এক মহান ব্যক্তিত্ব ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া: মোঃ তারিকুল ইসলাম সেলিম
এক মহান ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া । সংক্ষেপে ( আর. আই ভূঁইয়া ) নামেই সকল মহলে তাঁর পরিচয় সমাদৃত । পরিচ্ছন্ন রুচিশীল অভিজাত ব্যক্তিত্বের অধিকারী সর্বোজন শ্রদ্ধীয় ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার কর্মজীবনের সোনালী অধ্যায় ছিল অত্যার্ন্ত গৌরবের । মানবতাবাদী, পরোপকারী একজন ভালো মানুষ হিসেবে সমাজে তাঁর সুুখ্যাতি ও সম্মান আজও পর্বতসম । বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেই থাকে মনুষ্যত্বের পরিচয়, সত্যিকার মানুষের মহানুভবতা । সেজন্য তিনি আমাদের কাছে সব সময় রয়েছেন কিংবন্তিতুল্য । যাঁর কথা সামনে আসলে এক ধরনের শ্রদ্ধা-সম্মান-ভালবাসা ও ভুক্তিপূর্ণ মনোভাব সবার মাঝে অনুভূত হয় । তাঁকে আজও বলা হয় এতদঞ্চলের অসংখ্য সাধারণ মানুষের ভাগ্যন্নোয়নের লাকি কয়েন । তিনি বহু মানুষের ভাগ্যন্নোয়নে নিজে হাতে কাজ করেছেন । জনবান্ধব একজন উচ্চুপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার যখন সুযোগ এসেছে তখনই তিনি মানুষকে রেলওয়েতে নিয়োগ দিয়েছে । তিনি পূূর্ববাংলার রেলওয়েতে যোগদানের পর সময় সুযোগে যাঁরাই চাকুরীর সন্ধানে তাঁর কাছে আসছেন। কাউকে বিমুখ করে ফিরিয়ে দিয়েছেন এমন কোন নজির কারো কাছেই নেই । তিনি প্রত্যেকের শিক্ষা-দীক্ষার যোগ্যতানুযায়ী পূর্ববাংলা রেলওয়ে অর্থাৎ ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে (ইপিআর)-এর নিয়োগ দিয়েছেন ।
ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ১৯৩৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার সূর্য্য-সন্তাদের প্রসূতিগারখ্যাত রত্নগর্ভা নাওঘাট গ্রামে ঐতিহ্যবাহী প্রখ্যাত মোক্তার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন । বাবা ঐতিহাসিক মোক্তার ও প্রথিতযশা রাজনীতিক আব্দুল হামিদ ভূঁইয়া ছিলেন মুহকুমা ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুসলিম লীগের জেলারেল সেক্রেটারি । ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শহর ও গ্রামে শিক্ষা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা স্বর্ণ উজ্জ্বল । মা সুফিয়া খাতুন ছিলেন সমাজে একজন সংগ্রামী নারী । তাঁদের তিন পুত্র ও দুই কন্যা সন্তান নিয়ে যখন সুখের সংসার । তখন স্বামীর অকাল মৃত্যুতে সংসারে আঁধার নেমে আসে । তিনি তখন শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরেন । তিনি প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না । প্রচন্ড শিক্ষানুরাগী ছিলেন বলেই তিনি সব সন্তানদের উচ্চশিক্ষা দিতে পেরেছিলেন । শুধু ছেলে-মেয়েদেরই নয়, বিএ পাড়ুয়া পুুুুত্রবধূ প্রফেসর মাহফুজা খানম-কেও মাতৃস্নেহে মাস্টাস ডিগ্রী অর্জনে সার্পোট দিতেন । ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া অর্ত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং সব পরীক্ষায় অসাধারন কৃতিত্বের পরিচয় দেন । প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের শুরুতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন । তারপর ১৯৫২ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্নদা হাই স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে এস এসসি পাস করেন । ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই এস সি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উর্ত্তীন্ন হন এবং ১৯৫৮ সালে আহসানউল্লাহ (বর্তমানে বুয়েট) কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কৃতিত্বের সাথে পাস করেন ।
তখনকার সময় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর থেকেই সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বহু বড় বড় লোভনীয় চাকুরীর অফার আসতো । সব কিছু অপেক্ষা করে তিনি ১৯৫৯ সালে ACE কনসান্টিং ফার্মে নামে একটি কোম্পানীতে যোগদান করেন । তিনি এখানে ৪ চার বছর কাজ করেন । তারপর ১৯৬২ সালে পূর্ববাংলা রেলওয়েতে এসেস্টেন্ট এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে যোগদান করেন । ১৯৬৪ সালে তিনি এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হন । ১৯৭৩ সালে ডিপুটি ইঞ্জিনিয়ার হন । ১৯৭৮ সালে তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান । ১৯৭৯ সালে শেষ সময় তিনি যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ে এডিজি হন ( উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ও যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ে এডিজি একই পদমর্যাদা )। তারপর ১৯৮০ সালে যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ে এডিশনাল সেক্রেটারি (অতিরিক্ত সচিব) হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন ।
