Main Menu

মূঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস

+100%-

tatamofej-1444350803-46a471f_xlargeডেস্ক ২৪::মুঘল সাম্রাজ্য ছিল ভারত উপমহাদেশের একটি ঐতিহাসিক সাম্রাজ্য । উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলজুড়ে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল । মুঘল সাম্রাজ্য পারস্যের ভাষা শিল্প ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল । সমসাময়িকরা বাবরের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে তিমুরি সাম্রাজ্য বলে উল্লেখ করেছেন যা মুঘলরা নিজেরাও ব্যবহার করত । আইন ই আকবরিতে হিন্দুস্তান নামটি উল্লেখ রয়েছে । পাশ্চাত্যে মুঘল শব্দটি সম্রাট ও বৃহৎ অর্থে সাম্রাজ্য বোঝাতে ব্যবহৃত হত । আরবি এবং ফারসি থেকে মুঘল শব্দটি এসেছে । তবে বাবরের পূর্বপুরুষরা সাবেক মঙ্গোলদের চেয়ে ফারসি সংস্কৃতি দ্বারা বেশি প্রভাবিত ছিলেন । জ্বলপথে প্রথম যুদ্ধে ইবরাহিম লোদির বিরুদ্ধে বাবরের জয়ের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটে । মুঘল সম্রাটরা ছিলেন মূলত মধ্য এশিয়ার তুর্কি মঙ্গোল বংশোদ্ভূত । এরা চাগতাই খান এবং তৈমুরের মাধ্যমে নিজেদের চেঙ্গিস খানের বংশধর বলে দাবি করতেন । ১৫৫৬ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্রুপদি যুগ শুরু হয় । আকবর এবং তার ছেলে জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ভারতে অর্থনৈতিক প্রগতি বহুদূর অগ্রসর হয় । আকবর অনেক হিন্দু রাজপুত রাজ্যের সাথে মিত্রতা করেন । কিছু রাজপুত রাজ্যের উত্তর পশ্চিম ভারতে মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জারি রাখে কিন্তু আকবর তাদের বশীভূত করেন । মুঘল সম্রাটরা মুসলিম থাকলেও জীবনের শেষের দিকে শুধুমাত্র সম্রাট আকবর এবং তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর নতুন ধর্ম দীন ই-ইলাহির অনুসরণ করতেন ।

মুঘল সাম্রাজ্য স্থানীয় সমাজে হস্তক্ষেপ করতেন না তবে তারা প্রশাসনিকভাবে এসববের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতেন । তারা অনেক বেশি কাঠামোগত ভাবে কেন্দ্রীভূত শাসন প্রতিষ্ঠা করেন । মুঘল শাসনামলে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন সমাজ গোষ্ঠী যেমন মারাঠা, রাজপুত ও শিখরা সামরিক শক্তি অর্জন করেন ।

শাহজাহানের যুগে মুঘল স্থাপত্য এর স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে । তিনি অনেক স্মৃতিসৌধ, মসজিদ, দুর্গ নির্মাণ করেন যার মধ্যে রয়েছে আগ্রার তাজমহল, মোতি মসজিদ, লালকেল্লা, দিল্লি জামে মসজিদ । আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায় । শিবাজী ভোসলের অধীনে মারাঠাদের আক্রমণের ফলে সাম্রাজ্যের অবনতি শুরু । আওরঙ্গজেবের সময় দক্ষিণ ভারত জয়ের মাধ্যমে ৩.২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের বেশি অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয় । ততকালিন সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ১৫০ মিলিয়নের বেশি যা ততকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ এবং জিডিপি ছিল ৯০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ছিল । ১৮শ শতাব্দীর মধ্যভাগ নাগাদ মারাঠারা মুঘল সেনাবাহিনীর বিপক্ষে সফলতা লাভ করেন এবং দক্ষিণাত্য থেকে বাংলা পর্যন্ত বেশ কিছু মুঘল প্রদেশে বিজয়ী হন । সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার দুর্বলতার কারণে আভ্যন্তরীণ অসন্তোষ সৃষ্টি করে যার ফলে বিভিন্ন প্রদেশ কার্যত স্বাধীন হয়ে যায় । ১৭৩৯ সালে কারনালের যুদ্ধে নাদির শাহের বাহিনীর কাছে মুঘলদের পরাজয় ঘটে । ততকালিন সময় দিল্লি লুন্ঠিত হয় । পরের শতাব্দীতে মুঘল শক্তি ক্রমান্বয়ে সীমিত হয়ে পড়েন ও শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের কর্তৃত্ব শুধু শাহজাহানাবাদ শহরে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় । সিপাহী বিদ্রোহের সমর্থনে তিনি একটি ফরমান জারি করেন । সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহীতার অভিযোগ এনে কারাবন্দী করেন । শেষে তিনি রেঙ্গুনে নির্বাসিত হন এবং সেখানেই মারা যান ।

বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কি মঙ্গোল বংশোদ্ভূত শাসক । বাবার দিক থেকে তিনি তৈমুর লং এবং মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন । মধ্য এশিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে বাবর ভারতে ভাগ্য নির্মাণে নিয়োজিত হন । তিনি নিজেকে কাবুলের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং আফগানিস্তান থেকে খাইবার পাস হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন । জ্বলপথের যুদ্ধে বিজয়ের পর বাবরের সেনাবাহিনী উত্তর ভারতের অধিকাংশ এলাকা জয় করে নেয় । তবে তার শাসন কাজে পাকাকোক্ত হতে অনেক সময় লেগে যায় । অস্থিতিশীলতা তার ছেলে হুমায়ুনের সময়ও ছড়িয়ে পড়েছিল । হুমায়ুন ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারত থেকে পারস্য পালিয়ে যায় । হুমায়ুনের সাথে পারস্যের সাফাভিদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং মুঘল সাম্রাজ্যে পারস্যের সাংস্কৃতিক প্রভাব বৃদ্ধি শুরু হয় । পারস্যের সহায়তায় হুমায়ুন মুঘলদের ক্ষমতা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করে । এর অল্পসময় পরে দুর্ঘটনায় হুমায়ুনের মৃত্যু হলে তার ছেলে আকবর অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় সিংহাসনে বসেন । আকবরের অভিভাবক বৈরাম খান ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করতে আকবরকে সহায়তা করেন । যুদ্ধ এবং কূটনীতির মাধ্যমে আকবর সাম্রাজ্যকে সবদিকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় । তিনি ভারতের সামাজিক গোষ্ঠীর সামরিক অভিজাতদের থেকে তার প্রতি অনুগত নতুন অভিজাত শ্রেণী গড়ে তোলেন । তিনি উন্নত সরকার ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে বহু অবদান রেখেছেন । আকবর ইউরোপীয় বাণিজ্য কোম্পানিগুলোর সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি করেন । বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পার্থক্য দূর করার জন্য আকবর দীন ই ইলাহি নামক নতুন ধর্ম তৈরি করেন । তবে এই ধর্ম প্রসিদ্ধ হয়নি । আকবরের ছেলে সম্রাট জাহাঙ্গীর সমৃদ্ধির সাথে শাসন করেন । তবে জাহাঙ্গীর আফিমে আসক্ত ছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় কাজে অনীহা দেখায় এবং দরবারের বিদ্রোহীদের প্রভাবে পড়ে । তার ছেলে শাহজাহানের শাসনকাল মুঘল দরবারের জাকজমকের জন্য প্রসিদ্ধ । এসময় অনেক বিলাসবহুল ইমারত নির্মিত হয় যার মধ্যে তাজমহল ছিল অন্যতম । এসময় দরবারের রাজস্ব আয়ের চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেশি ছিল । শাহজাহানের অসুস্থতার পর তার বড় ছেলে দারা শিকোহ অভিভাবক হন । সিংহাসন নিয়ে শাহজাহানের ছেলেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় অন্যান্যদের পরাজিত করে শেষপর্যন্ত আওরঙ্গজেব জয়ী হন । দারা শিকোহকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় । আওরঙ্গজেব শাহজাহানকে শাসনের অযোগ্য ঘোষণা করে বন্দী করেন । আওরঙ্গজেবের সময় মুঘল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অনেক বৃদ্ধি পায় । তিনি প্রায় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া মুঘল সাম্রাজ্যের সরাসরি অধীনে নিয়ে আসেন । ১৭০৭ সালে তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের অনেক অংশ বিদ্রোহ করতে শুরু করে । আওরঙ্গজেবের ছেলে প্রথম বাহাদুর শাহ প্রশাসন সংস্কার করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন । তবে ১৭১২ সালে তার মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে । ১৭১৯ সালে চারজন সম্রাট পরপর শাসন করেন । একটি সময় মুহাম্মদ শাহের শাসনামলে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে । মধ্য ভারতের অধিকাংশ মারাঠা সাম্রাজ্যের হাতে চলে যায় ।

নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করেন এবং এতে মুঘল শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে । সাম্রাজ্যে অনেক স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয় । তবে মুঘল সম্রাটকে সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে বিবেচিত করা হত । সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম মুঘল কর্তৃত্ব পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালান । কিন্তু তাকে বাইরের শক্তির উপর নির্ভর করতে হয় । এদের মধ্যে ছিলেন আফগানিস্তানের আমির আহমেদ শাহ আবদালি । ১৭৬১ সালে আবদালির নেতৃত্বাধীন আফগান এবং মারাঠা সাম্রাজ্যের মধ্যে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয় । ১৭৭১ সালে মারাঠারা আফগানদের কাছ থেকে দিল্লি পুনর্দখল করে নেয় এবং ১৭৮৪ সালে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লিতে সম্রাটের রক্ষক হয়ে উঠেন । তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই অবস্থা বজায় রাখেন বা তা ছিল । তারপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল রাজবংশের রক্ষক হন । সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর শেষ মুঘল সম্রাটকে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠান । এরপর ইংল্যান্ডের রাণী ভিক্টোরিয়াকে ভারত সম্রাজ্ঞী ঘোষণা করা হয় । ইতিহাসবিদদের মতে মুঘল সাম্রাজের পতনের বেশ কিছু কারণ আছে । অর্থনৈতিক দিক থেকে সাম্রাজ্যে প্রধান অফিসার আমিরদের বেতন দিতে প্রয়োজনীয় তেমন রাজস্ব ছিল না । আঞ্চলিক শাসকদের উপর সম্রাট নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন । সেনাবাহিনীকে অধিক মাত্রায় আগ্রাসী মারাঠাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনব্যপী চলমান যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় ফলে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলেন । ফররুখসিয়ারের মৃত্যুর পর স্থানীয় শাসকরা ক্ষমতা নিতে শুরু করেন । ইতিহাসবিদরা বেশ কয়েকভাবে পতনকে ব্যাখ্যা করেছেন । মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় দেখা যায় উচ্চশ্রেণীর মধ্যে অসাধুতা অত্যধিক বিলাসিতা এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি শাসকদের বাহ্যিক হুমকির ব্যাপারে অপ্রস্তুত করে তোলে । একটী মার্ক্সবাদি মতানুযায়ী ধনীদের হাতে কৃষকদের নিপীড়নের কারণে শাসনের প্রতি জনসমর্থন কমে যায় । আরেকটি মতানুযায়ী হিন্দু ধনী সম্প্রদায় মুঘল সাম্রাজ্যের বদলে মারাঠা ও ব্রিটিশদের অর্থসহায়তা প্রদান করে । ধর্মীয় দিক থেকে বিচারে বলা হয় হিন্দু রাজপুতরা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন । তবে চূড়ান্ত মত হিসেবে অন্যান্য পন্ডিতরা বলেন যে সাম্রাজ্যের অত্যধিক সমৃদ্ধি প্রদেশগুলোকে অধিক মাত্রায় স্বাধীনতা অর্জনে উৎসাহ যোগায় এবং রাজ দরবারকে দুর্বল করে তোলে ।

কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট



« (পূর্বের সংবাদ)
(পরের সংবাদ) »



Shares