Main Menu

মূল্য বৃদ্ধির গোলকধাঁধাঁয় দেশ

+100%-

কথা রাখেনি সরকার। সরকার এর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায়, দেশে তেলের মূল্য কমানোর ঘোষণা দেয়। সরকারের সে ঘোষণা বাস্তবে রূপ পায়নি। উল্টো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ বর্তমান সময়ে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কোনই যৌক্তিকতা নেই। দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে সরকারের কাজ করার কথা থাকলেও সরকার হাঁটছে উল্টোপথে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমায় বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অনেক কমেছে। সে ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ কমায় বিদ্যুতের দাম কমার কথা। বাড়ে কি করে? বর্তমানে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো কঠিন করে তুলবে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে আমরা মনে করি।
এদেশে সব কিছুরই যেন দাম বাড়ে; কমে না। রীতিমত মূল্য বৃদ্ধির এক গোলকধাঁধাঁয় পড়েছে দেশের আমজনতা। একবার কোনো কিছুর দাম বাড়েছেতো, তা কমেনি কখনো। ব্যবসায়ীরা কথায়-কথায়, দফায়-দফায় জিনিসপত্রির দাম বাড়ায়; এ প্রতিযোগিতায় এখন পিছিয়েনেই খোদ সরকারও। সমস্যা হলো কোনো ছুঁতোয় দাম বাড়লে আর কমার নাম থাকে না। জ্বালানি তেলে ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কমেনি তেলের দাম উল্টো তেল নির্ভর বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের দাম বেড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনে কোনো ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে না। জ্বালানি নিরাপত্তা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বর্ধিত বেতন-ভাতা দিতেই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকােেরর এমন যুক্তি খুবই হাস্যকর। বাংলাদেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে আকাশ ছুঁয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার দাম কমলেও তেলের দাম আর কমেনি। সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমাবে বললেও উল্টো গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বুদ্ধিও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনিতেই বর্তমানে বাজারে দ্রব্যমূল্য জনগনের হাতের নাগালের বাহিরে চলে গেছে। পিয়াজ এক লাফে উঠেছে এক শ’ টাকার উপরে। বাজারে সব কিছুর দামই এখন চড়া। এ অবস্থায় গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি আগুনের উপর ঘি ঢালার সামিল।
আমার জানা মতে বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর সব দেশের মানুষ কম মূল্যের জ্বালানির সুবিধা পাচ্ছে। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় পণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়বে। এজন্য গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধিও সরকারের সিদ্ধান্তে সর্বমহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এখনই আলোচনার ঝড় বইছে সারা দেশে। সর্বত্র বিরাজ করছে ক্ষোভ-অসন্তোষ। তেলের দাম না কমিয়ে উল্টো গ্যাস- বিদ্যুতের দাম বাড়াতে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পরিবহন মালিক, বাড়ীওয়ালা সকলেই হতভম্ব। সবখানেই একই আলোচনা, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে জনজীবনে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দেবে। বাড়বে বাড়ি ভাড়া, পরিবহন ভাড়া থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল পণ্যের দাম। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ার বিরূপ প্রভাব শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারেই আঘাত হানবে না; নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে গণপরিবহন খাতেও। সিএনজি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণায় ইতোমধ্যেই নড়েচড়ে বসেছেন পরিবহন মালিকরা। সিএনজির দাম বাড়ানোয় গাড়িভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে সড়ক পরিবহন সমিতি। এ পরিস্থিতিতে গাড়িভাড়ার সঙ্গে বাড়িভাড়া প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বাড়ানো হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ভাড়াটিয়ারা। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারে মাসে গড়ে ৩০০ টাকা খরচ বাড়ার কথা। গ্যাসের কারণে দুইশ` টাকা। বিদ্যুতে গড়ে ৫০ থেকে একশ` টাকা। তবে খরচ এর থেকে অনেক বেশি বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তিই নেই। তেলের দাম কমানোর কথা, তা না করে সরকার তেল নির্ভও পণ্যেও দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে কি করে? সরকার যদি তেলের দাম কমায়ও পরিবহন ভাড়া তো কমাতে পারবে না। ফলে তেলের দাম কমালেও তার সুফল পাবে না সাধারণ মানুষ। আসলে সরকার হাঁটছে উল্টোপথে। যেকোনো পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে সেই পণ্যের দাম বাড়বে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু উৎপাদন খরচ কমলে দাম বাড়ে তা এখন দেখছি। বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমেছে। কিন্তু দাম বাড়ানো হলো। উৎপাদন খরচ কমার কারণে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে দেওয়া উচিত ছিল সরকারের। এ অবস্থায় দাম বাড়ানো অযৌক্তিক ।
