পাগড়িঃ নানা দেশে নানা বৈচিত্রে
পাগড়ি জিনিসটার সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। রাস্তাঘাটে,বইয়ের পাতায় পাগড়ি পরা মানুষ আমরা হামেশাই দেখি। কিন্তু পাগড়ি কথাটার অর্থ কী?
পাগড়ির আভিধানিক অর্থ- উষ্ণীয় বা মাথায় জড়ানোর কাপড়। কিন্তু কবে থেকে শুরু হল পাগড়ি পরার প্রচলন? কোন কোন সম্প্রদায় বা অঞ্চলের মানুষ পাগড়ি পরে থাকেন? আর কেনই বা পরেন?
হ্যা,আপাতনিরীহ মাথার আচ্ছাদন মনে হলেও বুনট বিশিষ্ট এই পাগড়ির ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ। ইতিহাসবিদদের মতে এর ব্যবহার বেশ প্রাচীনকাল থেকেই। সূর্যের উত্তাপ থেকে মাথা আড়াল করার জন্যেই এর ব্যবহার শুরু।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পাগড়ি বাধার ধরন ও ব্যবহার বিভিন্ন রকম। পাগড়ি দেখে বোঝা যায় সেই ব্যক্তি কোন অঞ্চলের ও তার পেশা কী? হ্যা,শুনলে আশ্চর্য মনে হলেও এ কথা ঠিক যে পাগড়ির কাপড়,তার বুনটশৈলি বা বাধার ধরণ দেখে বোঝা যায় সে ব্যক্তি কোন অঞ্চলের বা তার পেশা।
পাগড়ির রং বা তার কাপড় গুনমান এক এক অনুষ্ঠানে একেক রকম। বিয়ে বা আনন্দদায়ক কোনো অঅনুষ্ঠানে রঙিন দামী সিল্কের কাপড় দিয়ে পাগড়ি পরা গেলেও দুঃখের অনুষ্ঠানে সাদা-কালো পাগড়ি পরাই রীতি।
পাগড়ি কি শিখ বা পাঞ্জাবীদের মধ্যে প্রচলিত? মোটেই না। প্রায় প্রতিটি ধর্মের ও সংস্কৃতির অনুগামী ব্যক্তিদের মাঝে পাগড়ি ব্যবহার রয়েছে। প্রাচীন ব্যাবিলন সভ্যতার আমলে ব্যাবিলনীয়রা যেমন পাগড়ি ব্যবহার করতেন তেমনি জিউস,ক্রিশ্চান, ইসলাম এবং হিন্দুধর্মের মানুষের মধ্যে পাগড়ির প্রচলন রয়েছে।
মরক্কো দেশে এখনও বয়স্ক ব্যক্তিরা তাদের পাগড়ির ভিতরে খাঁজে খাঁজে টাকা রাখেন।প্রাচীনকালে যখন আইন আদালত, পুলিশ ছিল না তখন তখন শত্রু বা অপরাধী ধরে আনার জন্য এই পাগড়ি পরা হত। শিবাজী নিজে সবসময় পাগড়ি পরে থাকতেন এবং তার খাঁজে থাকত খঞ্জর বা ধারালো ছোরা। রাজস্থানিরা তাদের বিশেষ “গাভারিয়া” পাগড়ির ভিতর আয়না,চিরুনি, তামাক প্রভৃতি জিনিস নিয়ে ঘোরা ফেরা করেন।
এবারে এর আকার আয়তনে আসি। তুরস্কে একসময় সম্রাটদের বিশাল আকারের পাগড়ি ছিল। উচ্চপদস্থ ও অভিজাতরা বিশাল গুম্বুজ আকৃতির পাগড়ি পরতেন।
আর পাতলা বেতের তৈরি গোলাকৃতি কাঠামোর ভিতরে থাকত ফাকা আর কাঠামোর উপির দামী কাপড় জড়ানো হত এতে। আর এর শীর্ষদেশ হত শঙ্কুর আকৃতির। এ ধরনের পাগড়ির নাম “সারিক”।
