স্মৃতির খেলাঘরে এক মহা-মিলনমেলা



তাজুল ইসলাম হানিফ :আমাদের পাশের বাড়ির এক প্রফেসর। তাঁর বাড়ীতে প্রায়-ই যাওয়া হত। তো একদিন একটি বই আমার নজর কাড়ল। আমি ঐ সম্মানিত প্রফেসরকে জিজ্ঞাসা করলাম এইটা কি বই ? তিনি আমায় বললেন তুমি ঐ সব বুঝবে না, ঐ সব হাতা-হাতি করবে না। আমি তাঁকে জোর করে বলি ঐটা কি বই, কি লেখা আছে সেখানে ?
কিন্তু স্যার আমায় বলবে না বলে ধমক দেই। আমিও নাছোড়বান্দা। আমি স্যারকে বললাম, আমায় না বললে আমি এখান থেকে যাবো না। তারপর, স্যার বললেন, এই বইটা হল বিসিএস পাশ করার বই, এই ধরনের বই বেশী বেশী পড়লে বিসিএস পাশ করা যায়। আমি আবার বললাম, বিসিএস মানে কি ? কেননা আমি তো মাত্র ক্লাস এইটে পড়ি। অতঃপর আমাকে উনি বুঝিয়ে বললেন। আর সেই থেকে আমি বিসিএস পাশ করার লক্ষ্যে পড়াশোনা করতে থাকি। এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রথম বিভাগ নিয়ে ভর্তি হই ডি.ইউতে। ঐ লক্ষ্য থাকে আমায় অটুট, ফলশ্রুতিতে, অনার্স ফোর্থ ইয়ারের সময়ই আমি হয়ে যায় বিসিএস এডমিন ক্যাডার। সেই থেকে আজ যুগ্নসচিব, বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ে। আমি যেহেতু, অনার্স ফোর্থ ইয়ারে বিসিএস ক্যাডারে যোগ দেই, আমি আমার বন্ধুবান্ধব থেকে চার বছর বেশী চাকুরী করতে পারবো। অর্থাৎ আমার ইয়ার মেইটরা যেখানে ২০২২ সালে অবসরে যাবে, আমি যাবো ইনশাল্লাহ ২০২৬ সালে। এইভাবেই নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করেন তাজুল ইসলাম তাজু সাহেব, অত্র স্কুলের সাবেক ছাত্র, বর্তমানে যুগ্নসচিব, বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়। তখনি দর্শক সারি থেকে সবাই বলতে থাকে আপনার মেধা, পরিশ্রম, অভিজ্ঞতা, প্রাজ্ঞতা, বিজ্ঞতা, পড়াশোনা ও সুনামের কারনে আপনি সচিব তথা মন্ত্রী পরিষদ সচিব কিংবা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুর্খসচিব হবেন। ইনশাল্লাহ।
সম্মানিত পাঠক, ২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭। আমার স্নৃতির খেলাঘরে ছিল এক মহা-মিলনমেলা।
ব্রাক্ষণবাড়ীয়া জেলার কসবার সৈয়দাবাদ আলহাজ্ব সৈয়দ মনিরুল হক উচ্চবিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নতুন প্রাণের স্পর্শে স্পন্দিত ও আনন্দ হিল্লোলে মুখরিত হয়েছিল। নতুন বর্ণিলে সাজে ছিল এই বিদ্যাপীঠ। এই পুর্নমিলনীর মাধ্যমে মহা-আনন্দে মিলিত হওয়া, বন্ধু-সুধী-প্রিয়জন ও নতুন পুরাতনের আড্ডায় কোলাহলের সাথে পুরানো স্মৃতি হাতরিয়ে বেড়ানো এবং পুনরায় মিলিত হবার সুযোগ করে দিয়ে ছিল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনটি। পুরানো সোনালী দিনের স্মৃতি রোমন্থনে একটি দিন অতিবাহিত করা এবং চমৎকার মনোরম পরিবেশে তরতাজা প্রাণের মেলায় ও প্রাণবন্ত আলোচনা দারুনভাবে উপভোগ্য ছিল। জমেছিল ভালবাসার, ভাললাগার, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির বন্ধন। ঢাকা কিংবা বিভিন্ন জায়গায় থাকা গ্রামের/বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীগণ নিবিড় সান্নিধ্যে ও মনোরম পরিবেশে জড়ো হতে থাকে যথা সময়ে স্কুলের আঙ্গিনায়।
