বাংলা সংগীতে সুরের জাদুকর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতি সন্তান- মকসুদ জামিল মিন্টু
মকসুদ জামিল মিন্টু এদেশের অন্যতম সংগীত বিদ্যাবিশারদ। তিনি একজন ব্যক্তিই শুধু নয়; একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। যাদের হাত ধরে এদেশীয় সংগীত পৌঁছেছে অনন্য উচ্চতায়; তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম পুরোধা। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভিনদেশেও তাঁর সুনাম ও খ্যাতি রয়েছে। বাংলা সংগীত ভুবনকে তিনি একঝাঁক তারকা শিল্পী উপহার দিয়েছেন। দেশবরেণ্য এই সংগীত শিল্পীরা আধুনিক বাংলা গানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। আশির দশকের শেষভাগে একের পর এক অ্যালবাম ও চলচ্চিত্রের গান তৈরির মধ্যে দিয়ে এই কিংবদন্তি আবিভূত হয়েছেন। সংগীত ভুবনে মকসুদ জামিল মিন্টু এমনই একজন সংগীত সাধক; যাকে নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমদ সুরের যাদুকর বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাঁর আরোপিত সুর ও সংগীতের ইন্দ্রজালে অজস্র শ্রোতাকে মোহময় করে রেখেছে। তাঁর লেখা গান, সুর ও সংগীতের মাধ্যেমে তিনি অসাধারণ সুরের মূর্ছনায় শ্রোতাদের ভিসিয়েছেন। যাঁর গান মানুষ এক সময় বাড়ির ছাদ, পিকনিক, বিয়ে-সাদী ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজাত। যে গানগুলো এখনো নিজের অজান্তে মানুষের কণ্ঠে গুনগুনিয়ে ভেসে উঠে। গানের মেলোডির ঐশ্বর্যে মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। তিনি বহু গান লিখেছেন। এসব গান শুধু ভাল গানই নয়; অসম্ভব সফল ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নব্বই দশকে ক্যাসেট কোম্পানীগুলো তাঁর গান দিয়ে এক চিটিয়ে ব্যবসা করেছে। তখনকার সময় শিল্পীরা ক্যাসেটের গান দিয়েই পরিচিতি পেয়েছে। মিউজিক ভিডিওর প্রয়োজন হয়নি। তাছাড়া সে সময় মিউজিক ভিডিও একবারেই ছিল না। সংগীতের বিভিন্ন শাখায় আছে গভীর জ্ঞান। তাঁর প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, সৌজন্যে ও লৌকিকতাবোধ ইত্যাদি গুণের জন্য সব সময় তাঁর পাশে সংগীতপ্রেমিদের ভিড় জমেই থাকে। আত্মমর্যাদাবোধ তাঁর মহান ব্যক্তিচরিত্রের অনন্য সাধারণ গুণ ও প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রথম জীবনে তিনি আবদুল আহাদ, খন্দকার নূরুল আলম, সত্য সাহা, সুবল দাস, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, শেখ সাদি খানের মতো অন্যান্য অভিজাত সংগীতজ্ঞদের সাথে কাজ শুরু করেন। অসীম দুরদর্শিতা, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও কঠোর সাধনার গুণে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঈর্ষাণীয় সাফল্য লাভ করেন।
সৈয়দ আব্দুল হাদী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, সুবির নন্দী, বারী সিদ্দিকী, এন্ডু কিশোর, শুভ্র দেব, আগুন, তপন চৌধুরীর মতো অনেক বরেণ্য শিল্পীদের জন্য তিনি সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন। বাংলা সংগীতাঙ্গনে অনন্য কৃতিত্বের দাবিদার মকসুদ জামিল মিন্টু সুরকারের পাশাপাশি গীতিকার হিসেবেও অত্যার্ন্ত সফল হয়েছেন। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে ‘এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ীর আঁচল”, কোন এক সন্ধ্যায় হাজার আতঁশবাজি আর সানাইর সুর”, আমি আবার বল ভালবাসি”, জোছনা রাতে মনটা আমার”, প্রভৃতি গানগুলো সকল শ্রোতা-দর্শককে ব্যাপকভাবে বিমোহিত করে। এছাড়াও তিনি বহু জনপ্রিয় বিখ্যাত গানের সুরস্রষ্টা। