Main Menu

জেলা পরিষদ নির্বাচন : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১০ কোটি টাকার ভোট বাণিজ্য

+100%-

এক ভোট দুই লাখ টাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট কেনাবেচার সর্বোচ্চ রেট। আর এটি উঠেছে সরাইলে। সেখানে ৪ সদস্য প্রার্থী পাল্লা দিয়ে ভোট কিনেছেন। সাধারণ সদস্য প্রার্থী কয়েকজনের খরচ কোটি টাকা। ৫০ লাখ টাকা খরচ করেছেন আরও বেশ কয়েকজন প্রার্থী। নারী সদস্য প্রার্থীরাও কম যাননি। ভোটের লড়াইয়ে তাদেরও খরচ করতে হয়েছে ৪০/৪৫ লাখ টাকা। এর বাইরে কোনো কোনো প্রার্থী এলাকার প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি, নেতাদেরও টাকা দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারের খরচাপাতি এই হিসাবের বাইরে।

ভোট বাণিজ্যের এ বিষয়টিকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।

তিনি বলেন- প্রত্যেকটি স্থানীয় সরকার পরিষদ ওই নির্দিষ্ট স্থানে শাসনকার্য পরিচালনা করার কথা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলো যখন এভাবে ধ্বংস হয় তখন আর এর গ্রহণযোগ্যতা থাকে না, বিশ্বাসযোগ্যতাও থাকে না। এমনকি জনকল্যাণে তারা কোনো ভূমিকা রাখবে- সেটা আশা করা যায় না। এটাতে পরিবর্তন না এনে আমরা নির্বাচনী বাণিজ্য করার সুযোগ তৈরি করে দিলাম।
প্রার্থীর যোগ্যতা, ইমেজ, শিক্ষা-দীক্ষা, সর্বোপরি দায়িত্ব পালনে কতোটুকু সক্ষম,এসব কিছুর মূল্যায়ন না করে টাকার অঙ্ক বিচারে রায় দিয়েছেন ভোটাররা। বিশেষ করে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা নীতি- নৈতিকতার ধার না ধেরে যতজন প্রার্থী ততজনের কাছ থেকেই চুক্তি করে টাকা নিয়েছেন। এমনকি কসম খেয়ে টাকা নিয়েও ভোট দেননি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে ৫৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সোমবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে এই জেলায় ১০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়েছেন চেয়ারম্যান- মেম্বাররা। মোট কথা যত প্রার্থী তাদের দুয়ারে ধরনা দিয়েছেন সবার কাছ থেকেই টাকা রেখেছেন। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ২০/৩০ জন। আনুমানিক এক হিসাবে দেখা গেছে, নির্বাচনের ১৩৮২ ভোটার ২ চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে গড়পড়তায় ১০ হাজার করে ২০ হাজার টাকা পেয়েছেন। আর ৫৬ সদস্য প্রার্থীর কাছ থেকে একেকজন কামিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা করে।

তবে সরাইল উপজেলার ভোট বাণিজ্য রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এটি জেলা পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ড। এখানে সাধারণ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৬ জন। এরমধ্যে ৪ প্রার্থী পাল্লা দিয়ে টাকা উড়িয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩ জন কোটি টাকার ঘর ছুঁয়েছেন। একজন এক লাখ টাকায় ভোট কিনলে আরেকজন দিয়েছেন দেড় লাখ টাকা। সবশেষ দু’লাখ টাকা দিয়েও ভোট কিনেছেন এক প্রার্থী। আলোচনা ছড়িয়েছে কোটি টাকার বিনিময়ে এই প্রার্থীদের কেউ ১৬/১৭ ভোট পেয়েছেন। সে হিসেবে একেকটি ভোটের মূল্য পড়েছে প্রায় ৫ লাখ টাকা। এখানে জয়ী হয়েছেন পায়েল হোসেন মৃধা। তার প্রাপ্ত ভোট ৩৭। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মোহাম্মদ জাকির হোসেন পেয়েছেন ৩৩ ভোট। বিজয়ী পায়েল হোসেন মৃধা দাবি করেন-এত টাকা খরচ করার সামর্থ্য তার নেই। সবার কাছে শুনেছি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা অনেক টাকা খরচ করেছেন। সরাইলের নোয়াগাঁও ইউনিয়নে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের এক নারী সদস্য প্রার্থীর কাছে প্রতি ভোটের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দাবি করেন সেখানকার ৯ জন ইউপি সদস্য। ভোট বিক্রির টাকার অঙ্ক সাব্যস্তকারী ওই ইউনিয়নের ৫ নম্বর সদস্য ফারুক মিয়া বলেন, টাকার চিন্তা করে কী ভোট দেয়া যাইবো। ২০ হাজার টাকা করে চাইছি এর কোনো প্রমাণ নাই। এর আগে ওই প্রার্থীকে এক হোটেলে বসিয়ে সাড়ে ৫ হাজার টাকার খাবার খান ওই ইউপি সদস্যরা। এক হাজার টাকার ৬টি নোট বিল পরিশোধের জন্য দিলে ফেরত ৫’শ টাকা ক্যাশ থেকে নিয়ে যান ভোটার এক ইউপি সদস্য। এরপর প্রার্থীর কাছে গাড়ি ভাড়া দাবি করেন বাড়ি যাওয়ার।

