মূল :আলহাজ্জ সর্দার মুহাম্মদ আব্দুল হামিদ তরজমা : মনসুর আজিজ
মূল :আলহাজ্জ সর্দার মুহাম্মদ আব্দুল হামিদ
তরজমা : মনসুর আজিজ
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
[খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি লিখা। অনেক আগে পড়েছিলাম। আপনাদের জন্য অনেক কষ্টে লিখাটা বই থেকে হুবহু লিখে এখানে দিলাম। সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো। _ মুজাহিদুল ইসলাম]
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
বিখ্যাত বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্ম্রতি বিভ্রাটের আসল কারণটি যখন আমার মনে পড়ে,তখন আমি খুব দু:খ অনুভব করি । কবি বন্ধু মইনুদ্দীন তাঁর ‘যুগস্রষ্টা নজরুল’-এ এই বিষয়টা লিপিবদ্ধ করেছেন । পরে এটা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় ।
আমার যদ্দুর মনে পড়ে, এটা ছিল ১৯৪৫ সালের মে মাস । তখন আমি ভারতের মালদহে মাদ্রাসা ইসলামিয়া আরাবিয়া প্রতিষ্ঠা করি । আমি এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলাম । মাদ্রাসার ফান্ড সংগ্রহের জন্য রশিদ বই ছাপতে আমি কলকাতায় যাই । সীল, রাবার স্ট্যাম্প সহ অন্যান্য কিছু জিনিসপত্র ক্রয় করাও ছিল উদ্দেশ্য । এর সাথে ছিল আমার ‘থাম’ (stop) গ্রন্থের পান্ডুলিপি । (এটার ইংরেজী শিরোনাম ছিল ‘The mound’ USIS এর টাকার প্রধান তথ্য কর্মকর্তার কাছে আমি ১৯৬২ সালে নোবেল পুরস্কার প্রতিযোগিতার জন্য এটার ইংরেজী অনুবাদ পাঠিয়েছিলাম । এটা ছাপানোও উদ্দেশ্য ছিল আমার ।
সেই সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন দৈনিক নবযুগ পত্রিকার সম্পাদক । মাওলানা আহমদ আলী ছিলেন এর সহ সম্পাদক ।
দুজনেই ভালো করে চিনতেন । কয়েকমাস আগেই আমি তাদের দুজনকে আমার গানের বই ‘কুসুম’ উপহার দিয়েছিলাম । কবি নজরুল ইসলাম এটার উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন । নবযুগ অফিস ছিল কলকাতার লায়ার সার্কুলার রোডের পশ্চিম দিকে ।
আমি মাওলানা আহমদ আলী সাহেবের সাথে দেখা করে আমার ‘থাম’ (stop) গ্রন্থটি নবযুগ প্রেসে ছাপানোর জন্য অনুরোধ করি।
তিনি দু:খ প্রকাশ করে বললেন, বই ছাপানো আমাদের কাজ নয় । তাছাড়া,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বই ছাপানোর পর্যাপ্ত কাগজও বাজারে নেই । এরপর তিনি বললেন, ডিকসেন লেনে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয়ের কাছে তাদের একটি প্রেস আছে । ছাপাখানায় পর্যাপ্ত কাগজও আছে । প্রেসের ম্যানেজার মনিন্দ্র নাথ (এম.এ.) একজন ভদ্র মানুষ । আমি আশা করি মনিন্দ্র বাবু আপনাকে সাহায্য করবেন ।