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি গানগুলোর মধ্যে “একটা ছিল সোনার কন্যা”, কাইন্দা আসে ভবে মানুষ”, “বর্ষার প্রথম দিনে”, “ও আমার উড়ার পঙ্খী রে”, “আমার ভাঙ্গা ঘরে ভাঙ্গা চালা”, চাঁদনীর পসরে আমায় কে স্মরণ করে”, বাজে বংশী রাজ হংসী নাচে হেলিয়া দুলিয়া”, ওগো ভাবিজান নাও বাওয়া মর্দ লোকের কাম”, হাবলংগের বাজারে”, কত না রঙে কত না ঢঙে নাচেছিল তিনি”, ভুল করে যদি ডাকো কোনদিন”, মাথায় পড়েছি সাদা ক্যাপ”, আমার মনের ফুলদানীতে”, নন্দিতা তোমার কথা”, প্রভৃতি এমন সব অসাধারণ গানের সুর সংগীতের জাদুুুুকরী কারিগর মুকসুদ জামিল মিন্টু। শেখ ইশতিয়াক, বেবি নাজনীন, তপন চৌধুরীর মতো বরেণ্য শিল্পীদের প্রথম অ্যালবামটি ছিল মকসুদ জামিল মিন্টুর। ঐ অ্যালবামের গানগুলো যেমন ব্যাপক শ্রোতা নন্দিত হয়েছে; তেমনি শিল্পীদেরও তারকা খ্যাতি এনে দিয়েছে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি সংগীত জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দারুন সফল হয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী নাওঘাট গ্রামের প্রখ্যাত ডিপুটি (সাব) বাড়ির কৃতি-সন্তান সংগীত সাধক মকসুদ জামিল মিন্টু ১৯৫৯ সালের ২৫শে মার্চ ঢাকার আগামাসিহ লেন নানা প্রথিতযশা সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবুল কালাম শামসুউদ্দিনের বাসায় জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, নজরুল যুগে প্রতিভাধর, শক্তিমান, স্বতন্ত্র ও রোমান্টিক কবি-সাহিত্যিক, প্রবান্ধানিক, নজরুল গবেষক, সাহিত্য আলোচক, সমালোচক, গীতিকবি ও প্রবীণ সাংবাদিক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ বাংলা সাহিত্যে অসামন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ একুশে পদকে ভূষিত হন। মা লতিফা বানু কলেজ জীবনে কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতেন। সে সময় লেখাগুলো দুই বাংলার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পারিবারিক সংস্কৃতিতে তাঁর লেখালেখির প্রভাব রয়েছে। তাদের গৌরবের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে মুকসুদ জামিল মিন্টুও এক সময় বড় কবি হতে চেয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি কবিতা ও গল্প লিখতেন। তিনি কাব্য চর্চ্চা করতেন বলেই কবিতার অন্তমিল যুক্ত শব্দের ও ছন্দে প্রভাব সংগীতের দিকে ঝোঁকে পড়েন। মূলত তখন থেকেই তিনি তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, মন ও মগজে সুর, সঙ্গীত রপ্ত করতে থাকেন। শিক্ষা জীবনে তিনি ১৯৭৫ সালে ঢাকার বিখ্যাত ওয়েস্টেন স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৭৭ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আই এইচ সি এবং ১৯৭৮ সালে সরোওয়ার্দি কলেজ থেকে বিএ পাস করে সংগীত ভবনে দাবিয়ে বেড়ান। তিনি বেসরকারি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এনটিভির চীফ মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন। ব্যক্তি জীবনের তিনি শেগুফতা রব্বানীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারে ছেলে ইশরাক জামিল ও মেয়ে আয়েশা জামিল রয়েছে।
১৯৭৯ সালে সুর-সংগীতের এই মহান কারিগর বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)তে গিটার বাজানোর মাধ্যেমে সংগীত জগতে কাজ শুরু করেন। বছরখানেক পরে তিনি গিটার ছেড়ে কিবোর্ড বাজানো শুরু করেন। ১৯৮২ সালে তিনি সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সাথে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। সে বছরই অর্থাৎ ১৯৮২ সালে এন্ড্রু কিশোর তাঁর সুরে কণ্ঠ দিয়ে একটি অ্যালবাম বের করার প্রস্তাব দেন। ১৯৯২ সালে সেই অ্যালবামটি রিলিজ হয়। ১৯৮৫ সালে সারগাম