মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ও তার ইসলাম বিদ্বেষ (পর্ব-১)
মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ও তার ইসলাম বিদ্বেষ
মূলঃ মোঃ এলফি নিশায়েম জুফেরি
( ইংরেজী থেকে অনুদিত)
সার সংক্ষেপঃ
এই বক্ষ্যমান নিবন্ধে সেকুলার তুরস্কের জনক মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক এর সংক্ষিপ্ত জীবনী আলোচিত হয়েছে। তুরস্কে এখনো তার নীতি ব্যাপক ভাবে চর্চিত হয়, যদিও সেখানে একটি ইসলাম পন্থি সরকার ক্ষমতায় আছে। বেশ কয়েক বছর আগেও সেখানে মহিলারা সরকারী ভবন বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরিধান করতে পারত না, কারন তা সেখানে মৌলবাদের চিহ্ন হিসাবেই দেখা হতো। এমন অনেক সময়, অনেক তুর্কীকে দেখা গেছে, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে হৈ হুল্লোড় করে মদ পান করতে । এটাকে পর্যবেক্ষকরা মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক এর গৃহীত নীতির ফল হিসাবেই মূল্যায়ন করেন। যদিও এখন সে সমাজে পরিবর্তন দৃশ্যমান। যারা আল্লাহর পথে চলে আল্লাহ তাদের কল্যাণ দান করুন। আমীন।
আতাতুর্ক এর প্রারম্ভিক জীবনঃ
মুস্তফা কেমাল আতাতুর্ক ( তুর্কী ভাষায় কামাল কে কেমাল বলে) ১৮৮১ সালে সালোনিকাতে এক জীর্ণ কোয়ার্টারে জন্মগ্রহন করেন। একজন সামান্য কেরানি হিসেবে সরকারী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর, তার পিতা, আলি রিজা দুই বার ব্যাবসা প্রচেষ্টায় ব্যার্থ হন। জীবনের দুঃখ দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে তিনি মদের দ্বারস্থ হন। যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে যখন তিনি মৃত্যু বরণ করেন, তখন মুস্তফার বয়স মাত্র ৭ বছর। তার মা জুবায়দা, পরিপূর্ণ নিরক্ষর একজন মহিলা, কড়া পর্দার মধ্যে থেকে সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে নেন। তাঁর স্বামীর বিপরীতে, তিনি ছিলেন একজন দৃঢ়বিশ্বাসী, ধর্ম পরায়ণ মুসলমান। তাঁর সময়ের অন্যান্য সকল তুর্কী নারীর মত, তাঁর সম্পূর্ণ জীবন আবর্তিত হয় তাঁর বড় ছেলেকে কেন্দ্র করে। গভীর ধর্মানুবর্তিতার কারণে তিনি চেয়েছিলেন, বড় হয়ে তাঁর ছেলে একজন নামকরা ইসলামী স্কলার হবেন, কিন্তু ছেলের ছিল অন্য ভাবনা।
সে যে কোনো ধরনের কর্তৃত্বের বিরূদ্ধে কঠিন লড়াই করত, তার শিক্ষকদের সাথে প্রকাশ্যে ঔদ্ধত্তমূলক আচরণ করত এবং গালি বর্ষন করত। বিশেষ করে তার সহপাঠিদের উপস্থিতিতে আত্মম্ভরিতা ছিল সীমা ছাড়ানো, এবং কারো সাথেই কোনো প্রকার খেলায় অংশ গ্রহণ করতে চায়তনা। সঙ্গত কারনেই তিনি ছেলেদের মাঝে একজন অজনপ্রিয় ব্যাক্তিতে পরিণত হন। যদি তার রাস্তায় কেউ বাঁধা হয়ে আসত, তিনি তার সাথে লড়াই করতেন এবং একা খেলাই তার জন্য শ্রেয় বলে ধরে নিতেন। এ রকমই কোন এক ঘটনায়, এক শিক্ষক রাগে অন্ধ হয়ে তাকে প্রচন্ড ভাবে প্রহার করেন, যাতে তার আত্ম-সম্মানবোধ মারাত্মক আহত হয়। মুস্তফা স্কুল থেকে পালিয়ে আসেন এবং সেখানে ফিরে যেতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জানান। যখন তার স্নেহময়ী মা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, সে ক্ষুব্ধ হয়ে মায়ের সাথে রূঢ় আচরণ করেন। জুবায়দা হতাশ হয়ে পড়েন এবং বুঝতে পারছিলেননা যে তিনি কি করবে। শেষে তার এক চাচা পরামর্শ দেন যে, তাকে ইস্তাম্বুলে সামরিক ক্যাডেট স্কুলে পাঠানোর পরামর্শ দেন, যাতে করে সে একজন সৈনিক হিসাবে গড়ে উঠতে পারে।