আমি তৎক্ষনাত মনিন্দ্র বাবুর সাথে দেখা করলাম ।Stop-এর কয়েকটি পাতা উল্টিয়েই তিনি এটা পছন্দ করে ফেললেন । বই ছাপতে ইচ্ছা প্রকাশও করলেন । আমি যেন ফাইনাল প্রুফ-টা নিজে দেখতে পারি, সেজন্য তিনি কলকাতায় আমাকে কমপক্ষে একমাস থাকার জন্য অনুরোধ করলেন । কারণ হিসেবে তিনি বললেন, বইটা মানের দিক থেকে যেমন উচু তেমনি এতে রয়েছে কঠিন কিছু বিষয় । আমি তাঁর সাথে একমত হলাম এবং বই ছাপতে তাকে পান্ডুলিপিটি দিলাম । একমাসের মধ্যে কাজটি শেষ করবেন বলে তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন ।
এরপর আমি নবযুগ অফিসে গেলাম মাওলানা আহমদ আলী সাহেবের কাছে । তাকে অনুরোধ জানালাম একমাসের জন্য আমাকে একটি কাজ জুটিয়ে দেয়ার জন্য,যাতে আমি আমার ন্যুনতম ব্যয়টুকু উপার্জন করতে পারি । আমি আমার বৃদ্ধ পিতার বোঝা আর বাড়াতে চাইছিলাম না ।
তিনি আমাকে বললেন, আপনার একটি চমৎকার সুযোগ আছে । দুদিন আগেই আমাদের বার্তা সম্পাদক ভালো একটি কাজ পেয়ে ইস্তফা দিয়ে চলে যান । তিনি আমাকে আরো বললেন,আমি যেন সম্পাদকের (কাজী নজরুল) সাথে দেখা করে উক্ত পদের জন্য আবেদন করি । আমি তখনই কবির সাথে দেখা করে তাকে একটা আবেদন পত্র দেই । তিনি হাসিমুখে আমাকে সম্ভাষণ জানালেন এবং তৎক্ষনাত চাকুরিতে যোগদানের জন্য অনুরোধ করেন । নবযুগের বার্তা সম্পাদক পদে আমি সেদিনই যোগদান করি ।
সার্কুলার রোডের আমজাদিয়া হোটেলের একটি রুম ভাড়া করলাম আমি । এটা ছিল শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশনের কাছে আমজাদিয়া হোটেলের একটি শাখা । আমার থাকার জায়গা থেকে নবযুগ অফিসের দুরত্ব ছিল এক মাইলের কিছু বেশি ।
দুই সপ্তাহের মধ্যে আমার বই ছাপার কাজ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে । একদিন আমার অফিসের কাজ একটার মধ্যে শেষ হয়ে যায় । কবি নজরুলের সাথে দেখা করে চলে আসার জন্য আমি তাঁর অনুমতি চাচ্ছিলাম । তিনি আমাকে বসতে বললেন । বললেন,আপনার সাথে ধর্ম নিয়ে ‘বাহাস’ করতে চাই । আমি বসে পড়লাম । তিনি কথা শুরু করলেন ।
আমি বললাম,আপনি একজন বিখ্যাত কবি । তাই আপনার সাথে ‘বাহাস’ করতে আমি রাজি নই । কিন্তু আমাকে দয়া করে বলুন, আপমি কি জানতে চান । আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যদ্দুর সম্ভব আল্লাহ’র মেহেরবাণীতে তা আমি আপনাকে জানাতে চেষ্টা করবো ।
তিনি আমাকে বললেন,ধর্মের ব্যাপারে আপনার অভিমত কি ? আপনি কি মনে করেন শুধু মুসলমানরাই বেহেশতে যাবে ? আমি বললাম, হ্যা । কুরআনের আলোকে আমি বিশ্বাস করি সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা -এর আগমনের পর পৃথিবীতে সকল ধর্মমত বাতিল হয়ে গেছে । আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন _ “ان الدين عند الله الاسلام (ইন্নাদ্দীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম)” অর্থ্যাৎ, ইসলামই হচ্ছে আল্লাহ’র মনোনীত একমাত্র জীবন বিধান । তাই যারা ইসলামের এই ঘোষণা শুনেছে তাদের উচিৎ ইসলাম গ্রহণ করা,যদি তারা মুক্তি চায় ।
