দীর্ঘ বিরতির পর আবার মুখ খুলেছেন তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। প্রতিমন্ত্রী থেকে পদত্যাগের পর দীর্ঘ সময়েও গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশ না হওয়া এবং মাসিক পারিতোষিক ও ভাতা তার একাউন্টে পাঠানোর ঘটনায় বিব্রত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি সোম ও মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত দুটি চিঠি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের কাছে পাঠিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত সোহেল তাজ মঙ্গলবার সকালে এই প্রতিবেদককে টেলিফোনে সরকারের এ আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কেন তার সঙ্গে এ আচরণ করা হচ্ছে, তা তার কাছে বোধগম্য নয়। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বেতন-ভাতা নিতে চান না। তারপরও তা বন্ধ করা হচ্ছে না। তিনি পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এটা একটা আশ্চর্যজনক বিষয়। এ ব্যাপারে তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যোগাযোগ করে সদুত্তর পাননি। তাই চিঠি লিখতে বাধ্য হয়েছেন। সোহেল তাজ দাবি করেন, সংবিধানের ৫৮(ক) ধারা অনুযায়ী তিনি এখন আর প্রতিমন্ত্রী নন। তারপরও তাকে প্রতিমন্ত্রীর পাসপোর্ট ব্যবহার করতে বাধ্য করা হচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তার পাসপোর্ট পরিবর্তন করে দিচ্ছে না। সম্প্রতি ঢাকায় বোনের ছেলে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানতে চান, তার পরিবারের সদস্যের ওপর এ আঘাত কেন? এসব কিসের আলামত?আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ট সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের একমাত্র পুত্র তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। বঙ্গবন্ধু পরিবারের এক প্রভাবশালী সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ২০০৯ সালের ৩১ মে যমুনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগপত্র জমা দেন। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। ফলে পরবর্তীতে ১ জুন তার একান্ত সচিবের মাধ্যমে পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেন। ফিরে যান কর্মস্থল যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে। এরপর দীর্ঘ নীরবতা। অবশেষে ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই সেখান থেকে খোলামেলা কথা বলে পদত্যাগের ঘটনা প্রথমবারের মতো স্বীকার করেন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংবাদ সংস্থার সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। সংবাদ সংস্থাটির প্রতিবেদন বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ ও প্রচার করে। ওই দিন সোহেল তাজ অনেকটা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে কোন কিছুরই পরিবর্তন হবে না। তিনি বলেন, আমি আÍসম্মান বিসর্জন দিয়ে মন্ত্রিত্ব করার লোক নই। বিগত বিএনপি সরকারের সঙ্গে বর্তমান মহাজোট সরকারের তুলনা করে সোহেল তাজ বলেন, খেলা একই আছে, খেলোয়াড় বদলেছে মাত্র। পদত্যাগের বিষয়টি স্বীকার করার কিছুদিন পর দেশে ফেরেন সোহেল তাজ। কিন্তু বিমানবন্দরে প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও প্রতিমন্ত্রীর প্রটোকল গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন তিনি। কয়েক দিন পর নিজ নির্বাচনী এলাকা কাপাসিয়ায় গিয়ে তার পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করেন সেখানকার মানুষের কাছে। কাপাসিয়ার মানুষ তার এ সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করে তাকে সমর্থন জানায়। প্রবাসী কর্মজীবী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ এরপর বেশ কয়েকবার দেশে এসে ফিরে গেছেন। মূলত তার মা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, প্রবীণ নেত্রী জোহরা তাজউদ্দিনের অসুস্থতার কারণেই তাকে ছুটে আসতে হয়েছে। এ সময় তিনি বাধ্য হয়ে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সরকারের দেয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন।
সোহেল তাজ মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে ১৬ এপ্রিল লেখা চিঠির বিষয় ‘প্রতিমন্ত্রী হিসেবে মাসিক পারিতোষিক ও ভাতাদি প্রসঙ্গে’। তিনি লেখেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে একসঙ্গে পাঠানো প্রতিমন্ত্রীর মাসিক পারিতোষিক ও ভাতাদির চেক (আগস্ট ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১১) কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য বা কাম্য নয়। যা পরবর্তীতেও পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে তিনি জানান, ২০০৯ সালের মে মাসে তিনি মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং পরবর্তীতে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কোথাও কোন (পারিতোষিক ও ভাতাদি) স্বাক্ষর করেননি। এমতাবস্থায় উল্লিখিত সময়ে পাঠানো মাসিক পারিতোষিক ও ভাতাদির চেক প্রত্যাহারপূর্বক পরবর্তীতে মাসিক পারিতোষিক ও ভাতাদির চেক তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে না পাঠানোসহ জমাকৃত অর্থ ফেরত নেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন।
পরের দিন মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে তিনি আরও একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। এই চিঠির বিষয় ‘পদত্যাগ গেজেট নোটিফিকেশন প্রসঙ্গে’। চিঠিতে সোহেল তাজ লেখেন, ‘আমি ৩১ মে ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৮(ক) ধারা মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর হাতে আমার পদত্যাগপত্র প্রদান করি এবং ১ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পদত্যাগপত্র প্রেরণ করি। কিন্তু অদ্যাবধি আমার পদত্যাগ গেজেট নোটিফিকেশন হয়নি। ফলশ্র“তিতে পদত্যাগ নোটিফিকেশন না করায় বর্তমানে সরকার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আমার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে এবং একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আমার অজান্তে আমার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে গত নভেম্বর ২০১১ইং তারিখে একসঙ্গে আগস্ট ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১১ইং পর্যন্ত আমার নামে প্রতিমন্ত্রীর মাসিক পারিতোষিক ও ভাতাদি চেক জমা করে এবং পরবর্তীতে চেক জমা করা অব্যাহত রাখে। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে আমি আমার নামীয় মাসিক পারিতোষিক ও ভাতাদি চেক নিজ স্বাক্ষরে গ্রহণ করেছি। কিন্তু গত জুন ২০০৯ইং থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কোথাও কোন স্বাক্ষর করিনি। যা ইতিমধ্যে আমি চিঠি দিয়ে আপনাকে অবহিত করেছি। এমতাবস্থায় কেন আমার প্রেরণ করা পদত্যাগ গেজেট নোটিফিকেশন না করে আমার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে প্রতিমন্ত্রীর পারিতোষিক ও ভাতাদি জমা করা হল সেই মর্মে আমাকে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হল। ধন্যবাদান্তে তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ, জাতীয় সংসদ সদস্য, ১৯৭, গাজীপুর-৪, তারিখ ১৭/৪/২০১২ ইং।’
সোহেল তাজ জানিয়েছেন, দেশে অবস্থানকালে তিনি সংসদ সচিবালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিমন্ত্রীর পাসপোর্ট পরিবর্তন এবং একজন সংসদ সদস্য হিসেবে তার প্রাপ্য ভাতা প্রাপ্তির বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তখন সংসদ সচিবালয় এসব বিষয়ে সমাধানে অপারগতা প্রকাশ করে তাকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়। এরপর বিষয়গুলো নিয়ে তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কথা বলেন। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কোন সমাধান না দিয়ে নীরবতা পালন করেন। তার ধারণা ছিল এতদিনে নিশ্চয় বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে। কিন্তু তা হয়নি। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি লিখেছেন। ওই চিঠি বাহকের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেয়া হয়েছে বলে জানান সোহেল তাজ। দুপুরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।