যেহেতু এটা ছিল সরকারী ভর্তুকি প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান, সেখানে তাদের কোন খরচই লাগবেনা; যদি ছেলেটি সেখানে তার সামর্থ্য প্রদর্শন করতে পারে, তাহলে সে একজন অফিসার হতে পারবে, আর না হলে অন্তত একজন সিপাহী হিসাবে থাকতে পারবে। যাই হোক, সেখানে তার ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা ছিল। যদিও জুবাইদার এতে কোনো সায় ছিলনা, তবে সে তার সন্তানকে বাধা দেবার পুর্বেই, ১২ বছর বয়সী মুস্তফা তার পিতার এক বন্ধুর দ্বারস্থ হন, যাতে করে তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষ কে অনুরোধ করেন তার ব্যাপারে। তিনি ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন এবং একজন ক্যাডেট হিসাবে পরীক্ষায় পাশ করেন।
এখানেই তিনি নিজেকে খুঁজে পান। একাডেমিক ভাবে তিনি এতটাই সফল ছিলেন যে, তার এক শিক্ষক অংকে এবং সামরিক বিষয়ে পারদর্শিতা প্রদর্শনের কারণে তাকে কেমাল উপাধি প্রদান করেন, আরবীতে যার অর্থ নিখুঁত। তাকে সেখানে শিক্ষকের পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয় যা তাকে শ্লাঘার সাথে তার কর্তৃত্ব উপভোগ করার সুযোগ প্রদান করে।
১৯০৫ সালে চুড়ান্ত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়ে সম্মানের সাথে তার শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং তাকে ক্যাপ্টেন পদে পদায়ন করা হয়।
এই সময় সে ভাতান বা “ পিতৃভুমি’ নামে একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ছাত্র সঙ্গঠনের সাথে যোগ দেন। ভাতানের সদস্যরা নিজেদের বিপ্লবী বলে পরিচয় দিতেন এবং গর্ব বোধ করতেন। তারা কট্টর ভাবে দ্বিতীয় সুলতান আব্দুল হামিদ এর নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে শত্রু ভাবাপন্ন ছিলেন, তারা তাকে তথা-কথিত উদারপন্থি ধ্যান-ধারণাকে (যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক) নস্যাৎ কারী হিসাবে দোষারোপ করতেন। তারা কখনো তুর্কীদের পশ্চাদপদতার জন্য ইসলামকে দায়ী করতে দ্বিধাবোধ করতনা, তাদের সকল তিক্ততা বিষোদ্গারের লক্ষ্য ছিল সু –প্রাচীন শরীয়া ব্যাবস্থা, তারা সুফি সাধকদের বিশেষ ভাবে ব্যাঙ্গের বিষয়ে পরিণত করেছিল। ভাতানের সদস্যরা শপথ গ্রহন করেছিল যে, তারা বৈধ সালতানাতকে উৎখাত করে সেখানে সংবিধান ও সংসদ সহ পশ্চিমা ধাঁচের সরকার বসাবে এবং উলামাদের কর্তৃত্বের অবসান ঘটাবে। তারা পর্দা প্রথার অবসান ঘটানোর মাধ্যমে নারী-পুরুষের পরিপুর্ণ সাম্য আনয়ন করবে। শিঘ্রই মুস্তফা কামাল এই সংগঠনের প্রধানে পরিণত হন।
১৯০৮ সালে তরুন তুর্কীদের (Young turks) দ্বারা সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের উৎখাতের অব্যব্যাহতি পূর্বে অবশেষে মুস্তফা কামাল তার প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পান। তরুন তুর্কী এবং এর শাসক দল (The Committee of Union and Progress) তাকে আমন্ত্রন জানান তাদের সাথে যোগদানের জন্য। কিন্তু বিলম্বে যোগদান কারী সদস্য হিসাবে, সে শুধু আদেশ পালনে বাধ্য ছিল, কিন্তু তার স্বভাবের চাহিদা হলো, হয় সে পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করবে, অথবা কোন কিছুতে তার কোনো অংশ গ্রহনই থাকবেনা।
