বিভিন্ন সংস্কৃতির বিশ্বাস অনুসারে যেভাবে উৎপত্তি হয়েছিল মানবজাতির
‘আমরা কোথা থেকে এসেছি’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিশ্বের প্রায় সকলেই নানা ধরনের পৌরাণিক কাহিনীর অবতারণা করে থাকেন। গোত্রে গোত্রে এই পৌরাণিক কাহিনীর যেমন এদিক সেদিক হয়, অমিল বেমিল হয় তেমনি কোনো কোনো গোত্রের কাহিনী আবার প্রায় মিলেও যায়। কাহিনীগুলো বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্ভট হলেও গল্প হিসেবে শুনতে চমৎকার লাগে। এরকম কয়েকটি উপকথা নিয়ে আজকের আয়োজন।
তাসমানীয়দের পৌরাণিক বিশ্বাস
‘কোথা থেকে এলাম’ এই প্রশ্নের উত্তরে মজাদার একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে তাসমানিয়ার আদিম অধিবাসীদের মধ্যে। নক্ষত্রলোকে এক ভয়াবহ যুদ্ধে ময়িনী নামের একজন দেবতা ড্রোমারডিনার নামের আরেকজন দেবতার কাছে শুচনীয় পরাজয় বরণ করে। ময়িনী আকাশলোক থেকে ছিটকে তাসমানিয়ার আছড়ে পড়ে। এতে করে তিনি মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যান। মৃত্যুবরণ করার আগ-মুহূর্তে তিনি তার একটা শেষ শুভ ইচ্ছা পূরণ করতে চাইলেন। সেই ইচ্ছা থেকে শেষ আশ্রয়স্থলের জন্য একটা ভালো কিছু তৈরি করার চেষ্টা করলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন মানুষ সৃষ্টি করবেন। তিনি মরে যাচ্ছেন, একটু পরই সব ক্ষমতা চলে যাবে, এটা জেনে খুব দ্রুত কাজ করতে লাগলেন। এই দ্রুততা বা ব্যস্ততার ফলে তিনি সদ্য সৃষ্টি করা মানুষের পায়ে হাঁটু দিতে ভুলে গেলেন। পাশাপাশি আরেকটা ভুল কাজ করে ফেললেন, মনভোলা হয়ে তাদের পেছনে লম্বা লেজ লাগিয়ে দিলেন, অনেকটা ক্যাঙ্গারুর লেজের মতো করে। এর পরপরই তিনি মারা গেলেন।
হাঁটুই যদি ভাজ করতে না পারে তাহলে মানুষ বসবে কী করে? তার উপর এই অসুবিধার পাশে লেজ যুক্ত হয়ে এটাকে আরও সমস্যাময় করে তুলল। ক্যাঙ্গারু সদৃশ লেজ ও হাঁটুহীন পা নিয়ে মানুষ ভীষণ সমস্যার মাঝে পড়ল। তারা সাহায্যের জন্য, এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেবার জন্য স্বর্গের উদ্দেশ্যে কান্নাকাটি করতে লাগলো।
যুদ্ধবীর ড্রোমারডিনার তখনো যুদ্ধে জয়লাভের উল্লাসের গর্জনে মত্ত। মানবজাতির কান্না শুনার আগ পর্যন্ত বিজয় মাঠে তার গর্জন চলছিলো। মানবজাতির কান্নাকাটি শুনতে পেয়ে কী হচ্ছে এটা জানার জন্য তিনি স্বর্গ থেকে নেমে মর্তে তাসমানিয়ায় চলে এলেন। মানবজাতির এই দুর্দশা দেখে তার খুব করুণা হলো। বাঁকানো যায় এমন হাঁটু প্রদান করলেন মানুষদেরকে এবং ক্যাঙ্গারু সদৃশ অসুবিধাজনক লেজ কেটে দিলেন। যার ফলে মানুষেরা আরামে বসতে পারলো এবং অন্যান্য কাজকর্মও সহজভাবে করতে পারলো। এরপর থেকে তারা শান্তিতে বসবার করছে তাসমানিয়াতে।
প্রায় সময়েই আমরা এই পৌরাণিক কাহিনীর কাছাকাছি কাহিনী শুনতে পাই। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এই গল্পগুলো টিকে রয়েছে মানুষের মুখে মুখে। মানুষ যখন নানা জায়গায় এই গল্পের অবতারণা করে তখন স্বভাবতই স্থানভেদে কাহিনীর কিছু এদিক সেদিক হয়। এটাই অনেক বছর পরে বড় ধরনের পার্থক্য হিসেবে দেখা দেয়।
Credit: Dave McKean
