অনন্য ব্যক্তিত্বের রূপকথার উড়ান
মা বাসন মাজতেন। বাবা ছিলেন চা-ওয়ালা। নিজে কেটলি নিয়ে রেল স্টেশনে চা বিক্রিও করেছেন। রাহুল গাঁধীর মতো গোটা দেশের কাছে সুপরিচিত এক অভিজাত রাজনৈতিক পরিবারের প্রতিনিধি তিনি নন। কিন্তু ঘর-ছাড়া আরএসএস প্রচারক নরেন্দ্র মোদী প্রথমে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক, তার পর হিমাচলপ্রদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা থেকে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী পদে হ্যাটট্রিক। তার পর শুধুই উত্থান। তাঁর নেতৃত্বেই আজ বিজেপি গোটা দেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই বিপুল সাফল্যের পর আজ বডোদরায় দাঁড়িয়ে মোদী জানিয়ে দিলেন, নতুন সরকার রাজনীতিতে আমরা-ওরা করবে না। মোদীর ভাষায়, “রাজনীতিতে ও গণতন্ত্রে প্রতিপক্ষ হয়। কিন্তু কেউ শত্রু হয় না।”
এ এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের উত্থান কাহিনী। মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করতে রাজি ছিলেন না লালকৃষ্ণ আডবাণী। কিন্তু সেপ্টেম্বরে মোদীর নাম প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা হওয়ার পর সেই আডবাণী এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, “মোদীই প্রধানমন্ত্রী হবেন।” কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলেন, “কোনও ব্যক্তির অভিলাষ যদি নির্ভেজাল হয় আর খুব তীব্র ইচ্ছাশক্তি থাকে, তবে একটা মানুষ তাঁর লক্ষ্যে সফল হবেনই।”
২০০২ সাল। কেশুভাই পটেল তখনও গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। অশোক রোডে বিজেপির সদর দফতরের একটি খুপরি ঘরে থাকতেন নরেন্দ্রভাই। তখন বিধায়কদের বিদ্রোহ শুরু হয়ে গিয়েছে। বিক্ষুব্ধরা ফ্যাক্সে বাজপেয়ী-আডবাণীর কাছে মুখ্যমন্ত্রী বদলের আবেদন জানাচ্ছেন। সে রকম একটি দিনে দিল্লির এক হোটেলে বসে আজকের ভাবী প্রধানমন্ত্রী এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আমি হবই। কেন না আমার চরিত্রের সব চেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, আমি খুব ‘ফোকাসড’। আপাতত মুখ্যমন্ত্রী হয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই গুজরাতকে বদলে দেব।”
সে দিনও মোদীর অভিলাষের তীব্রতা ছিল বেনজির। ২০০২ সালে গোধরা কাণ্ডের পর দেশ জুড়ে ঝড় ওঠে। সে দিন থেকে সাম্প্রদায়িকতার ভূত মোদীকে তাড়া করেছে। এখন তাঁর প্রধান চ্যালেঞ্জ সংখ্যালঘু জনসমাজ এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের কাছে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রমাণ করা।
মোদী ঘনিষ্ঠ অমিত শাহ বলেন, নরেন ভাইয়ের সব চেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, না ভেবে কোনও কাজ করেন না। পরিকল্পনা করে ধাপে ধাপে এগোনোই ওঁর বৈশিষ্ট্য। মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই তিনি জাতীয় রাজনীতির কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন। এক দিকে উত্তরপ্রদেশ-বিহারে কী রণকৌশল নেওয়া হবে, তার সাংগঠনিক দিকটি ঠিক করে দিয়েছেন। অন্য দিকে আর্থিক নীতি রূপায়ণের মাধ্যমে উন্নয়নের নীল নকশা তৈরি করাও তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত।
কী ভাবে রচিত হল মোদীর এই রূপান্তরের কাহিনী?