আসলে দেশে মূল্য বৃদ্ধি রীতি চক্রে পুনঃ পুনঃ আবর্তিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবন। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের, বাজারে যেতে রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন ক্রেতারা; অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে জনগনের নাভীশ্বাস ওঠানো হয়েছে। ২৭ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের ক্ষেত্রে আবাসিক গ্রাহকদের বর্তমান এক চুলার ৪০০ টাকার স্থলে ৬০০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৪৫০ টাকার স্থলে ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মিটারভিত্তিক গ্যাসের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট ৫ টাকার স্থলে ৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ক্যাপটিভ পাওয়ারের ক্ষেত্রে দাম দ্বিগুণ করে ৪ টাকা ১৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৩৬ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সিএনজি গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্ধিত এ মূল্যহার আগামি ১ সেপ্gas electrটেম্বর থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি দেশীয় শিল্পের জন্য চপেটাঘাতের মতো। এমনিতেই দেশীয় শিল্প-কারখানা গুলো মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। জ্বালানীর দাম বৃদ্ধিতে শিল্প কারখানা যারপর নেই বেকায়দায় পড়বে। সব মিলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে দেশের শিল্প খাত যে বড় ধরনের হোঁচট খাচ্ছে তা স্পষ্ট। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক শিল্প খাতে। এ অবস্থায় সরকারকে অবিলম্বে গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিও সিদ্ধান্ত থেকে সওে এসে শিল্প সেক্টরে উদারীকরণের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংক-ঋণের উচ্চ সুদ হার কমানোর পাশাপাশি খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে গ্রহণ করতে হবে নমনীয় মনোভাব। বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সহজলভ্য করাসহ এর মূল্যও সহনীয় রাখতে হবে। এ-দেশীয় শিল্প টিকিয়ে এবং রপ্তানির চলৎ ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারকে জরুরিভাবে সমাধানের পথ খুঁজে বের করে এগিয়ে আসতে হবে। গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহসহ এর সঠিক মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে শিল্প ধ্বংস হলে দেশের অর্থনীতি রুগ্ন হবে। রুগ্ন অর্থনীতিতে তাদেরই দেশ চালানো দুরূহ হয়ে পড়বে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধি শিল্পোদ্যোক্তাদের আরও চাপে ফেলবে। সরকারের এ সিদ্ধান্তে বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে। নতুন বিনিয়োগকারীরা আরও নিরুৎসাহিত হবেন। তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত বছরে পোশাক খাতের উৎপাদন ব্যয় বেশি ছিল ১২ শতাংশ। নতুন করে গ্যাস ও বিদ্যুতের দর বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে ২০ শতাংশে পৌঁছবে। এতে প্রতিযোগিতায় পোশাক খাত পিছিয়ে পড়বে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দর সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে না আনলে পেশাক খাত ক্ষকিগ্রস্ত হবে। কোনো পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে সেই পণ্যের দাম বাড়বে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু উৎপাদন খরচ কমলে দাম বাড়ে তা এখন দেখছি। বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমেছে। কিন্তু দাম বাড়ানো হলো। উৎপাদন খরচ কমার কারণে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। এ দাম বাড়ানোর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিতরণ কোম্পানিগুলো এখনই লাভ করছে। এতে দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে ভোক্তা ও উৎপাদন পর্যায়ে প্রভাব পড়বে। তাই দেশীয় শিল্প বাঁচাতে এবং হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রক্ষা করতে সরকারকে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। শিল্প সংরক্ষণ নীতি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-আগ্রাসনও প্রতিরোধ করতে হবে। জাতীয় এ স্বার্থকে গুরুত্ব না দিলে দেশীয় শিল্প বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে। এ সঙ্কটের উত্তরণ না হলে এসব শিল্প খাত শুধু পথে বসবে না, শত শত উদ্যোক্তা, লাখ লাখ শ্রমিকও কাজ হারিয়ে বেকার হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যাংক, বীমা, পরিবহনসহ সংশ্লিষ্ট খাতগুলো। অর্থনীতি ও সমাজের স্থিতিশীলতা এতে বিনষ্ট হবে।
আমরা মনে করি, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এটা ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো নিষ্ঠুর ও অমানবিক। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির আগে সরকার বিষয়টি নিয়ে আরো চিন্তভাবনা করবে এবং দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প আছে কিনা, তা খুঁজে দেখবে এটাই প্রত্যাশা সরকারের কাছে।
[লেখক- মির আবদুল আলীম,সাংবাদিক ও কলামিষ্ট]






Shares