তিনি বললেন, না । আপনি ভুল বলছেন । আল্লাহ এ আয়াতে তা বলেননি এ আয়াতে আল্লাহ বলতে চেয়েছেন সকল ধর্মের চেয়ে ইসলামই তাঁর কাছে বেশি পছন্দনীয় এবং ইসলামই হচ্ছে তাঁর কাছে পৌছার সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ । কিন্তু অন্যান্য ধর্মের অনুসারীগণও তাঁর কাছে পৌছবে । হয়ত পৌছুতে কিছুটা দেরী হতে পারে ।
আমি বললাম, কবি সাহেব. কিছু মনে করবেন না । আমি আপনার এ যুক্তি মেনে নিতে পারছিনা ।
তিনি বললেন, ঠিক আছে, বিষয়টা আমি আরো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিচ্ছি । এরপর তিনি বড় একটি সাদা কাগজ টেবিলের উপ রাখলেন । আমরা বসেছিলাম মুখোমুখি । কবি যেদিকে বসেছিলেন সেদিকে সাদা কাগজের উপর কলম দিয়ে একটা ‘ডট’ চিহ্ন দিলেন । সেখানে ‘A’ ও ‘B’ যোগ করে সোজা একটা রেখা টানলেন কাগজটির উপর । এরপর এ সরলরেখার উভয় পাশে কিছু আঁকাবাঁকা রেখা টানলেন যেগুলোর প্রান্তনিন্দু ‘A’ ও ‘B’ তে এসে মিলিত হয়েছে । এরপর তিনি বললেন,এখানে দেখুন । মনে করুন আমার পাশের ‘A’, এটা একজন ব্যক্তি । আর আপনার পাশে ‘B’ আল্লাহকে মিন করছে । আর সোজা যে রেখাটি, সেটি ইসলাম । যে লোকটা ইসলাম অনুসরণ করছে, সে ঐ সরলরেখাটি ধরে খুব সহজে অল্প সময়ে আল্লাহ’র কাছে পৌছে যাবে । মনে করুন,বক্র রেখাগুলো অন্যান্য ধর্মকে মিন করছে । যদি লোকটি সরল পথে না গিয়ে অন্যান্য ধর্ম অনুসরণ করে বাঁকা পথে চলে, তবুও সে আল্লাহ’র কাছে পৌছুতে পারবে । কিন্তু এতে তার সময় লাগবে বেশি । এটাই আমার বক্তব্য ।
আমি বললাম, কবি সাহেব, আপনি ধর্মকে এভাবে বিশ্লেষণ করতে মৌলিক ত্রুটি করছেন । আল্লাহ কুরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘বিশ্বাস’ বা ‘ধর্ম’ হলো ‘নুর’ বা ‘আলো’ । আপনি কি কখনো টর্চের ফোকাস লক্ষ্য করেছেন ? তিনি বললেন, হ্যা,অনেকবারই লক্ষ্য করেছি ।
আমি বললাম, ফোকাসের আলোর রেখা কি কখনো আঁকাবাঁকা পথে চ্যলে, নাকি সরল পথে চলে ? তিনি বললেন, এটা তো সব সময় সরল পথেই চলে । তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন । এরপর বললেন, আপনি তো চমৎকার একটা যুক্তি দেখালেন । আমিতো আলেম উলামাদের সাথে বহুবার ধর্ম নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছি । কি. এমন যুক্তি তো তারা কেউ আমাকে দেখায়নি ! কিন্তু, আপনি নুর বা আলোর এ বিষয়টা এত সহজে কিভাবে ব্যাখ্যা করলেন ? এটা তো আমি সাধুদের রাতের বেলা ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখতে পাই । যখন আমরা শ্মশ্মান বা বার্নিংঘাটে চিতার ধরে মিলিত হই ।
আমি বললাম, আপনি ধ্যানের মধ্যে যা দেখেন, সব শয়তানের কারসাজি । যদি আপনার পাশে আমার মতো একজন আলেম থাকেন, তাহলে শয়তান আপনার ধরে কাছেও ঘেষতে পারবে না । আর আপনি তেমন অদ্ভূত কিছুই দেখতে পাবেন না । নজরুল বললেন, কিন্তু আমি যখন গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকি, তখন যেসব জিনিস দেখতে পাই, তার কি ব্যাখ্যা দেবেন আপনি ?
