জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম
জাতি বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে স্মরণ করলো… জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনটিকে। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
‘গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টান’ এভাবেই গেয়ে উঠতেন সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম।দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা দিয়ে গেছেন কাজী নজরুল ইসলাম।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি তিনি। এই কবির ১১৮তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই জাতীয় কবিকে।
১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’।
বিপ্লাবিক রোমাঞ্চে উদ্ভুদ্ধ হয়ে যোগ দেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে ছাড়েন সেনাবাহিনী। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনেও যোগ দেন নজরুল, যার বিস্ফোরন ১৯২১ সালের বিদ্রোহ। নবযুগ পত্রিকার হাত ধরে শুরু হয় সাহিত্য ও সাংবাদিকতার চর্চা।
সুন্দরের প্রতি সহজাত কবি নজরুল আজীবন প্রেমে আগ্রহী ছিলেন। তাইতো সুন্দরের প্রশংসায় সৃষ্টি হয়েছে তার কবিতা ও গান।কী কবিতায়, কী গানে, উপন্যাসে, গল্পে সর্বত্রই মানবমুক্তি প্রেমময় বাণী ও দ্রোহের বাণী। জাতীয় কবি নজরুল দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েও ছিলেন অসাম্য, অসুন্দর ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অক্লান্ত বিদ্রোহী চির উন্নত শির।
শুধু প্রেম বা ভালোবাস নয় নজরুল হয়ে উঠেছিলেন সাম্যবাদী, শুনিয়েছেন সাম্যের গান।মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য।সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধী সৈনিক নজরুল’।
:
বিদ্রোহী কবি হলেও নজরুল ছিলেন চির তারুণ্য ও প্রেমের কবি। একইসঙ্গে দ্রোহ ও প্রেমের অপূর্ব সমন্বয় দেখিয়েছে তিনি।
বরেণ্য এ কবি নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতা কাজী ফকির আহমেদকে হারিয়ে এলামেলো হয়ে যায় সামনে চলার পথ। আর্থিক অনটনে পড়ে বই-খাতা রেখে রোজগারে নেমে পড়তে বাধ্য হন নজরুল। কখনও মসজিদের ইমামতি, মাজারের খাদেমগিরি, চায়ের দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে তাকে। ছেলেবেলায় তার নাম রাখা হয় ‘দুখু মিয়া’। তার পিতার নাম ছিল কাজী ফকির আহমদ। মাতা জাহেদা খাতুন। তারা ছিলেন তিন ভাই দুই বোন। নজরুল শৈশবেই পিতাকে হারান।
আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটির কাজ করার সময় সেখানে কর্মরত দারোগা রফিজ উল্লাহ’র সঙ্গে পরিচয় হয় নজরুলের। তিনি কিশোর নজরুল নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। এটা ১৯১৪ সালের কথা। মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন নজরুল ইসলাম। অংশ নেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে।
প্রেম, বিয়ে-বিচ্ছেদ, গ্রেফতার, সমাবেশ এবং কাব্য ও সংস্কৃতিচর্চাসহ বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী কুমিল্লা শহর। কুমিল্লা জেলার দৌলতপুরে সৈয়দা খাতুন নামে এক কিশোরীকে তিনি ভালো বেসেছিলেন। নাম রেখেছিলেন ‘নার্গিস’। ১৯২১ সালে বিয়ের দিনেই তাদের বিয়ে ভেঙে যায়। নার্গিসকে নিয়ে তিনি লেখেন, ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, কেন মনে রাখো তারে’। পরে কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে তিনি পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সঙ্গে। তার সঙ্গে প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল বিদ্রোহী কবির।
:
ময়মনসিংহের ত্রিশাল, কুমিল্লার দৌলতপুর ও চট্টগ্রামে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় কবির ১১৮তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হবে।
নজরুল বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ইতিহাস ও সময় সচেতন মানুষ ছিলেন নজরুল; তার লেখায় এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল।
