reutersডেষ্ক ২৪:: রোমের ক্লদিয়া ভিগ্গিয়ানির টুইটে জাপানি লণ্ঠনের ম্রিয়মাণ আলোর ছবি। সঙ্গে বার্তা, ‘ইতালি ও জাপান বরাবর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে থাকবে’।

টোকিও থেকে কাজুতো সুজুকির টুইট, ‘‘বাংলাদেশে জঙ্গিদের গুলি থেকে বাঁচতে আক্রান্তরা ‘আমি জাপানি, আমাকে গুলি কোরো না’’ বলে চিৎকার করছেন। যাঁরা বাংলাদেশের সমাজের উন্নয়নে কাজ করছিলেন, ঘাম ঝরাচ্ছিলেন, তাঁরাই কেমন অসহায় বোধ করছিলেন। জেনে মন ভারী হয়ে আসছে।’’

ঢাকার গুলশনে জঙ্গি হামলায় নিহতদের মধ্যে ইতালি ও জাপানের নাগরিকদের সংখ্যাই সব থেকে বেশি। ইতালির ন’জন। জাপানের সাত। বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পোশাক ইতালিতে রফতানি হয়। ইতালির নাগরিকরা অধিকাংশই সেই পোশাক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর জাপানের ৭ জনই সে দেশের মেট্রো রেল প্রকল্পে কাজ করছিলেন।

বাংলাদেশ সরকারের দাবি, দেশের উন্নয়নে বাধা দিতেই এই হামলা। জাপানি সংস্থা জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি)-র অর্থে বাংলাদেশে পরিকাঠামো তৈরি চলছে। আর ইতালি রফতানি ক্ষেত্রে  বাংলাদেশের  গুরুত্বপূর্ণ শরিক। বাংলাদেশের সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী ওবাইদুল কাদের তাই দাবি করেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে যারা উন্নয়নের কাজ বন্ধ করে দিতে চাইছে, তারাই এই হামলা চালিয়েছে। নিশানা করা হয়েছে জাপান ও ইতালির নাগরিকদের। হাসিনা সরকারের মতে, একই কারণে গত বছরের শুরু থেকে সে দেশে ইতালি ও জাপানের কর্মীদের উপর হামলা হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশে ইতালি ও জাপানের দুই নাগরিক খুন হন। দু’জনেই জনসেবামূলক প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

ভারতের গোয়েন্দারাও মনে করছেন, আইএস হোক বা পাক-মদতপুষ্ট বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন, জাপানের নাগরিকদের উপরে হামলার উদ্দেশ্য ভারত-বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্কে আঘাত করা।

জঙ্গিরা গত শুক্রবার গুলশনে হামলা চালানোর পরে প্রথমেই জানা যায়, জাপানিদের পণবন্দি করে রাখা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবি ওঠে, মুক্তিপণের অর্থ মিটিয়ে দিক জাপান সরকার। কিংবা হামলাকারীরা আল-কায়দার জঙ্গি হলে আগে ধরা পড়া তাদের কোনও সঙ্গীকে ছেড়ে দেওয়া হোক।

জঙ্গিরা এর পর খুন করতে শুরু করলে টুইটার-ফেসবুকে প্রশ্ন ওঠে, যাঁদের খুন করা হয়েছে, তাঁরা তো ইসলামের বিরুদ্ধে কোনও কাজ করছিলেন না! তা হলে কেন তাঁদের খুন করা হল?

জাপানের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী  আজ বাংলাদেশে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। হাসিনাকে তিনি জানান, জাপান শুধুই বাংলাদেশের উন্নয়নে সাহায্য করতে চায়। মুসলমান সমাজের প্রতি জাপানের মানুষের ক্ষোভ নেই।

তবে হাসিনার কাছে এটাই স্বস্তির কথা যে, এখন পর্যন্ত কেউই বাংলাদেশ সরকারের দিকে আঙুল তুলছেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায় সরাসরি সন্ত্রাসবাদীদের প্রতিই ঘৃণা বর্ষণ চলছে ইতালীয় বা জাপানি ভাষায়। জাইকা-র অর্থে বাংলাদেশ জুড়ে সড়ক-সেতুর মতো পরিকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে। জাইকা-র প্রেসিডেন্ট শিনিচি কিতাওকা বলেছেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদীদের উপর রাগ জন্মাচ্ছে। যাঁরা বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজ করছিলেন, তাঁদেরই আমরা হারিয়েছি।’’ জাপানের আলমেক কর্পোরেশনের চার কর্মী নিহত হয়েছেন। টোকিও-র ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্টসও বাংলাদেশে কাজ করছে। সংস্থার প্রেসিডেন্ট এইজি ইওনেজাওয়া বলেছেন, ‘‘আমাদের তিন জন কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।’’ ঢাকায় অন্য কর্মীদের তিনি নির্দেশ পাঠিয়েছেন, গাড়ি ছাড়া এক পা-ও বাইরে বেরোনো চলবে না। কর্মীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও দ্রুত পর্যালোচনা করা হবে।

এ সব জানার কোনও আগ্রহ আর নেই ৭২ বছরের কোমাকিচি ওকামুরা-র। শনিবার রাতে তিনি খবর পান, তাঁর ছেলে মোকাতো-কে জঙ্গিরা খুন করেছে। জাপানের আলমেক কর্পোরেশন-এর হয়ে বাংলাদেশে কাজ করছিলেন ৩২ বছরের মোকাতো। জাপানের এক সাংবাদিক টুইটারে জানিয়েছেন, মোকাতোর মা তাঁদের একটিই কথা বলেছেন। তা হলো, ‘আমি এখন যা-ই বলি না কেন, আমার ছেলে আর ফিরে আসবে না।’

একই ছবি ইতালিতেও। ন’জন নাগরিকের মৃত্যুতে গোটা দেশই শোকস্তব্ধ। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত। হামলার খবর পেয়ে মেক্সিকো থেকে দেশে ফিরে এসেছেন প্রেসিডেন্ট সের্গিও মাত্তারেল্লা। ইতালির প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেনজি টুইট করেছেন, ঢাকায় নিহত সহ-নাগরিকদের জন্য ইতালিতে সবাই একসঙ্গে  কাঁদছে। কিন্তু ঘৃণা বা সন্ত্রাস ইতালির মূল্যবোধকে বদলে দিতে পারবে না।

তাঁর পাশে দাঁড়িয়েই রোমের কার্লো বেল্লোর মন্তব্য, ‘‘সাত জনের মধ্যে এক জন ছিলেন সন্তানসম্ভবা। এটাই তো আইএসের নৈতিক হার।’’