আমি তাকে বললাম , দয়া করে আপনি আমার সামনে ধ্যানে মগ্ন হোন । আর বলুন, আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন । এরপর কবি চোখ বন্ধ করে মোরাকাবায় (গভীর ধ্যান) বসে গেলেন । পাঁচ মিনিট পর তিনি বললেন,(চোখ বন্ধ রেখেই ধ্যান অবস্থায় ) আমি নীল্ আলো দেখতে পাচ্ছি । আমি বললাম, এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় । আপনি ধ্যান চালিয়ে যান । আবার পাঁচ মিনিট পর তিনি বললেন, এখন আমি লাল আলো দেখতে পাচ্ছি । আমি বললাম,আপনি ধ্যান চালিয়ে যান । আরো কয়েক মিনিট পর তিনি বললেন, এখন আমি কোনো আলো দেখতে পাচ্ছি না । সবকিছুই কালো অন্ধকার । মনে হচ্ছে পুরো আকাশে কে যেন কয়লার কালি মাখিয়ে দিয়েছে ।
আমি বললাম, আমি মনে করি, সাধুরা তাদের ধ্যানের ফলে এ পর্যন্তই পৌছুতে পারে । তারা তাদের ধ্যানের দ্বারা এই কালো পর্দা আর উম্মোচন করতে পারে না । সম্ভবত : এ অবস্থাটাকেই সাধুরা তাদের হৃদয়ে ‘মা কালী’র মূর্তি চিত্রিত করে নেয় । আর নিজেদেরকে তুষ্ট করে ‘মা কালী’র পূজা করে । আপনার হৃদয়ে তো কালীর মূর্তি থাকার কথা নয় । সেখানে তো থাকার কথা তৌহিদের জ্যোতি । আপনি ধ্যান অব্যাহত রাখুন । আর আমাকে বলুন, এরপর কি দেখতে পাচ্ছেন । যদি আপনি এই কালো পর্দা ভেদ করতে পারেন, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন তাওহীদের উজ্জল জ্যোতি । যার রং হবে সাদা ।
তিনি নিবিষ্ট মনে তাঁর ধ্যান অব্যাহত রাখলেন । কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁর হাসিমাখা চেহারাটা বেদনায় মলিন হয়ে গেল । আর মুখমন্ডল ও কপালে জমতে লাগলো বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোটা । দশ মিনিট পর হঠাৎ তিনি বিকট চিৎকারে চারপাশ প্রকম্পিত করে তুললেন । কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলতে লাগলেন, “হায় ! হায় ! আমি তো ধ্বংস হয়ে গেছি । আমার সবকিছু তো বরবাদ হয়ে গেল । ভুল পথ অনুসরণ করে আমি তো শেষ হয়ে গেছি । হায় , কি দুর্ভাগ্য আমার ! আমার কপালে তো জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নেই ।”
তাঁর বিকট চিৎকার আর আহাজারি শুনে অফিসে কর্তব্যরত সকলেই ছুটে এলেন ।তাঁর অবস্থা দেখে সবাই হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন । তিনি চিৎকার করে সকলকে বললেন, বের হয়ে যাও । বের হয়ে যাও এখান থেকে । এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার । এক্ষুনি বের হয়ে যাও এখান থেকে ।
সবাই বিষন্ন মনে রুম থেকে চলে গেল । কবি আমাকে দরজাটি বন্ধ করে দিতে অনুরোধ করলেন । আমি দরজা বন্ধ করে বললাম, কবি সাহেব, আপনার এই মানসিক অবস্থা থেকে পরিত্রান পাওয়া কঠিন কিছু নয় । মহান প্রভু তাঁর অনুতপ্ত বান্দাদের ক্ষমা করার জন্য সব সময় প্রস্তুত রয়েছেন ।
পড়ুন,”ওয়াস্তাগফিরুল্লাহী রাব্বি মিন কুল্লি জাম্বিউ ওয়াতুবি ইলাইহি লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউল আজিম ।”
এরপর পড়ুন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” । তিনি এটা কয়েকবার পড়লেন । এরপর আমি বললাম, এখন আপনি একজন সাচ্চা মুসলমান । দয়া করে আর কাঁদবেন না ।
আমি আল্লাহ’র কাছে সাক্ষ্য দেব যে, আপনি আমার সামনে পূর্ব গোনাহের জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন । আন্তরিকভাবে তওবা করেছেন এবং আল্লাহ’র একত্ববাদের ঘোষণা দিয়েছেন । এখন থেকে আল্লাহ’র নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিটি কাজ চালিয়ে যান । ইনশা’আল্লাহ আল্লাহ পাক আপনাকে তাঁর জান্নাতে দাখিল করবেন ।