আলহাজ্ব সৈয়দ মনিরুল হক উচ্চবিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের এক সুমহান ঐতিহ্য ও খ্যাতি রয়েছে অত্র অঞ্চলে। এখানকার শিক্ষা, নিয়ম-শৃঙ্খলা, ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক, পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় ফলাফল বেশ প্রশংসার দাবীদার। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠনের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী সৈয়দাবাদ আলহাজ্ব সৈয়দ মনিরুল হক উচ্চবিদ্যালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস ও ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরে উৎসাহিত করা ও তাঁদেরকে সঠিক পথ দেখানোই মূল-লক্ষ্য। রাজনৈতিক মতাদর্শের উর্ধে থেকে সকলের সহযোগিতায় এ সংগঠনটি আগামী দিনেও বিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বজায় রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে বলে আশা রাখী। বিশ্বাস করি অ্যালামনীদের মধ্যে একতা, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপন এবং একে-অন্যের প্রতি যথাসম্ভব সাহায্য ও সহযোগিতা করার দৃঢ়-বন্ধন গড়ে উঠবে।
আলহাজ্ব সৈয়দ মনিরুল হক উচ্চবিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব কামাল ইকরাম চৌধুরির গঠনমূলক স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। তরুণ সমাজসেবক ও প্রশান্তি পত্রিকার সম্পাদক তাজুল ইসলাম নয়ন সাহেবের প্রাণচাঞ্জল বক্তব্যে এগিয়ে যেতে থাকে অনুষ্ঠান।
বক্তব্য রাখেন হোসাইন মোল্লা, মাহমুদুল হক মুন্না, নিয়াজ মোহাম্মদ, মজনু মিয়া, সহযোগী অধ্যাপক খালেদ হুসেন খাঁন, শিল্পপতি শাখাওয়াত হুসেন খাঁন, ড. মোঃ আব্দুল মুনিম খান, এড. ইকবাল হুসেন চেয়ারম্যান, সাবেক চেয়ারম্যান জহিরুল হক, প্রবাসী-কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের যুগ্নসচিব তাজুল ইসলাম তাজু সাহেবসহ আরও অনেকেই।
শিল্পপতি শাখাওয়াত হুসেন খাঁন বলেন, আমি আজ প্রতি মাসে ২০ হাজার পিচ সুয়েটার রপ্তানি করি ইউরোপে, ছেলে-মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করেন তাঁর সফলতার গল্প বলে। অধ্যাপক ড. মোঃ আব্দুল মুনিম খান জানান তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুল্ড মেডেলিস্ট হওয়ার গল্প। ছেলে-মেয়েরা উৎসাহিত ও অনুপ্রানিত হয় তাঁর কথা শুনে। সরকারী কলেজের সহযোগী অধ্যাপক খালেদ হুসেন খাঁন ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলেন, ছাত্রজীবনে পড়াশুনা, পড়াশুনা ও পড়াশুনার কোন বিকল্প নাই। একই সাথে ছাত্রজীবনে একে অপরের সাথে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির সম্পর্কের কথা বলেন তিনি।
