩’শ। জেলা বিএনপির সহ সভাপতি ও সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামল প্রত্যেক নিহত পরিবারকে নগদ ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করেন।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সর্ম্পকিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি র, আ, ম, উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী এমপি, আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ও সদর হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। দূর্যোগ ও ত্রান ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাউল আলম, মহাপরিচালক আব্দুল ওয়াজেদও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এদিকে বিকেলে জেলা প্রশাসক সম্মেল কে জেলা দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।






Shares