থেকে প্রকাশিত শেখ ইশতিয়াকের প্রথম একক অ্যালবাম নিলাঞ্জনা অ্যালবামে সংগীত পরিচালনায় দারুন বাজিমাত করেন। সে অ্যালবামের “নীলাঞ্জনা ঐ নীল নীল চোখে”, আমি আর কারো ভালোবাসা চায় না” গান সব সময় দর্শক মাতিয়েছে। তপন চৌধুরীর কণ্ঠে “আমি অনেক ব্যাথার শ্রাবন পেরিয়ে”, কাইন্দা আসে ভবে মানুষ”, গানগুলো এখনো কানে বাজে। হৃদয়ে শিহরণ জাগিয়ে তুলে। একই সময়ে পপ সম্রাট আজম খানের একটি একক অ্যালবামে সফলভাবে সংগীত পরিচালনা করেন। ১৯৮৭ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত বেবি নাজনীনের প্রথম একক “পত্রমিতা” অ্যালবামটিতে তিনি সংগীত পরিচালনা করেন। ঐ অ্যালবামের গানেই বেবী নাজনীন তারকা খ্যাতি পান। পত্রমিতা অ্যালবামে মকসুদ জামিল মিন্টুর লেখা “এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল” গানটি বাংলা সংগীত ভুবনে ব্যাপক জনপ্রিয় গানগুলোর তালিকা স্থান করে নেয়। তারপর সারগাম থেকে প্রকাশিত শুভ্র দেবের একক অ্যালবাম “কোন এক সন্ধ্যায়”, অ্যালবামেও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সফল হয়েছিলেন। ‘হাছন রাজার গান’ সেলিম চৌধুরীর এই অ্যালবামটিও অত্যার্ন্ত সফল একটি অ্যালবাম হয়।
১৯৯৪ সালে মতিন রহমানের ‘আগুন জ্বলে’ সিনেমায় চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ঐ সিনেমার প্রযোজক চিত্রনায়ক নাঈমের অনুরোধে “এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল” গানটি আগুন জ্বলে’ সিনেমায় ব্যবহার করা হয়। এই গানের জন্য ছবিটি বাণিজ্যিভাবেও দারুণ লাভবান হয়েছিল। তারও পূর্বে ১৯৮৮ সালে আল মনসুর পরিচালিত যেখানে দেখিবে ছাই নাটকের আবহ সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তারপর বিটিভিতে প্রচালিত হুমায়ূন আহমেদের ব্যাপক জনপ্রিয় নাটক “কোথাও কেউ নেই” এর আবহ সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এখানে থেকে হুমায়ুন আহমেদের সাথে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করে প্রথমবারের মত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার ও নুহাশ পদক অর্জন ছাড়াও তিনি বাংলা সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ইমপ্রেস অন্যদিন পুরষ্কার এবং বাবিসাস পুরষ্কার অর্জন করেন। এই ছায়াছবির সুবীর নন্দীর কণ্ঠে “একটা ছিল সোনার কন্যা”, গানটি দর্শক সমাদৃত হয়। পরবর্তীতে হুমায়ূন আহমেদের ছবি ও গানের সুর-সংগীতের ক্ষেত্রে মকসুদ জামিল মিন্টু’র ওপর সবচেয়ে বেশি আস্থা ও ভরসা করতেন। তারপর তিনি একে একে হুমায়ূন আহমেদ এর দুই দুয়ারী (২০০১), চন্দ্রকথা (২০০৩), শ্যামল ছায়া (২০০৪), ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২), সহ সকল চলচ্চিত্রেই সুর-সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন অনবদ্য দক্ষতায়। এছাড়া তিনি অসংখ্য টেলিফিল্ম, নাটকে কাজ করেছেন। তাকে কখনো পর্দায় দেখা না গেলেও ১৯৯৮ সালে হুমায়ূন আহমদের বিপুল জনপ্রিয় ‘প্যাকেজ সংবাদ’, নাটকের একটি অংশে সুরকার ও সংগীত পরিচালকের চরিত্রে তাঁর অসাধরণ দুর্দান্ত অভিনয় এখনো দর্শকের মনে শিহরণ জাগায়। এ নাটকে তাঁর “চিকা মারো, মারো চিকা, চিকা মারো রে”, গানটিও অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘সবুজ সাথী’, উড়ে যায় বক পক্ষী’, নক্ষের রাত’, দ্বিতীয় জন’, যইতরী’, জুতার বাক্স’, চোর’, গ্রন্থিকগন’, কহে’, সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড’, ‘শীর্ষবিন্দু’, ‘নক্ষত্রের রাত,’ আজ রবিবার,’ তুলিতে আঁকা স্বপ্ন’, ‘মেম সাহেব ইত্যাদি।
লেখক: -মোঃ তারিকুল ইসলাম সেলিম, লোক-সাহিত্যনুরাগী, রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠক