আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা
সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানসচেতনতা দরকার কেন? বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ‘আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা’ গল্পটির সাহায্যে এই চিন্তা উদ্দীপক প্রশ্ন করছে অর্ণব রুদ্র (পদক্ষেপ স্বেচ্ছাসেবী)।
“গত সপ্তাহে স্থানীয় বাণী সিনেমা গৃহে সুপ্রসিদ্ধ চিত্রতারকা ইন্দুবালা দেবী শুভাগমন করেন। নৃত্যকলা-নৈপুণ্যে ও কিন্নরকন্ঠের সঙ্গীতে তিনি সকলের মনোহরণ করিয়াছেন। বিশেষত “কালো বাদুড় নৃত্যে” তিনি যে উচ্চাঙ্গের শিল্প-সঙ্গীত প্রদর্শন করিয়াছেন, রানাঘাটবাসিগণ তাহা কোনদিন ভুলিবে না। এই উপলক্ষে উক্ত সিনেমা গৃহে অভূতপূর্ব জনসমাগম হইয়াছিল-সেও একটি দেখিবার মত জিনিস হইয়াছিল বটে। লোকজনের ভিড়ে মেয়েদের ব্যালকনির নিচে বর্গা দুম্ড়াইয়া গিয়াছিল। ঠিক সময়ে ধরা পড়াতে একটি দুর্ঘটনার হাত হইতে সকলে বাঁচিয়া গিয়াছেন।
বিখ্যাত জার্মান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন গতকল্য দার্জিলিং যাইবার পথে এখানে মিউনিসিপাল হলে বক্তৃতা দিতে নামিয়াছিলেন। তাঁহাকেও সেদিন বাণী সিনেমা গৃহে ইন্দুবালার নৃত্যের সময় উপস্থিত থাকিতে দেখা গিয়াছিল!”
ওপরের খবরটি পড়ে ভাবছেন এ আবার কবে হলো? ঘাবড়াবেন না, এই ঘটনা আদৌ ঘটেনি। পুরোটাই বিভূতিভূষণের কল্পনা। কদিন আগেই ওঁর লেখা ‘আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা’ গল্পটি পড়লাম। সেখানেই এমন কল্পনাজাল বিছিয়েছেন বিভূতিভূষণ। এমন গল্প যে লিখেছিলেন সেটাই আমার অজানা ছিল। তবে গল্পটি থেকে কিছু কথা মনে হলো। সেসব নিয়েই আজকের লেখা। তবে তার আগে গল্পটাও আপনাদের সংক্ষেপে বলছি।
রানাঘাটে আইনস্টাইন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর আগেকার কথা। জার্মানি থেকে আমেরিকায় আসার পর আইনস্টাইন অর্থাভাবের মুখে পড়েন। তাই নানা দেশে বক্তৃতা দিয়ে কিছু অর্থোপার্জন করা স্থির করলেন। সেই সূত্রেই ভারতে আসা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে আইনস্টাইনের বক্তৃতা শুনতে গেলেন কৃষ্ণনগর কলেজের গণিতের অধ্যাপক রায়বাহাদুর নীলাম্বর চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ইচ্ছে হলো কলেজে যদি এমন মানুষকে আনা যায় তাহলে ছাত্রছাত্রীরা অনুপ্রাণিত হবে।
কিন্তু কলেজের অধ্যক্ষ বাধ সাধলেন। ব্রিটিশ প্রভুরা যেহেতু জার্মানদের পছন্দ করেন না তাই আইনস্টাইনকে আনা ঠিক হবে না, এই যুক্তিতে রায়বাহাদুরের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। রায়বাহাদুর হাল ছাড়ার পাত্র নন। আইনস্টাইন হিমালয় দেখতে যাবেন শুনে রায়বাহাদুর ভাবলেন, রানাঘাট যেহেতু রাস্তাতেই পড়বে, এই সুযোগে তাঁকে দিয়ে সেখানে বক্তৃতা দেওয়ানো যায় কিনা।
শেষপর্যন্ত আইনস্টাইনের রানাঘাটে আসা ঠিক হল রায়বাহাদুরের চেষ্টায়। যেদিন আইনস্টাইনের আসার কথা সেদিন রায়বাহাদুর তাঁর কিছু ছাত্রদের নিয়ে রানাঘাট স্টেশনে আগে থেকে এসে পড়লেন সব ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা একবার দেখে নেওয়ার জন্য। ট্রেন থেকে নেমে দেখলেন দেয়ালে পোস্টার পড়েছে ইন্দুবালা দেবী রানাঘাটে আসছেন সেইদিনই। ইন্দুবালা দেবী তখনকার দিনের এক নামজাদা অভিনেত্রী। মানুষের মনে তখনও তাঁর “মিলন” সিনেমার স্মৃতি তাজা। সাবান থেকে শাড়ি সবকিছুর বিজ্ঞাপনেই তাঁর ছবি। রায়বাহাদুর দেখলেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তাতেও সর্বত্র ইন্দুবালার পোস্টার।
ইন্দুবালাও যে সেই ট্রেনেই এসেছেন আর তাঁকে দেখতেই সবাই যে এসেছে সেটা আইনস্টাইনের জানার কথা নয়।
শেষপর্যন্ত যখন বিকেলবেলা দার্জিলিং মেল রানাঘাট স্টেশনে এলো, লোকজন বেশ জমে উঠেছে। আইনস্টাইন রানাঘাটে নেমে ভাবলেন তাঁকে দেখতেই এত লোক। ইন্দুবালাও যে সেই ট্রেনেই এসেছেন আর তাঁকে দেখতেই সবাই যে এসেছে সেটা আইনস্টাইনের জানার কথা নয়। রায়বাহাদুর ও তাঁর সঙ্গীরা প্রমাদ গুনলেন। আইনস্টাইনের বক্তৃতা যেখানে দেওয়া ঠিক হয়েছিল সেই রানাঘাটের মিউনিসিপাল হলে যখন পৌঁছলেন সবাই, হলঘর তখন শুনশান। এরপর বেশ কিছুক্ষণ পরেও রানাঘাটের কেউ যখন ওমুখো হলো না, রায়বাহাদুর আর আইনস্টাইন দুজনেই যে কত অপদস্ত হলেন সেটা পাঠক নিশ্চয় বুঝতেই পারছেন। রায়বাহাদুর এরপর আর কিই বা করেন, হাল ছেড়ে দিয়ে আইনস্টাইনকে নিয়ে পৌঁছলেন বাণী সিনেমা হলে। পরের দিন খবরের কাগজে কি বেরিয়েছিল সেটাই একদম শুরুতে উদ্ধৃত করেছি।
গল্পটা কেন এখনো একইরকম প্রাসঙ্গিক
গল্পটি পড়তে গিয়ে দেখেছি, প্রতিপদে বিভূতিভূষণের বিজ্ঞানের প্রতি ঔৎসুক্য ধরা পড়েছে। এক জায়গায় তো তিনি লিন্ডন বোল্টনের আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে তৎকালীন বহুলপ্রচারিত বইটির উল্লেখও করেছেন। বিভূতিভূষণ যে তখনকার বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে পড়াশোনা করতেন, খোঁজখবর রাখতেন, তা বেশ বোঝা যায়। যাই হোক, এ তো গেল বিভূতিভূষণের কথা।
বাংলার সাধারণ মানুষ যে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে অথবা বিজ্ঞানীদের ব্যাপারে কতখানি উদাসীন সেকথা বেশ ব্যঙ্গাত্মকভাবে লিখেছেন বিভূতিভূষণ। বাঙালির “অলিক কুনাট্যরঙ্গে” মেতে ওঠার ঐতিহ্যের সঙ্গে আইনস্টাইনের বক্তৃতা একেবারেই মানায় না, আর তাই তাঁর কথা শুনতেও কেউ যায়নি। এই বিষয়টা হয়ত এখনো একইরকম ভাবে সত্যি। আজও বাংলার সাধারণ মানুষ বর্তমান বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে যে খুব উৎসাহী তা নয়।
এর মাঝেও আশার আলো রয়েছে। বহু বাঙালি ছাত্রছাত্রী অতি উচ্চমানের গবেষণায় মেতে রয়েছেন দেশে ও বিদেশে এবং তাদের শিক্ষা দিয়ে চলেছেন কিছু অসামান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা। এই জমানার নানা প্রযুক্তিগত উন্নতির পিছনেও রয়েছে বহু বাঙালি ছাত্রছাত্রীর নাম। বহু বাঙালি ডাক্তার তাদের গবেষনার মধ্যে দিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে নতুন নতুন দিশা দেখাচ্ছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানসচেতনতা সময়ের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বাড়েনি।
বিজ্ঞানের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে না থেকেও বিজ্ঞানসচেতন হওয়া যায় এবং হওয়াও দরকার। একটা সমাজ সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞানসচেতন না হলে কিভাবে আমাদের উন্নয়ন হবে? আমাদের ভবিষ্যৎ গভীরভাবে আমাদের বিজ্ঞানবোধের ওপর নির্ভর করছে। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে আপনাদের এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে অনুরোধ করব। পরিবেশদূষণ কিভাবে দ্রুত পৃথিবীকে অবাসযোগ্য করে তুলছে, জিনগত পরিবর্তন খাদ্যে অথবা চিকিৎসায় কিভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, অথবা মঙ্গলগ্রহে যান পাঠানো দরকার কিনা ইত্যাদি ঠিকমত বুঝতে হলে বিজ্ঞানের কিছু প্রাথমিক ধারণা এবং তার সঙ্গে সমকালীন বিশ্বে বিজ্ঞান গবেষণা সম্পর্কে ধারণা থাকা খুবই জরুরি। এইসব বিষয়গুলো আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িত। তাই এই বিষয়ে সরকার যদি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন আমাদের জানা দরকার যে সরকারের সেই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে, ভালো অথবা খারাপ যেভাবেই হোক না কেন। আর আমাদের বহু সমস্যার সমাধান যে বিজ্ঞানের দ্বারাই হবে সেকথা তো আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন রাখে না। প্রকৃত গণতন্ত্র শিক্ষিত ও সচেতন জনতার দ্বারাই গড়ে ওঠে। কিন্তু তার জন্য তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করাও জরুরি এবং সে কাজ করতে হবে সাধারণ মানুষকেই।