ভিন্ন একটি উৎস থেকে তাসমানীয় পৌরাণিক কাহিনীর কাছাকাছি একটা সংস্করণ হচ্ছে এরকম- ময়িনী আকাশের উপরেই প্রথম মানব পার্লেভার’কে সৃষ্টি করেন। পার্লেভার বসতে পারতো না কারণ তার কোনো হাঁটু ছিল না। পাশাপাশি ক্যাঙ্গারুর লেজের মতো একটা লেজও ছিল তার, যা আরো অসুবিধার সৃষ্টি করতো। আগের কাহিনীর মতোই নক্ষত্রলোকের প্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা ড্রোমারডিনার তাদের উদ্ধার করতে এলেন এবং পার্লেভারকে যুতসই হাঁটু প্রদান করলেন এবং লেজটা কেটে দিলেন। এর ফলে যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল তা একধরনের তেল জাতীয় পদার্থের দ্বারা সারিয়ে দিলেন। এরপর পার্লেভার আকাশপথ (মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি) দিয়ে হেঁটে হেঁটে মর্তে তাসমানিয়ায় নেমে এলো।
খ্রিস্টীয় পুরাণ
মধ্য-প্রাচ্যের প্রাচীন ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকেরা একটিমাত্র সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতো। এই একজনই পুরো মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছে, এই একজনের কারণেই মানুষের অস্তিত্ব বিদ্যমান। তার আছে অনেকগুলো নাম। পরবর্তীতে প্রায় একই ধরনের বিশ্বাস খ্রিস্টানরা নিজেদের মাঝে আত্তীকরণ করে নেয়।
এই স্রষ্টা মাটি-ধুলো-বালি থেকে প্রথম মানুষ তৈরি করেন, এরপর ঐ মানুষটির নাম দেন ‘এডাম’। Adam শব্দটির বাংলা অর্থ হচ্ছে পুরুষ। তিনি সু-চিন্তিতভাবে নিজের আকৃতির আদলে এডামের আকৃতি দান করেন। অর্থাৎ ইহুদী বা খ্রিস্টীয় বিশ্বাস মতে মানুষের আকৃতি আর তাদের ঈশ্বরের আকৃতি একই রকম, তাদের ঈশ্বর দেখতে পুরুষের মতো। বাস্তবিক অর্থে অধিকাংশ পৌরাণিক কাহিনীতেই ঈশ্বরকে পুরুষ হিসেবে কল্পনা করা হয়। অল্প সংখ্যক কাহিনীতে ঈশ্বর হিসেবে থাকে নারী (দেবী)। প্রায় সকল পৌরাণিক বিশ্বাসেই এই ধরনের স্রষ্টারা হন বিশাল আকৃতির অধিকারী। এতটাই বিশাল যে সমস্ত পৃথিবীটা যেন তাদের তুলনায় একটা বালুকণার সমান মাত্র। এবং এরা হয়ে থাকে অসীম ক্ষমতা ও অসীম শক্তির অধিকারী।
Credit: Dave McKean
এডামকে তৈরি করার পর তাকে ‘ইডেন’ নামক অতিসুন্দর এক বাগানে ছেঁড়ে দিলেন। ইডেন ছিল অনেক সুস্বাদু ফলের গাছে পরিপূর্ণ। এডামকে সব ধরনের ফল খেতে উৎসাহিত করা হল- শুধু একটা গাছের ফল বাদে। এই গাছ হচ্ছে ‘ভালো ও মন্দ জ্ঞানের গাছ’ (tree of knowledge of good and evi)। স্রষ্টা এডামকে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিলেন যেন এই গাছ থেকে কোনো ফল না খায়।
তারপর স্রষ্টার মনে হলো এডামকে নিশ্চয় একাকী পানসে সময় পার করতে হচ্ছে। তাই স্রষ্টা এডামের জন্য কিছু একটা করতে চাইলেন। তিনি এডামকে সেবা সাহায্য করার জন্য সমগ্র প্রাণীজগৎ তৈরি করে দিলেন। তারপরেও মনে হলো কিছু একটার ঘাটতি রয়ে গেছে, কী যেন একটা নেই। হ্যাঁ, একজন নারী সঙ্গিনী! তারপর তিনি অনুভূতিনাশক দিয়ে এডামের বুক কেটে পাঁজরের একটা হাড় বের করে আনলেন এবং তারপর বুক সেলাই করে আগের মতো অবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন। বের করে আনা পাঁজরের হাড় থেকে একটি নারী সত্ত্বার সৃষ্টি করলেন, ঠিক যেমন একটি গাছের ডাল থেকে কলমের মাধ্যমে আরেকটি জীবিত গাছের জন্ম হয়। তিনি এই নারী সত্ত্বার নাম দিলেন ‘ইভ’ এবং ইভকে এডামের সামনে তার স্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করলেন।
দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বাগানে ছিল এক পাপিষ্ঠ সাপ, সে ইভকে প্ররোচিত করল। প্ররোচনার মাধ্যমে ইভকে দিয়ে এডামের সামনে সেই নিষিদ্ধ ফল উপস্থাপন করাল। দুজনেই সেই ফল খেল এবং এরপর নিজেদেরকে নগ্ন হিসেবে আবিষ্কার করল।
Credit: Dave McKean
এই ব্যাপারটিতে তারা খুবই লজ্জিত হলো এবং ডুমুর জাতীয় একধরনের গাছের পাতা দিয়ে নিজেদের দেহকে আবৃত করার চেষ্টা করলো। স্রষ্টা যখন তাদের এই কাণ্ড দেখলেন তখন তিনি প্রচণ্ড রাগান্বিত হলেন। তারা স্রষ্টার কথার অমান্য করেছে, নিজেদেরকে নিষ্পাপ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি তাদেরকে খুব নিন্দা করলেন এবং শাস্তি হিসেবে তাদের ও তাদের অনাগত বংশধরদের সৌন্দর্যময় স্বর্গীয় বাগান থেকে ছুড়ে ফেলে দেন মর্তের পৃথিবীতে। সেখানে তারা যন্ত্রণা ও কষ্টের জীবন পার করবে।
নর্স পুরাণ
ভাইকিং যোদ্ধা হিসেবে খুব বিখ্যাত স্ক্যান্ডিনেভীয় নর্স অধিবাসীদের পৌরাণিক উপকথায় ছিল অনেকগুলো দেবতা। যেমন করে গ্রীক ও রোমানদেরও ছিল প্রচুর দেবতা। নর্সদের দেবতাদের মাঝে প্রধান দেবতার নাম ছিল ‘ওডিন’। মাঝে মাঝে একে ‘ওটান’ কিংবা ‘অডেন’ (Woden) নামেও ডাকা হয়। আজকের দিনে আমরা যে বুধবার বা Wednesday বলি সেটা এসেছে এই Woden থেকেই। বৃহস্পতিবার বা Thursday নামটাও এসেছে নর্স পুরাণের আরেক দেবতা থর (Thor) এর নাম থেকে। থর ছিল বজ্রের দেবতা, যে তার হাতে থাকা শক্তিশালী হাতুড়ীর সাহায্যে বজ্র তৈরি করতো।
একদিন দেবরাজ ওডিন সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটছিলেন। ওডিনের সাথে ছিল তার ভাই, তিনিও ছিলেন একজন দেবতা। হাঁটতে হাঁটতে তারা দুটি গুড়ির সামনে এসে থামলেন। দুই গুড়ির একটিকে তারা বিশ্বের প্রথম মানবে রূপ দিলেন, যার নাম দিলেন ‘আস্ক’ এবং অন্য গুড়িটি থেক সৃষ্টি করলেন প্রথম মানবী, এর নাম দিলেন ‘এম্বলা’। প্রথম মানব ও প্রথম মানবীর দেহ তৈরি করার পর তাদের মাঝে প্রাণের সঞ্চার করলেন। তার পরপর তাদের মুখমণ্ডল আর কথা বলার ক্ষমতা দান করলেন। নর্সদের বিশ্বাস অনুসারে এভাবেই, অর্থাৎ গাছ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে সমগ্র মানবজাতি।
Credit: Dave McKean
মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে এতকিছু থাকতে গাছের গুড়ি কেন? কেন তুষার কিংবা বালির কণা নয়? তুষার কিংবা বালুকা থেকে তৈরি করলে কি গল্পটি চিত্তাকর্ষক হবে না? এই কাহিনীর প্রকৃত বর্ণনাকারী ঠিকই জানতো এগুলো শুধুই গল্প। সম্ভবত শ্রোতাকে চিত্তকে বেশি আনন্দ দেবার জন্যই গল্পটিকে এমনভাবে বলেন। ঠিক যেমন করে একজন গল্পকার তার গল্প বা উপন্যাসকে উপভোগ্য করার জন্য কল্পনায় প্লটের পর প্লট সাজান। গ্রীক, রোমান, মিশরীয়, খ্রিস্টীয় সব মিথের বেলাতেই এই কথা প্রযোজ্য।
গল্প হচ্ছে মজা, গল্প হচ্ছে উপভোগ করার জিনিস। এই পৌরাণিক গল্পগুলোও তার ব্যতিক্রম নয়। এগুলো ভালো মানের গল্প, উচ্চমানের সাহিত্যকর্ম। আমরা সবাইই একটা গল্প কারো মুখে শুনে কিংবা কোনো বইয়ে পড়ে সেটা অন্যদের সাথে শেয়ার করে আনন্দ পেতে পছন্দ করি। এসবের পেছনে যদি বাস্তবতা খুঁজতে যাই তাহলে আমাদেরকে বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে হবে। সে আবার আরেক জগৎ। পৌরাণিক উপকথার কাল্পনিক আনন্দের মাঝে আপাতত বিজ্ঞানকে এখানে আর টেনে আনছি না।
তথ্যসূত্র
The Magic of Reality, Richard Dawkins, Free Press, 2011