সে ক্রমাগত অস্থির ও অ-সন্তোষ্ট বোধ করতে থাকেন। অন্য সদস্যদের প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধাবোধ ছিলোনা, সবাইকে সে তার চেয়ে নিম্ন মর্যাদার মনে করতেন। সে বিশেষ করে প্রধান মন্ত্রী প্রিন্স সৈয়দ হালিম পাশা (১৮৬৫-১৯২১) এর মতো একনিষ্ঠ মুসলমানকে ঘৃনা করতেন, এবং যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আনোয়ার পাশার (১৮৮২-১৯২২) সাথে তিনি অবিরাম ঝগড়ায় লিপ্ত থাকতেন। একজন স্বভাবজাত সৈন্য ও নেতা হিসাবে পরবর্তী ১০ বছর সে নিজেকে সামরিক পেশায় স্বাতন্ত্রের সাথে প্রতিষ্ঠা করেন। দাম্ভিকতা ও ধুর্ততার মিশেলে গঠিত ব্যাক্তিত্বের সাহায্যে সে ক্রমান্বয়ে অধিক রাজনৈতিক প্রভাব অর্জন করতে থাকেন। তিনি তার সন্ধ্যাগুলো বন্ধ দরজার ভেতর গোপন মিটিং এ ক্যু-দেতা এর পরিকল্পনা করে কাটান যা তাকে পরিপূর্ণ শাসন ক্ষমতা প্রদান করতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে তার সুযোগ সৃষ্টি হয়, সে সম্মিলিত ইউরোপীয় শক্তির বিরূদ্ধে তুরস্কের ভৌগলিক সীমার অখন্ডতা রক্ষার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। যাদের উদ্দেশ্য ছিল “ ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি” তথা তুরস্ককে দ্রুততার সাথে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। এই অসৎ পরিকল্পনা দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করে, জনগনের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে, তাদের ভৌগলিক অখন্ডতা রক্ষার যুদ্ধে অংশ গ্রহণে অনুপ্রানিত করার মাধ্যমে, মুস্তফা কামাল পাশা একজন জাতীয় বীরে পরিণত হন। গ্রীকদের পরাজিত করে যখন যুদ্ধে তুরস্কের জয় সু-সংহত হয়, তুর্কী জনগন আনন্দে উদবেলিত হয়ে ওঠে। তারা তাকে ত্রাতা হিসাবে বরণ করে নেয়, এবং তাকে সম্মানিত উপাধি ‘গাজী’তে ভুষিত করে।
কুটনৈতিকদের পক্ষ থেকে নানা অভিবাদন আসতে থাকে, তারা তাকে পাশ্চাত্যের বিরূদ্ধে প্রাচ্যের নায়ক হিসাবে দেখতে চায়। আরব রাস্ট্র নায়কদের সম্মেলনে, আরব নেতাদের প্রতি তিনি বলেন, “ আমি না সকল মুসলমান রাস্ট্রসমূহের ফেডারেশনে বিশ্বাসী, না সোভিয়েত শাসনাধীন সকল তুর্কী জাতির সঙ্ঘে বিশ্বাসী। আমার লক্ষ্য শুধু তুরস্কের স্বাভাবিক সীমানার মধ্যে এর স্বাধীনতা রক্ষা করা, অটোমান অথবা অন্য কোনো সম্রাজ্য পুনর্জীবিত করনের কোনো ইচ্ছা আমার নেই। স্বপ্ন ও ছায়া থেকে দূরে থাকতে চাই, যা অতীতে আমাদের অনেক প্রিয়জনকে ত্যাগের কারন হয়েছে।”
কম্যুনিস্ট প্রতিনিধি দল যারা তার সমর্থন কামণা করছিল, তাদের তিনি আরো কড়া ভাষায় বলেনঃ
কোথাও কোনো জালিম বা মজলুম নেই । আছে শুধু ঐ সব লোক, যারা নিজেদেরকে স্বেচ্ছায় মজলুম হতে দেয়। তুর্কীরা জাতি এমন নয়, এরা নিজেদের দায়িত্ব নিতে পারে। অন্যদেরও তাই করতে দিন। আমাদের শুধু একটিমাত্র নীতি আছে, আর তাহলো সকল সমস্যা তুর্কী দৃষ্টি দিয়ে দেখা এবং তুরস্কের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা। [১]
মুস্তফা কামাল পাশার ঘোষিত নীতি ছিল তুরস্ককে এর সাধারন সীমানার মাঝে একটি ছোট, একক জাতিরাস্ট্র, সর্বোপরি একটি উন্নত আধুনিক রাস্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা, যাকে অন্যান্য সকল রাস্ট্র সম্মান করবে। তিনি এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, কেবল মাত্র তিনি, কেবল তিনিই এ কাজের যোগ্য, তিনি ঘোষনা করেনঃ আমিই তুরস্ক ! আমাকে ধ্বংস করা মানে তুরস্ককে ধ্বংস করা ! [২]