Main Menu

নাওঘাট গ্রামে কালোত্তর কয়েকটি লাইব্রেরী – মোঃ তারিকুল ইসলাম সেলিম

+100%-

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আশুগঞ্জের নাওঘাট গ্রামে গত শতাব্দীর ত্রিশ দশকের মধ্যভাগে লাইব্রেরীর স্থাপিত হয়। মূলত শিক্ষার্থীদের পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতেই লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কালের ধারাবাহিকতায় কয়েকটি লাইব্রেরী গড়ে ওঠে। অন্ধকারে আলোর প্রদীপ লাইব্রেরীগুলো পাঠক মহলের কাছেও বেশ সমাদৃত হয়েছে। ফলে সমসাময়িক কালে লাইব্রেরী কেন্দ্রীক শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চ্চার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার নৈপর্থ্যে এমন কিছু ব্যক্তির অনবদ্য ভূমিকা ছিল; যারা সব সময় গ্রামকে নিয়ে চিন্তা করতেন এবং গ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রয়েছে। যুগ যুগান্তরে সৃজনশীল মানুষদের উদ্যোগে স্থাপিত আলোর দিশারী লাইব্রেরীগুলো শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের পাশাপাশি গ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্যে যেমন ধারণ করে আছে; আবার ঐতিহ্যের অনেক কিছুই বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেছে। সম্প্রতিক তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর তরুণ প্রজম্মকে বইয়ের পাতায় চোখ ফেরাতে কালের ধারাবাহিকতায় নাওঘাট গ্রামে আরো দু’টি লাইব্রেরীর যাত্রা শুরু করেছে। আমরা প্রয়াস ফাউন্ডেশনের সদস্যরা গ্রামের আঙিনায় জ্ঞানের আলো ছড়ানো লাইব্রেরীটি পরিদর্শন করেছিলাম।

নাওঘাট সুজেলা-কামাল গণপাঠাগার নামে একটি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা হয়েছে। লাইব্রেরীকে কেন্দ্র করে গ্রামের শিক্ষিত সচেতন মহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে। বইপ্রেমী তরুণরাও দারুনভাবে উজ্জ্বীবিত হয়েছে। নানা মহল থেকে আশানুরোপ সহযোগীতার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাচ্ছে। সুজেলা-কামাল ফাউন্ডেশনের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান নূরুজ্জামান ভূঁইয়া (মাসুম) এই লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনি নিরবে নিভৃতে গ্রামের নানাবিধ উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। ২০১৮ সালে নাওঘাট দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সঙ্গে লাইব্রেরী জন্য একটি রুম প্রস্তুত করা হয়। ২০২০ সালের শুরুতে লাইব্রেরীটি উদ্বোধনের কথা ছিল; কিন্তু বিশ্বজুড়ে করোনা প্রার্দুভাবের কারণে লাইব্রেরী কার্যক্রম কিছুটা ধীর গতিতে শুরু হয়েছে। গ্রামের শিক্ষার্থীদের বই মুখী করতেই গ্রামীন সবুজ প্রকৃতির সমরোহে অত্যান্ত মনোরম পরিবেশে এই গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা করা হয়। সুজেলা-কামাল ফাউন্ডেশনের অন্তভুক্ত গণ-পাঠাগারটি গ্রামের আপামর জনসাধারণের সুবিধার্থে সকলেই বংশ পরিচয়ের উর্ধ্বে এসে পরিচালানার দায়িত্ব গ্রহন করতে পারবে। নাওঘাট সুজেলা-কামাল গণ-পাঠাগার গ্রামে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ও প্রসারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। পাঠকের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও  বিবিধ বইয়ে একটি পুর্নাঙ্গ সমৃদ্ধ লাইব্রেরীতে পুরিপূূণ হচ্ছে। এই লাইব্রেরী গ্রামীন ইতিহাস ঐতিহ্যে কৃষ্টি কালচার সংগ্রহ করা হবে। এছাড়াও নাওঘাট গ্রামের কৃতিসন্তান বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, রাজনীতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ব্যক্তিদের কর্মময় জীবনের উপর একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরার পশাপাশি ঐ সকল ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের দুর্লভ ছবির একটি গ্যালারি থাকবে; যেখান থেকে অনেকেই তাদের পারিবারিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। নাওঘাট মৌজার ম্যাপ ও নক্সা সংরক্ষন করা হবে। নাওঘাট সুজেলা-কামাল গণ-পাঠাগার সম্পূর্ণ সময় উপযোগীভাবে গড়ে তোলা হবে। যেখানে পাঠক গ্রন্থপাঠ, গবেষণা, লেখালেখি ও তথ্যানুসন্ধান করতে পারেন। শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশে মহান এই লাইব্রেরীর পরিচালনা কমিটি ও গ্রামবাসীর সমন্বিত প্রচেষ্টায় ও সহযোগীতায় নাওঘাট গ্রাম-সহ আশপাশের গ্রামগুলোও আলোকিত হবে।