নাসিরনগর উপজেলা জেলা পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ড। এখানে ভোটার সংখ্যা ১৭২। এক সদস্য প্রার্থী জানান, এই ভোটারদের মধ্যে ১৩৫ জনকে তিনি ৫ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। তাদের সবাই ভোট দেয়ার কসম খেয়ে টাকা নেন। কিন্তু ভোটে ফল হয়েছে অন্যরকম। কসমখোররা কেউই তাকে ভোট দেয়নি। বুড়িশ্বর ইউনিয়নের সদস্য আবদুল লতিফ তার নিজের এবং বাকি ৮ সদস্য প্রার্থীর ভোটের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দাবি করেন প্রার্থীদের কাছে। তবে আবদুল লতিফ বলেন, টাকা ছাড়াই ভোট দিয়া দিছি। তবে এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে ১ হাজার টাকা পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন। ফান্দাউক ইউনিয়নের এরা বেশি কামাইছে বলে জানান লতিফ। তাদের কেউ ১০ হাজার, কেউ ১৫ হাজার টাকা করে পাইছে।

সংরক্ষিত ১ নং ওয়ার্ডের (আশুগঞ্জ, সরাইল ও নাসিরনগর) একজন নারী সদস্য প্রার্থী জানান, তার ওয়ার্ডের প্রায় ৪ শ’ ভোটারের মধ্যে ৩ শ’ জনকেইখাম দিয়েছেন। প্রত্যেক খামে ছিল ৫ হাজার টাকা করে। এই খবর পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায় ভোট কিনে নেন।
সংরক্ষিত ২ নং ওয়ার্ডের (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, বিজয়নগর ও কসবা উপজেলা) একজন প্রার্থী জানান, টাকা যে কীভাবে খরচ হয়েছে তা বলতে পারবো না। আত্মীয়-স্বজনরাও টাকা খরচ করেছেন। আনুমানিক ৩৮/৪০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে এমনই হিসাব তার।

সংরক্ষিত ৩ নম্বর ওয়ার্ডের এক সদস্য প্রার্থী জানান, তার প্রতিদ্বন্দ্বী যেখানে ৫ হাজার টাকা দিয়েছেন, সেখানে তারা ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এর বাইরেও আমরা টাকা দিয়েছি। কোটি টাকা খরচ হলেও জয় ছিল আমাদের লক্ষ্য। একটা ভোটার কাকে ধরলে ঘুরবে তারেও টাকা দিয়েছি। এখানে ৪ নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