এড. ইকবাল হুসেন ভুঁইয়া বিনাউটি ইউ.পির চেয়ারম্যান ও জেলা জর্জকোর্টের আইনজীবী, সুমৃষ্ঠ ভাষী এই সু-বক্তা ও দায়ীত্ব পালন করছেন কসবা-আখাউড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফোরামের সভাপতি হিসেবে। তিনি বলেন, আজ অত্যন্ত ভাল লাগছে যে, যুগ্নসচিব তাজুল ইসলাম সাহেবের নেতৃত্বে এক ঝাক তরুণ ঢাকা থেকে আসছে স্কুল তথা গ্রামকে উন্নয়নের উদ্দেশ্যে। অথচ আজ থেকে ৪০/৫০ বছর পূর্বে ঢাকা থেকে নিয়মিত আসতেন অত্র এলাকার মহা-মানব এ. বি. সিদ্দিক সাহেব। যিনি এই গ্রাম তথা অত্র সমাজে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মানে ও উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। রাজনীতিতে ছিলেন সুপরিচিত। আজকের এই তরুণ সমাজের প্রতি আমার অশেষ ভালবাসা ও শুভকামনা রইল।
সাবেক চেয়ারম্যান জহিরুল হক বলেন অত্র স্কুল প্রতিষ্ঠালগ্নে আমি অত্র এলাকায় অনেক রাস্তা-ঘাঠ নির্মাণ করি। স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠায়ও আমার অবদান আপনারা জানেন। আপনাদের সত্যি কথা বলতে হবে। আপনাদের সাথে আমি আগেও ছিলাম, এখনও আছি, সামনেও থাকবো ইনশাল্লাহ। উল্লেখ্য অনুষ্ঠানটি আতাউল্লাহ ভুইয়ার উপস্থাপনায় ও গোলাম মোস্তফার পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত পাঠের মাধ্যমে শুরু হয়।
সর্বশেষে তাজুল ইসলাম তাজু সাহেব তাঁর উৎসাহ ও অনুপ্রেরনাদায়ক বক্তব্য নিয়ে আসেন। শুনান চরম প্রতিকুলতার মাঝেও তাঁর বিসিএস ক্যাডার এডমিন হওয়ার গল্প। এবং একইসাথে তিনি ঘোষণা দেন যে,
০১। ক্লাস সিক্স টু টেন পর্যন্ত ফাস্ট, সেকেন্ড, থার্ডকে পুরস্কৃত করা হবে। পুরস্কৃত করা হবে ক্লাস টেন এর টেস্ট পরীক্ষায় ফাস্ট টু টেন পর্যন্ত ছেলে-মেয়েকে এবং একইসাথে এসএসসি পরিক্ষায় এ+ ধারীদের।
০২। ছেলে-মেয়েদের জন্য অতিরিক্ত ক্লাস নিতে প্রয়োজনে অতিরিক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। এবং একই সাথে স্কুলের রেজাল্ট ভালো করার লক্ষ্যে যত ধরনের সার্পোট লাগবে আমরা দিব।
০৩। ভবিষ্যতে কলেজের দিকেও যাব।
০১. সৈয়দাবাদ আলহাজ্ব সৈয়দ মনিরুল হক উচ্চ বিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের সদস্য করা হবে স্কুলের সকল প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীকে।
০২. অ্যালামনাই এসোসিয়েশনটি কোন একক ব্যক্তির কিংবা দলের হয়ে কাজ করবে না। স্কুল তথা কলেজ ও অন্যন্যা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত কিংবা সাহায্য সহযোগিতা করাই অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের মূল লক্ষ্য হবে।
০৩. প্রত্যেকে তাঁদের স্ব -স্ব অবস্থান থেকে সাহায্য সহযোগিতা করবে তাঁদের মেধা, শ্রম, বুদ্ধি, অর্থ ও পরামর্শের মাধ্যমে।
০৪. একটি Web site তৈরী হয়েছে। নামঃ www.asmhalumniassociation.org/ যেখানে সব তথ্য পাওয়া যাবে এবং অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের নামে একটি একাউন্ট আছে। অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের মাসিক চাঁদা ৫০০ টাকা এবং একাউন্ট নাম্বার “A.S.MONIRUL HAQUE HIGH SCHOOL ALUMNI ASSOCIATION”, Al-Arafa Islami Bank Ltd., Nandipara Branch., Savings A/C No: 0601120116414.