১৯৯৪ সালে খ্যাতিমান এই কৃতিপুরুষ কর্মজীবনের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে অবসর গ্রহন করেন । অবসর গ্রহনের পর বঙ্গবন্ধু (যুমনা) সেতুর রেলওয়ে প্রকল্পের কনসাল্টিং টিমের প্রধান হিসেবে ৫ বছর কাজ করেন । দীর্ঘ কর্মজীবনে নীতি আর্দশে অবিচলতায় অর্থ-বিত্ত লোভ-লালসা নিজের মধ্যে কখনও প্রশ্রয় দেননি । তাঁর কর্মকৌশল মেধা, সততা, দক্ষতা, নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের মাধ্যেমে তিনি চাকরি ক্ষেত্রে সকল মহলে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিলেন ।
ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া সমাজের অতিদরিদ্র মানুষের জন্য অনবত কাজ করে যাচ্ছেন । নাওঘাট গ্রামসহ এতদঞ্চলের দরিদ্র নিপীড়িত মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট আছেন । ২০০৩ সালে নাওঘাট আব্দুল হামিদ ভূঁইয়া মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন তাঁর বিশেষ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত করেন । এ প্রতিষ্ঠানটি নিরবে-নিভৃতে বেশ কয়েটি গ্রামে সমাজে পিছিয়ে থাকা হত-দরিদ্র জনমদুঃখি মানুষদেরকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছে । তিনি এখনো মানুষের কল্যাণে অবকাশকালীন সময় কাটিয়ে যাচ্ছেন । ক্লান্তিহীন যাত্রায় এক অভিযাত্রীর সময়ের চাকা ঘুরতে ঘুরতে এখন তাঁর বয়স পাঁচ আশিতে গড়িয়েছে । তাঁরপরও যখনই তিনি সময় পান তখনই ছুটে যান গ্রামের সাধারণ মানুষদের কাছে, ভালো লাগা ও ভালোবাসার টানে মাতৃত্বের বন্ধনে প্রিয় জন্মভূমি নাওঘাট গ্রামে । এই মহান মানুষটির মহানুভবতা কখনও ভুলার নয় । তাঁর মতো মহৎ উদ্যোগী ও মানবদরদি একজন রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া যদি ঘরে ঘরে জন্ম হতো তাহলে সমাজের চিত্রই পাল্টে যেত । বেকারত্ব সমাজ থেকে নির্বাসিত হতো ।
ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার পরিবার বাংলাদেশে মর্যাদার সাথে খুবই পরিচিত ও সু-প্রতিষ্ঠিত । তাঁর বড় বোন শিক্ষাবিদ বেগম শামসুন্নাহার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মুহকুমার প্রথম নারী হিসেবে বি.এ পাস করেন । ছোট ভাই দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ভাই মরহুম আতিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ছিলেন উত্তরা ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক এবং পরবর্তীতে তিনি উত্তরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এম,ডি) থাকা অবস্থায় পরলোক গমন করেন । তৃতীয় ভাই পানি বিজ্ঞানী ড. সাদিকুল ইসলাম ভূঁইয়া সিভিল ইঞ্জিনিয়ার । তিনি ফিলিপাইনের ম্যানিলায় সায়েন্টিফিক কর্মকর্তা ছিলেন । তিনি পানি ও ধান গবেষণার ওপর দেশ-বিদেশে বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে অংশ গ্রহন করেন এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকেন। ছোট বোন আশরাফুন্নাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন এবং ইংল্যান্ডে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন । ব্যক্তিগত জীবনে ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ১৯৬৪ সালে মাহফুজা খানম এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । তিনি তিন কন্যা সন্তানের জনক তাঁর স্ত্রী জগন্নাথ কলেজ এর ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন । বড় মেয়ে সাবিনা রফিক বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে সির্ভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বর্তমানে আমেরিকার হিউজটনে কর্মরত আছেন । দ্বিতীয় মেয়ে সামিনা রফিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টাস পাশ করে এবং আমেরিকা অব ডালাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা (Education)-এর মাস্টাস করেন । তারপর তিনি মেরিল্যান্ডের একটি বিখ্যাত স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন । তৃতীয় মেয়ে সাদিয়া রফিক দিল্লিতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনলজি (আই.আই.টি) থেকে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করে ইউনির্ভাসিটি অব মেরিল্যান্ড থেকে কৃতিত্বের সাথে মাস্টার্স পাশ করেন । তিনিও বর্তমানের আমেরিকা এরিজোনা কর্মরত আছেন । গর্বিত পরিবারের সন্তান হিসেবে আব্দুল হামিদ ভূঁইয়া মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের কল্যাণে তারাও এলাকার গরীব দুঃখী মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন । ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া বর্তমানে উত্তরা ৪ নাম্বার সেক্টর ২ নাম্বার রোডের ২৬ নাম্বার বাড়িতে স্ব-স্ত্রীক বসবাস করছেন । তিনি উত্তরা ৪ নং সেক্টর কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন । বৃহত্তর উত্তরা সমিতির সহ-সভাপতি-ও ভোটে নির্বাচিত হন । তাঁর শ্রম ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টায় উত্তরা সমিতি সংগঠনকে বিরাট অবস্থানে দাঁড় করেছেন । সবশেষে মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনের কাছে তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর জন্য প্রার্থনা করি ।
লেখক: লোক-সাহিত্যনুরাগী, রাজনীতিক কর্মী ও সংগঠক।
« কবি আল মাহমুদের ৮৩তম জন্মদিন আজ (পূর্বের সংবাদ)