নবীনগর উপজেলায় ৮নং ওয়ার্ডে ৩ সদস্য প্রার্থী টাকা খরচ করেছেন বস্তা ভরে। এর মধ্যে ২ জনের খরচ কোটি টাকার কাছাকাছি। মো. নাসির উদ্দিন নামে এক প্রার্থীর জন্য এলাকার সংসদ সদস্য নিজেই ৫০ হাজার টাকা করে কয়েকটি ইউনিয়নের ভোট কিনেন বলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা অভিযোগ করেন। সঙ্গে একটি করে মোবাইল ফোনও দেয়া হয়। ভোটের এক সপ্তাহ আগে থেকে টাকা ও মোবাইল ফোন দেয়ার বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দফায় দফায় অভিযোগ দেন। এক ইউপি চেয়ারম্যান জেলা পরিষদের ওই সদস্য প্রার্থীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। প্রতিদ্বন্দ্বী এক সদস্য প্রার্থী জানান, সে যেখানে ৫০ হাজার দিয়েছে সেখানে আমি ৭০ বা ৮০ হাজার, কোথাও এক লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছি। এ ছাড়া সাবেক এক এমপি ২১ ইউনিয়নে দলের চেয়ারম্যান প্রার্থীর জন্য নির্বাচনের ২ দিন আগে ৫ হাজার টাকার খাম পাঠান। এই টাকায় ভোটের ফল পরিবর্তন হয় বলে তাকেই চেয়ারম্যান জয়ের নায়ক বলা হচ্ছে এখন। তিনি সদস্য প্রার্থীদেরও টাকা দিয়েছেন।

আশুগঞ্জ উপজেলায় (৩ নম্বর ওয়ার্ড) প্রতিদ্বন্দ্বী ৪ প্রার্থীর মধ্যে টাকা খরচের দিক দিয়ে আলোচিত ব্যবসায়ী বিল্লাল মিয়া। ৬০ ভোট পেয়ে জয় পেয়েছেন তিনি। ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় একেকটি ভোট কিনেছেন বলে আলোচনা ছড়িয়েছে। তার ব্যয় ৫০/৬০ লাখ টাকা। তবে বিল্লাল মিয়া বলেছেন, মানুষ কতো কথা বলে। নিয়মের বাইরে আমি কোনো টাকা খরচ করিনি।

এ ছাড়া সদর উপজেলা, আখাউড়া, কসবা, বাঞ্ছারামপুর এবং বিজয়নগর উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী সদস্য প্রার্থীরা দেদার টাকা দিয়েছেন ভোটারদের।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা তো ব্যবসাটাকে রাজনীতিতে পরিণত করেছি, আর রাজনীতিটাকে ব্যবসায় পরিণত করেছি। এখন কোনোটাই ভালো চলছে না। জেলা পরিষদের গঠনটা মৌলিক গণতন্ত্রের আদলে। পরোক্ষ নির্বাচন, সীমিত সংখ্যক ভোটার। যার জন্য অতি সহজেই ভোট বাণিজ্য করা যায়। আগের নির্বাচনের সময়ও ভোট বাণিজ্যের কারণে চরম ভাবে কলুষিত হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু নীতি- নৈতিকতা নয়, এটা তো আর জনকল্যাণ হলো না, জনস্বার্থ হলো না।

টাকা পয়সা দিয়ে নির্বাচিত হয়, এটা ব্যবসার অংশ। এই টাকা পয়সাটা সুদে আসলে উসুল করা, এই পদকে ব্যবহার করে অন্যান্য অনৈতিক সুবিধা আদায় করা- এটাই ব্যবসা। জেলা পরিষদ একটা পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র লিডারদের, যাদের অন্য কোথাও রাখা যাচ্ছে না তাদেরকে জেলা পরিষদে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। জেলা পরিষদের আরেকটা সীমাবদ্ধতা, এটা এমন হয়ে গেছে যেটা সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবের ভাষায়-‘এটা একটা অথর্ব আইন। এটা দিয়ে যে জেলা পরিষদ হবে সেটা অকার্যকর হবে’। জেলায় জেলায় সরকার নামক বইয়ে তিনি সেটা লিখেছেন। জেলা পরিষদের নির্বাচনটা পুরোটাই একটা অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতা। যারা সরকারি দলের মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই জয়লাভ করেছেন। নতুবা তাদের বিদ্রোহীরা জয়লাভ করেছে। ক্ষমতাসীনদের বাইরে এসে নির্বাচিত হওয়াটা অসম্ভব। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ পাওয়ার কথা। অর্থাৎ গণতন্ত্রের মানেই হলো সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন।
#
প্রতিবেদনটি মানবজমিনে প্রকাশিত






Shares