ছেলেটি বাড়ি ছেড়ে প্রথমে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে গিয়েছিল। কিছু দিনের জন্য সেখানে কাজও করে। তার পর তিনি যান রামকৃষ্ণ মিশনে সন্ন্যাসী হতে। তার পর চায়ের দোকানে ব্যবসা ছেড়ে আরএসএসের প্রচারক হওয়া। ক্রমে ক্রমে মোদী যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন। অনাবাসী গুজরাতিদের জন্যও কাজ করেছেন। আবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত ভুজের যে পুনর্গঠন করেছেন তিনি, তা দেখে প্রশংসা করছে কেন্দ্রীয় সরকারও।
জয়ের পর ছেলেকে আদর মায়ের। শুক্রবার গাঁধীনগরের বাড়িতে। ছবি: পিটিআই।
গোধরার কলঙ্কিত চরিত্র থেকে এক শক্তিশালী রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্ন বিক্রির সফল ফেরিওয়ালা। রাহুল গাঁধী তথা কংগ্রেস নেতৃত্ব মনে করেন, এ এক মায়াবাস্তবতা। গভীর আর্থিক ও সামাজিক সঙ্কটে মানুষ সুপারম্যানকে খোঁজে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ত্রিশের দশকে আর্থিক মন্দার পরই জন্ম নিয়েছিল সুপারম্যান কমিক স্ট্রিপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুঃখী ব্রিটেনবাসীর জন্য এসেছিল জেমস বন্ড। সত্তরের দশকে বলিউডে অমিতাভ বচ্চন। সলমন খুরশিদ বলেন, “এগুলো ছিল পরাবাস্তবতা। কিন্তু এখন টেলিভিশনের যুগে বাস্তব রাজনীতিতেও মানুষ ভ্রান্তির শিকার। অচিরেই মানুষের ভুল ভাঙবে।”
বিরোধী পক্ষ এই জয়কে যতই বিপুল অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি হওয়া জনমত বলে মনে করুন না কেন, আসলে কিন্তু মোদী বুঝতে পেরেছিলেন দেশ জুড়ে কংগ্রেস বিরোধী হাওয়া তীব্র হয়ে উঠেছে। দশ বছরের কংগ্রেস শাসনে মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, নীতিপঙ্গুত্ব নানা বিষয়ে যে বিরুদ্ধ জনমত তৈরি হয়েছে, তাকে কাজে লাগাতে তৎপর হন তিনি। কংগ্রেস বিরোধী আবহ থাকলেও তখন বিজেপির অন্দরেও তীব্র কলহ। বস্তুত আডবাণীর পাকিস্তান সফর ও জিন্না বিতর্কের পর থেকেই আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে তাঁর প্রবল সংঘাত তৈরি হয়।
সে সময় দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতারা, যেমন রাজনাথ, সুষমা, অরুণ জেটলি-সহ অনেকেই নিজেদের প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। সঙ্ঘ-পরিবার বুঝতে পেরেছিল মোদীর জনপ্রিয়তা দল এবং সংগঠনের অন্দরে কতটা। তাই নিতিন গডকড়ী বা রাজনাথ সিংহরা আরএসএসের বশংবদ হলেও সঙ্ঘ পরিবার বুঝতে পারে, বাজপেয়ী-আডবাণী যুগের অবসানের পর বিজেপিতে নতুন যুগ আনতে পারেন এক মাত্র মোদীই।
সঙ্ঘ পরিবার বুঝতে পারছিল, গোটা দেশেই মানুষ কংগ্রেসের উপর ক্ষুব্ধ। কিন্তু তা বিজেপিকে গ্রহণ করতে পারছে না, তার এক মাত্র কারণ অন্তর্কলহ। এই পরিস্থিতিতে বিকল্প এক মাত্র মোদীই। তা সত্ত্বেও গোয়ায় কর্মসমিতির বৈঠকে মোদীকে প্রচার কমিটির প্রধান করা হলেও তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করার প্রশ্নে আপত্তি জানান আডবাণী-সুষমারা। শরিকি বাধ্যবাধকতার যুক্তি দেখিয়ে তাঁরা নির্বাচনের পরে ওই ঘোষণা করার পক্ষে সওয়াল করলেও সঙ্ঘ পরিবার বুঝেছিল, নির্বাচনের আগে নাম ঘোষণা না করা হলে কংগ্রেস-বিরোধী পরিসরটি দখল করতে পারবে না বিজেপি। তাই দেরি না করে তড়িঘড়ি মোদীর নাম ঘোষণা করে দেওয়া হয়। আজ ভোটের ফল বুঝিয়ে দিল সঙ্ঘ ও মোদী জুটির কৌশল সফল। বাজপেয়ী জমানায় প্রধানমন্ত্রী উদার ভাবমূর্তিসম্পন্ন হলেও আডবাণীর ভাবমূর্তি ছিল কট্টরপন্থী। আরএসএস নেতারা বলছেন, মোদী টু-ইন ওয়ান। এক দিকে উদার সংস্কারমুখী। গুজরাতের মডেলকে ভারতীয় মডেল করে বৃদ্ধিকে ঊর্ধ্বমুখী করতে চান। অন্য দিকে তিনি সমর্থকদের কাছে ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট।’
’৬৭ সালে কংগ্রেস দশটি রাজ্যে ধরাশায়ী হয়েছিল। ভারতীয় রাজনীতিতে সেটা ছিল কংগ্রেসের প্রথম বড় ধাক্কা। ’৭৭ সালেও কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়া দেখেছে দেশ। ’৮৯ সালে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের হাত ধরেও কংগ্রেস বিরোধিতার ঝড় দেখা গিয়েছে। কিন্তু এ বার মোদী শুধু কংগ্রেস বিরোধিতা করেননি। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় মোদী মডেলকে মানুষের কাছে গ্রহণ করাতে সফল হয়েছেন। হিন্দুত্বের পুরনো ধ্যানধারণাকেও বদলে দিয়েছেন। রাম মন্দিরের বদলে তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী স্থায়ী রাষ্ট্র গঠনের প্যাকেজে পরিণত করেন। দেশে যখন অস্থিরতা, আর্থিক সঙ্কট তীব্র, তখন এই মহা জাতি গঠনের আকাঙ্খাও তীব্র হয়ে ওঠে। এই কৌশলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মোদীর অসম্ভব পরিশ্রম করার ক্ষমতা। সব মিলিয়ে ৫৮০০ জনসভা করেছেন তিনি। ৩ লক্ষ কিলোমিটার ভ্রমণ করেছেন। রাজ্যগুলিতে যাওয়ার সময়ে সে রাজ্যের সমস্যাগুলি নিয়ে বিপুল হোমওয়ার্ক করেছেন, অনেকটা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কায়দায়।
নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কাহিনি তাই নিম্নবর্গের ভারতীয় প্রতিনিধির ক্ষমতায়নের রূপকথা। মোদীর সাফল্যের কাছে হেরে গেল অভিজাততন্ত্রের ‘ইন্ডিয়া।’