নাওঘাট গ্রন্থাগার: এই প্রজন্মের আলোর প্রদীপ জ্বালানিয়া নারী বিনতে মাসুমা সাঈদ-এর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় নাওঘাট গ্রন্থাগার নামে একটি লাইব্রেরী সম্প্রতিক যাত্রা শুরু করেছে। এই গ্রামে প্রথম নারী লাইব্রেরী উদ্যোক্তা আমেনা খাতুনের ভাবশিষ্য বিনতে মাসুমা সাঈদ গ্রামে একটি লাইব্রেরীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই দুই সময়ে দুজনকে একই ভাবনায় দেখা গেল। নব্বই বছর আগে ও পরে এই দু’জন নারীর মধ্যেই চৎমকার একটি মিলও রয়েছে। দুইজনই শিক্ষিকা। বিনতে মাসুমা সাঈদ পড়ালেখা ও শিক্ষকতার পাশিপাশি নিয়মিত সাহিত্য চর্চ্চা করেছেন। তিনি গল্প, কবিতা লেখালেখিতেও বেশ স্বযশী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে মাস্টার্সে অধ্যায়নরত এই তরুণী পড়াশোনার পাশাপাশি একটি মাদ্রাসায় শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। পেশায় শিক্ষিকা মাসুম সাঈদ নাওঘাট গ্রামে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তার উদ্যোগের ভিত্তিতে প্রিয় নাওঘাট গ্রুপ ও গ্রামের নবীন প্রবীণদের আন্তরিক সহযোগীতায় নাওঘাট দক্ষিনপাড়া (মাগুড়া) বিনতে মাসুমা সাঈদের পিত্রালয়ে লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আশা রাখা যায়; আশা জাগানিয়া নাওঘাট গ্রন্থাগার পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী সকল বিষয় বইয়ে একটি পুর্নাঙ্গ লাইব্রেরীতে পরিনত হবে।

যুগান্তর গণপাঠাগার: ২০০০ সালে কয়েকজন সাহিত্যনুরাগী ব্যক্তির সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় নাওঘাট গ্রামের সীমান্ত রেখায় তালশহর রেলস্টেশনে যুগান্তর গণপাঠাগার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রথিতযশা শিক্ষক ওয়ালীউল ইসলাম বাশার মাস্টারের প্রেরণায় স্টেশনের বড় মাষ্টার সফিকুল আলম, সাংবাদিক হেলাল উদ্দিন হিলু, সাংবাদিক কাজী আকতার হোসেন, শ্যামল মৃধা প্রমুখদের উদ্যোগী ভূমিকায় লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তাঁদের এই মহৎ উদ্যোগের অংশীদার হতে এলাকার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিজনরা এগিয়ে আসেন। সাধারণ মানুষও পছন্দের বিষয়ে বই দিয়েছে। লাইব্রেরীর পাঁচটি সেল্ফে অনেক মূল্যবান বই সাজানো আছে। প্রতিদিন চারটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা রাখা হতো। স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত যাত্রীরা লাইব্রেরীতে গ্রন্থপাঠ ও পত্রিকা পড়ে সময় কাটাত। উল্লেখ্য যে সফিকুল আলম পাশ্ববর্তী নবীনগর উপজেলার নবীপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। কর্মজীবনের বেশীভাগ সময় তালশহর রেলওয়ে স্টেশনে কাটিয়েছেন। তিনি তাঁর কর্মস্থলে পাঠাগারের জন্য একটি রুমের ব্যবস্থা করেন। যুগান্তর পাঠাগারের পাশের একটি রুমে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের অফিস রয়েছে। লাইব্রেরীতে নিত্যদিন পাঠক ভিড়ে জমজমাট ছিল। তিনি কয়েক বছর পূর্বে আবসরে যাওয়ার পর পাঠাগারটি সংকটে পড়ে যায়। তাতে লাইব্রেরী কেন্দ্রীক পাঠকের উপস্থিতি ভাটা পড়ে। যুগান্তর গণপাঠাগার প্রায় ছয় সাতটি গ্রামের অসংখ্য সাহিত্যপ্রেমী পাঠকদের মধ্যে জ্ঞানের আলো বিলিয়েছে।