তিনি আরও বলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ নজরুল। তার লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তার কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে।
মানবতা আর অসাম্প্রদায়িকতার সংগ্রামে গড়েন বিদ্রোহের দূর্গ। সব মত-পথ এবং ধর্মের বিভেদে ভুলে করে গেছেন মুক্তির সংগ্রাম। জাতীয় কবির মর্যাদায় সিক্ত এ কবি সাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন বাংলার অবহেলিত মানুষের জীবন থেকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।
প্রেম আর দ্রোহের মেলবন্ধনে অনন্য কাজী নজরুল ইসলাম। সৃষ্টির সুখ দিয়ে তিনি উল্লাস করেছেন আর মানুষকে ভাসিয়েছেন আনন্দসাগরে। শেকল ভাঙ্গার গান শুনিয়েছিলেন পরাধীন
স্বাধীনতার লাভের পর পরই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্বপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তার বসবাসের ব্যবস্থা করেন।
:
এক তথ্যে জানা যায়,তিনি ২০ বছরের মতো সময়কালে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি সঙ্গীত রচনা করেন। বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামি ভাবধারার উন্মেষ ঘটান। তিনি গজল রচনা করেন। তার জাগরণের আহ্বানে তৎকালীন পশ্চাদপদ সমাজ ব্যবস্থায় প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তিনি ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে যেমন কলম ধরেছেন ঠিক তেমনি সমাজের যেখানেই অন্যায়, অসত্য, ভণ্ডামি, কূপমণ্ডূকতা দেখেছেন কাব্য ও সাহিত্যে তার প্রতিবাদ করেছেন। নজরুল সাম্যবাদের প্রবক্তা ছিলেন। কলকাতায় তার বন্ধু কমিউনিস্ট নেতা মুজাফফর আহমদের সাথে ঘনিষ্ঠ হলেও তিনি কখনোই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হননি। নজরুলকে নিয়ে সে যুগেও রশি টানাটানি কম হয়নি। কিন্তু তিনি কখনোই নিজের বিশ্বাসের সাথে আপস করেননি। তিনি যেমন লিখেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতুর্য্য…’। তেমনি লিখেছেন, ‘উহারা চাহুক দাসের জীবন আমরা শহীদী দরজা চাই, নিত্য মৃত্যু ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই।’ আবার প্রেমের কাব্য রচনা করতে গিয়ে নজরুল লিখেছেন, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী,দেব খোঁপায় তারার ফুল, কর্ণে দুলাব তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল। ইসলামি ভাবধারার সঙ্গীত রচনাকালেও নজরুল নতুন যুগের সৃষ্টি করেন। তিনি লেখেন, ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান।’ আবার তার রাসূল সা: প্রশস্তি ছিল অসাধারণ। যেমন: ‘মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, তাই কিরে তোর কণ্ঠেরই গান এতই মধুর লাগে।’ মহান আল্লাহর প্রতি তার গভীর বিশ্বাসের প্রমাণ মেলে ইসলামি সঙ্গীতে। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার তুমি হবে কাজী, সেদিন তোমার দীদার আমি পাবো কি আল্লাজী।’
:
১৯৪২ সালে আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়েন নজরুল। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রতিভার এ কবি পিকস ডিজিজে আক্রান্ত। এক পর্যায়ে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন চিরবিদ্রোহী এ কবি। এতে তার সাহিত্যচর্চা পুরোপুরি থেমে যায়।
চিরবিদ্রোহী এ কবি ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি লিখেছিলেন- “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে হতে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই। ‘আজান’ কবিতায় চাওয়া শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয় চির জাগরণের এ কবিকে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন।
লেখক :
মোঃ তাজুল ইসলাম (হানিফ) , বিএসএস (অনার্স), এমএসএস (রা.বি), এলএলবি।
শিক্ষক—-সৈয়দাবাদ আদর্শ মহাবিদ্যালয় (অনার্স কলেজ),কসবা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ।