Main Menu

কালিকার মৃত্যু বাংলা সংগীতের ক্ষতি

+100%-

লোকসংগীত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে শোকার্ত সংগীত জগৎ৷ সকলেই বলছেন, লোকসংগীতে অনুগতপ্রাণ এক গবেষককে হারালো বাংলা৷

কলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সিউড়ি যাওয়ার পথে বর্ধমানের গুড়াপের কাছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা৷ গাড়ির চাকা ফেটে রাস্তার ধারের দেওয়ালে ধাক্কা মেরে, রেলিং ভেঙে গাড়ি গিয়ে পড়ল ১৫ ফুট নীচে নয়ানজুলিতে৷ সেই প্রচণ্ড অভিঘাতেই মাথায় মারাত্মক চোট, মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে দুর্ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন লোকসংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী এবং গবেষক, লোকগানের দল ‘‌দোহার’-এর পুরোধা কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য৷ বাংলা সংগীতের জগৎ হারালো তাঁর অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে, মাত্র ৪৭ বছর বয়সে৷ নির্মলেন্দু চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, স্বপন বসুদের পর যিনি বাংলা লোকগানের নিজস্ব ধারাকে তার প্রাপ্য আদর, কদর পাইয়ে দিচ্ছিলেন আন্তরিক পরিশ্রমে আর উদ্যোগে৷

কালিকাপ্রসাদের অকালমৃত্যুর পর সবাই এই আক্ষেপটাই করছেন৷ জি বাংলা’র জনপ্রিয় গানের অনুষ্ঠান ‘‌সা রে গা মা পা’‌-র অন্যতম বিচারক হিসেবেও তিনি যেন দায়িত্ব নিয়েছিলেন জনপ্রিয় আধুনিক গানের পাশাপাশি লোকগানের যে সমান্তরাল বহতা ধারা, প্রতিযোগী এবং দর্শকদের মনে সেই নদীটিকেও বইয়ে দেওয়ার৷ যে নিষ্ঠায় তিনি গ্রামবাংলা থেকে খুঁজে আনতেন এক একটি লোকগান, তার স্বাভাবিক সুর, তাল অবিক্রিত রেখে, মূল যন্ত্রানুষঙ্গ অক্ষত রেখে, যেভাবে সেটি পরিবেশন করতেন, লোকপ্রিয় করে তুলতেন, সেই আন্তরিকতা, সেই চেষ্টা আজকের সস্তা জনপ্রিয়তার যুগে সত্যিই বিরল৷ একবাক্যে বলছেন সবাই৷

সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় ‘‌ভুবনমাঝি’‌ ছবির সুরারোপের কাজে যুক্ত হয়েছিলেন কালিকাপ্রসাদ৷ সেই ছবি আর তার গান নিয়ে উৎসাহের অন্ত ছিল না তাঁর৷ আসলে কালিকাপ্রসাদ নিজেই যেন ছিলেন সেই ভুবনমাঝি, যিনি নাও ভাসিয়েছিলেন দেশ-কালের সীমান্তহীন সুরের দরিয়ায়৷ যে মাঝির গানে এক হয়ে যায় গঙ্গা আর পদ্মার চর৷

মঙ্গলবার‌ সকালে কালিকাপ্রসাদের গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ তিনি টুইট করে জানান এই দুঃসংবাদ৷ লেখেন, ‘‌‘কালিকাপ্রসাদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোকাহত৷ তাঁর চলে যাওয়া বাংলা সংগীতের এক বড় ক্ষতি৷” দ্বিতীয় টুইট বার্তায় মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, ‘‘‌কালিকাপ্রসাদের মৃত্যু এক ব্যক্তিগত ক্ষতি৷ তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন৷ তাঁর পরিবার এবং ভক্তদের প্রতি আমার সমবেদনা৷”

এর পরেই মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কালিকাপ্রসাদের শেষকৃত্য করবে রাজ্য সরকার৷ তার আগে শিল্পীর দেহ থাকবে রবীন্দ্রসদনে, যাতে তাঁর ভক্ত-অনুরাগীরা শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন৷ সেই মতো মঙ্গলবার সন্ধেয় দক্ষিণ কলকাতার শ্মশানে অন্ত্যেষ্টি হয় কালিকাপ্রসাদের৷ উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, পরিবারের লোকজন, অসংখ্য বন্ধু, গুণমুগ্ধ এবং সহশিল্পীরা৷ তাঁদের ভিড় বুঝিয়ে দিয়েছে, শিল্পী এবং মানুষ হিসেবে কতটা সর্বজনপ্রিয় ছিলেন কালিকাপ্রসাদ৷

ওদিকে সারাদিন ধরেই বাংলার সংবাদমাধ্যম ভরে ছিল কালিকাপ্রসাদের স্মৃতিচারণে৷ ব্যক্তিগত আফসোসের কথা জানিয়েছেন সমসাময়িক লোকসংগীত শিল্পী সৌমিত্র রায়৷ বাংলা গানের দল ‘ভূমি’‌-র মূল গায়েন সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, যখনই লোকসঙ্গীত সংক্রান্ত কোনো প্রয়োজন হতো, তিনি কালিকাপ্রসাদের শরণাপন্ন হতেন৷ সেই মানুষটির নামের আগে ‘‌প্রয়াত’‌ শব্দটি বসছে, এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না৷ চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষের ছবি, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় লালন শাহ’র জীবনের ওপর আধারিত ‘‌মনের মানুষ’‌ ছবিতে লালনের গলায় গান গেয়েছিলেন কালিকাপ্রসাদ৷ গৌতম ঘোষ জানিয়েছেন শিল্পীর নিরন্তর সন্ধানের কথা৷ যখনই দেখা হতো, বলতেন, নতুন গান পেয়েছি৷ একদিন বাড়ি গিয়ে শুনিয়ে আসব৷ আর শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা মনে করেছেন নিরহঙ্কার, সাদাসিধে, মাটির কাছাকাছি থাকা একজন মানুষের কথা৷

আদতে অসমের শিলচরের মানুষ ছাত্রজীবনে কালিকাপ্রসাদ বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর সক্রিয় কর্মী এবং সংগঠক ছিলেন৷ তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘‌সংগীতপ্রেমী সব মানুষের ক্ষতি হলো৷ লোকসংগীতকে তিনি নিজস্ব শৈলীতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন৷”

বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী, লন্ডন প্রবাসী সাহানা বাজপেয়ি জানিয়েছেন, কালিকাপ্রসাদের প্রয়াণে তিনিও দুঃখিত, শোকাহত৷






Shares