তুর্কী অটোম্যান সুলতান সুলেমান বিখ্যাত ও চর্চিত ছিলেন তার বিশাল পাগড়ির জন্য। বিশাল আকৃতির কোমড়ার মত দেখতে ছিল যা। অন্তত ৪/৫ ফুট উচু ছিল অই পাগড়ি। ষোড়শ শতাব্দীর তুরস্ক সুলতান যুবরাজ সালিম প্রায় ৩৯ ফুট দীর্ঘ দামি পাগড়ি ব্যবহার করতেন।
ভারতবর্ষেও পাগড়ির ব্যবহার রয়েছে। রাজস্থানিরা তাদের পাগড়ির জন্য গর্ব করে। রাজস্থানের পাগড়ি আবার নানা ধরনের।
পাগড়ি বলতে যা বোঝায় তা ত আছেই এছাড়াও “পেঞ্চা” ও “সেলা” বা “সাফা” হচ্ছে আরো দুই ধরনের। সাধারণ পাগড়ি যেখানে ৮০ ফুট লম্বা ৮ ইঞ্চি চওড়া কাপড় দিয়ে তৈরি সেখানে “সাফা” পাগড়ি ৩৫ ফুট লম্বা ও ৩ ইঞ্চি চওড়া কাপড় দিয়ে তৈরি।
রাজস্থানের পাগড়ির স্টাইল অঞ্চলভেদ নানা প্রকার হয় এমনকি প্রতি ১২ মাইল অন্তর তাদের পাগড়ির স্টাইল পরিবর্তন হয়।
এছাড়া ঋতুভেদ পাগড়ি আছে। বসন্তকালের পাগড়িকে “ফাল্গুনীয়া” আর বর্ষাকালের পাগড়িকে “লর্হরিয়া” বলে।
রাজস্থানের জয়পুরে রয়েছে পাগড়ি মিউজিয়াম যার নাম “সুরভি টার্বান মিউজিয়াম “।
একধরনের বিশেষ পাগাড়ি রয়েছে নাম “দেশান্তরী পাগড়ি”। প্রতি শনিবার তারা এই পাগড়ি পরে হিন্দু শনি দেবতাকে তুষ্ট করেন। তাছাড়া আরেক বিশেষ পাগাড়ি রয়েছে যা ধাতুর তৈরি। একে বলে “বলধিয়াভাট পাগড়ি”।
পাগড়ি কখনো দায়িত্ববোধ এর পরিচায়ক। উত্তর ভারতে পাগড়ি বাঁধার জনপ্রিয় অনুষ্ঠান আছে। নাম “রসম পাগড়ি”
মহিশূরের মানুষ যেসব পাগড়ি পরেন তার নাম “মাইশোর পেতা”।
শিখদের পাগড়ি পরা বাধ্যতামূলক।
প্রথম মোঘল সম্রাট বাবর যখন আগ্রা দখল করেন তখন রাজা হত্যা না করে মুক্ত করে দেন। রাজা তখন কৃতজ্ঞতাবশত তার বহুমূল্যবান হিরে উপহার দেন। বাবর সেই হিরে নিজের পাগড়ির সম্মুখভাগ এ লাগিয়ে রাখতেন।
মোঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ রঙ্গিলা (১৭১৯-১৭৪৮) অত্যন্ত মহার্ঘ “কোহিনুর” কে তার পাগড়ির সামনের দিকে লাগিয়ে রাখতেন। পরবর্তিতে নাদির শাহ ‘পাগড়ির বিনিময় সৌহার্দ্য প্রতীক’ এই ছলে পাগড়ি বিনিময় করে কোহিনুর হাতিয়ে নেন।
যুগে যুগে মানুষ নানা কারণে নানা বৈচিত্রে ভরা পাগড়ি ব্যবহার করে আসছেন আর এই সংস্কৃতি মানুষের সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য দৃঢ় ও শক্তিশালী করে চলছে।