ব্যারিস্টার রাবিয়া ভূঁইয়া ইসলামিক লাইব্রেরী: ১৯৮৬ সালে ব্যারিস্টার রাবিয়া ভূঁইয়ার উদ্যোগে নাওঘাট আব্দুর রউফ ভূঁইয়া দাখিল মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে ব্যারিস্টার রাবিয়া ভূঁইয়া ইসলামিক লাইব্রেরী নামে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এটি গ্রামের বাতিঘর হিসেবেও পরিচিত ছিল। আলোকবার্তিকা লাইব্রেরীতে ইসলামিক বইয়ের পাশাপাশি সব ধরনের বই সংরক্ষনে ছিল। পাঠকরা তাদের পছন্দের বই নিয়ে পড়তে পারতেন। এজন্য লাইব্রেরীর সদস্যপদ গ্রহন বা কারো রেফারেন্সের প্রয়োজন হয়নি। তবে কেউ বই বাহিরে নিতে চাইলে অবশ্যই তাকে পাঠকের ইনফরমেশন ও বইয়ের নাম লিখে লাইব্রেরীয়ানের কাছে জমা দিয়ে যেতে হতো। ঐ সময় গ্রামে সামাজিক কোন সংগঠন ছিল না; লাইব্রেরীকে কেন্দ্র করেই যুব সমাজের মধ্যে সামাজিক ও সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সবার জন্য উন্মুক্ত ব্যারিস্টার রাবিয়া ভূঁইয়া ইসলামিক লাইব্রেরী দীর্ঘদিন পাঠক মহলের বই তৃষ্ণার খোরাক যুগিয়েছে।

ঘরে লাইব্রেরী: ১৯৩০ সালে নাওঘাট গ্রামে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণাদায়ী নারী আমেনা আমেনা খাতুন বাবার বাড়িতে একটি লাইব্রেরী গড়ে তুলেন। এই লাইব্রেরীতে নানা বিষয়ে গ্রন্থাদি ছাড়াও “সওগাত”, “মোহাম্মদী”, “পরিচয়”, “চতুরঙ্গ” “বেগম” ইত্যাদি ম্যাগাজিন, ও পত্র-পত্রিকা ছিল। সে সময় বই অনুরাগী ছেলে-মেয়েরা পাঠাগার থেকে বই পাঠের সুযোগ পেয়েছিল। শুধু তাই নয়; এই মহীয়সী নারী গ্রামের বাড়ি বাড়ি বই পৌছে দিতেন। বিশেষ করে শিশুদের লেখাপড়ার জন্য আগ্রহী করতে আরবী শিক্ষা, আদর্শলিপি/ বাল্যশিক্ষা ও ছড়ার বইয়ের সাথে মায়েদের জন্য ইসলামিক বই, ছোট গল্প, উপন্যাসের বই পাঠাতেন। বেগম রোকেয়ার আদর্শে অনুপ্রাণীত হয়ে আমেনা খাতুন মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা দিতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন গ্রামের ঐতিহ্যশীল ভূঁইয়া পরিবারের সন্তান আব্দুর রউফ ভূঁইয়ার স্ত্রী ও ওয়ালীউল ইসলাম বাশার স্যারের বড় বোন এবং প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহের ভূতপূর্ব উপাচার্য্য প্রফেসর ড. জহিরুল হক ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার মোজাম্মেল হক ভূঁইয়ার মমতাময়ী মা। এই মহীয়সী নারীর উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টায় লাইব্রেরীটি দীর্ঘদিন গ্রামবাসীর মাঝে জ্ঞানের আলো বিলিয়েছে।

আদর্শ ক্লাব লাইব্রেরী: ১৯২৫ সালে নাওঘাট ডিপুটি বাড়িতে “আদর্শ ক্লাব” নামে একটি লাইব্রেরী গড়ে ওঠে। লাইব্রেরীতে দুই বাংলার খ্যাতিমান লেখক, গবেষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের লেখা প্রচুর বই পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের সমাহার ছিল। তৎকালীন সময় এ গ্রামের কৃতিসন্তান ডিপুটি সেক্রেটারি আব্দুর রহিমের কর্মস্থল কলকাতা ছিল। আব্দুর রহিম  কলকাতা থেকে প্রচুর বই এনে বাড়িতে একটি লাইব্রেরী তৈরি করেন। সেকালে লাইব্রেরীটি নাওঘাট গ্রাম ও পাশবর্তী গ্রামের স্কুল, কলেজ পড়ুয়া বইপোকাদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় স্থানে পরিনত হয়েছিল। আড্ডা, খেলাধুলার পাশাপাশি লাইব্রেরীতে বইপ্রেমী পাঠকদের উপস্থিতি ছিল। আদর্শ ক্লাব লাইব্রেরী ঘিরে প্রচুর সাহিত্যনুরাগীদের আনাগোনা ছিল। লাইব্রেরীতে আশেপাশের গ্রামের পাঠক সদস্যরা এসেও পছন্দের বই পড়তো। কবি মোহাম্মাদ মাহফুজউল্লাহ’র কৈশোর কালের কথা ও সাহিত্য জীবনের সূচনা পর্ব গ্রন্থে আদর্শ ক্লাব লাইব্রেরীর কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। সেকালে নাওঘাট গ্রামে জনবসতির তুলনায় লাইব্রেরীর অনেক পাঠক সদস্য ছিল। আদর্শ ক্লাব পাঠাগারের মূলতঃ লক্ষ ও উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধন করা।

লেখক: লোক-সাহিত্যনুরাগী রাজনীতিক কর্মী ও সংগঠক






Shares