০৫. আগামি বৎসর অর্থাৎ স্কুলের চল্লিশ বছর পূর্তিতে একটি বড়-সড় পুর্নমিলনী করার ঘোষণা দেন।
০৭. হাসপাতালটি পুনঃনির্মান, কলেজ উন্নয়ন কিংবা গ্রাম উন্নয়ন নিয়েও ভবিষ্যতে কাজ করা হবে বলে জানান।
এছাড়া যেকোন প্রয়োজনে অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের ব্যাপারে চৌধুরী কামাল ইকরাম সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
বক্তারা আলহাজ্ব সৈয়দ মনিরুল হকের প্রতিও শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করেন তাঁর অবদান ও কীর্তি। এই মহান মানুষটি ১৯৭৯ সালে সৈয়দাবাদ আলহাজ্ব সৈয়দ মনিরুল হক উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। একই সাথে অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানানো হয় বীরমুক্তিযোদ্ধা, স্কুলের সম্মানিত সভাপতি আলহাজ্ব সৈয়দ শামসুল কাউনাইন কুতুব সাহেবের প্রতি।
অত্র স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষকগণদের ভুমিকার কথাও শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করা হয়, আবু জামাল, আদিল মোহাম্মদ নাছির, কাজল চন্দ্র দেব, আঃ মান্নান ভুঁইয়া, আব্দুর রাজ্জাক ও বর্তমান প্রধান শিক্ষক আলী মুনসুর খাঁনদের অবদানকে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বরণ করেন বক্তারা। স্কুল উন্নয়নে, নিয়ম-শৃংখলায় ও শিক্ষা বিস্তারে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির অবদানকে প্রশংসা করেন সকলেই।
সত্য, সুন্দর ও পরিপূর্ণতার পূজারী শিক্ষক: প্রয়াত আব্দুর রউফ ভুঁইয়া, মোহাম্মদ আলী (জিতু মাস্টার), মধুসুদন বাবু, কুতুবুর রহমান, প্রয়াত শফিকুল ইসলাম (বিএসসি), প্রয়াত নাজমুল ইসলাম(এম.কম), প্রয়াত আবুল কালাম আজাদ(শাহজাহান স্যার), শফিকুল ইসলাম বাবুল, গোলাম মোস্তফা মাহমুদ, নাছির উদ্দিন, এম.এ করিম বশির, তাজুল ইসলাম (এমএসসি), মনিরুল ইসলাম, রমিজ উদ্দিন স্যারসহ অত্র স্কুলে বর্তমানে কর্মরত থাকা তাজুল ইসলাম ভুঁইয়া, আরিফ মাহমুদ, শিউলি আক্তার ও নাজমা আক্তারসহ অন্যন্যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও নিরন্তর শ্রদ্ধা জানাই।
যবনিকায় আমি জোর দিয়ে বলি, গ্রামে গড়ে উঠুক খাঁ, ভুঁইয়া, চৌধুরী, আবুর, মরম আলী, সফি, গোলাম গোষ্ঠীসহ অন্যান্য গৌত্র ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মাঝে সোহার্দ- সম্প্রীতি ও ভালবাসার ঐক্য। যেখানে থাকবে না কোন আমিত্ব, থাকবে মানবিকতার এক বন্ধন। আর এই বন্ধনের মাঝেই স্মৃতির খেলাঘরে বরেণ্যদের হাতছানিতে আরও এগিয়ে যাবে প্রিয় মাতৃভূমি সৈয়দাবাদ। অত্র স্কুলের ছাত্র/ছাত্রী তথা গ্রামের নবপ্রজন্ম ছাড়িয়ে যাবে বরেণ্যদের। এই শুভকামনায় আপনাদের সকলের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা, অনেক শ্রদ্ধা ও নিরন্তর ভালবাসা জানিয়ে আজকের মত এখানেই শেষ করছি।
ধন্যবাদ, ধন্যবাদ আপনাদের প্রত্যেককে।
লেখক: তাজুল ইসলাম হানিফ, শিক্ষক ও সাংবাদিক।