এ সময় প্রেসের এক কর্মকর্তা এসে কবি নজরুলকে বললেন, স্যার পত্রিকার সব ম্যাটার রেডি শুধু আপনার সম্পাদকীয় বাকী আছে । দয়া করে তাড়াতাড়ি সম্পাদকীয়টা লিখে দিন । যাতে এক ঘন্টার মধ্যে আমরা ছাপার কাজ শুরু করতে পারি । কবি বললেন, আমার মনের অবস্থা ভালো নেই । এখন কোনো কিছু লেখার শক্তি ও মনোবল আমার নেই । মাওলানা সাহেবের (আহমদ আলী) কাছে যান । আজকের জন্য উনাকে সম্পাদকীয় লিখতে বলেন ।
আমি লোকটাকে বললাম, কবি মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছেন । তাঁকে রুমের ভেতর একা থাকতে দিন । এরপর কবি বললেন, আমাকে আপনার সাথে নিয়ে চলুন । আমি আপনার সাথে আমজাদিয়া হোটেলে যাব । ওখান থেকে পরে বাসায় যাব ।
তিনি হিন্দু এলাকা শ্যামবাজারে থাকতেন । এটা হোটেল থেকে দুই মাইল উত্তর দিকে । পরের দিন অসুস্থতার জন্য কবি তাঁর অফিসে আসেননি । দ্বিতীয় দিনেও তিনি অফিসে আসেননি । আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম,তাঁর অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে । কবির ডাক্তার বলেছেন । তিনি প্রচন্ডভাবে মানসিক আঘাত পেয়েছেন । এর ফলে তাঁর ব্রেনে কিছুটা ত্রুটি দেখা দিয়েছে । মস্তিস্ক বিকৃতির কিছু লক্ষণ দেখা দিয়েছে । তাই তাঁকে আলাদা একটি রুমে তালা মেরে রাখা হয়েছে । ডাক্তার তাঁর স্ত্রীকে বলেছেন, কারো সাথে যেন কবিকে কথা বলতে দেয়া না হয় । কথাগুলো শুনে আমি খুবই দু:খিত ও অনুতপ্ত হয়েছিলাম ।
পরের দিন তাঁকে দেখতে যাব বলে মনস্থ করলাম । কিন্তু, হোটেলে ফিরে এসেই বড় ভাইয়ের চিঠি পেলাম । মা মৃত্যুশয্যায় পড়ে আছেন । মা আমাকে দেখতে চান । আমি আর দেরী না করে দশটার ট্রেনে উঠে পড়লাম (নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে) । আমি বাড়ি পৌছার পর আল্লাহ’র অশেষ মেহেরবাণীতে আম্মার অবস্থার দ্রুত উন্নতি হলো । এক সপ্তাহ পর আমি সংবাদপত্রে একটি নিউজ দেখতে পাই, কবি নজরুল ইসলাম পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছেন । এ সংবাদটা আমাকে প্রচন্ড আঘাত দেয় । এরপর আমি নবযুগে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেই ।
কবি নজরুল ইসলাম খুব উচু মনের মানুষ ছিলেন । ইসলামের প্রতি তিনি ছিলেন সংবেদনশীল । রাজশাহী কলেজের জনৈক অধ্যাপক আমাকে নজরুলের ভ্রান্ত ধর্মমতের কারণ বলেছিলেন । বিষয়টা ছিল এরকম, কবি নজরুল তাঁর বিপ্লবী প্রতিভা, জ্বালাময়ী প্রবন্ধ আর শত শত গান-এর মাধ্যমে যখন উভয় বাংলায় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই জনপ্রিয়তা সমূলে উৎখাত করার জন্য ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে কার্যকরী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন । রবীন্দ্রনাথ এমন ভান করলেন যে তিনি নজরুলের একজন কল্যানকামী ব্যক্তি । নজরুলকে তিনি তাঁর বাড়িতে দাওয়াত করলেন । এ তরুণ কবি ছিলেন তখন অবিবাহিত । ঠাকুর পরিবারের সবার সাথে নজরুলকে খোলামেলাভাবে মেশার সুযোগ করে দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । সেখানে এক তরুনীর দ্বারা নজরুলকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলেন, যে ছিল ঠাকুর পরিবারের আত্মীয়া । নজরুল অবশেষে সেই হিন্দু তরুণীকে বিয়ে করলেন । বাঙালি মুসলমানগণ নজরুলের এ বিয়ে মেনে নিতে পারেনি । তাঁরা তাঁকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করলো ও তাঁকে বয়কট করলো ।
কবি এ পর্যায়ে এমন এক সংকটে নিপতিত হলেন, যা তাঁকে অনবরত মানসিক যন্ত্রণা দিতে থাকে । এরপর তিনি হিন্দু ধর্মের প্রতি খুব বেশি ঝুকে পড়েন । হিন্দুদের কিছু উপাসনাও তিনি করতে থাকেন হিন্দু সাধুদের সাথে মিলে । সাধুদের সাথে মেলামেশা ও আরাধনা তাঁর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল প্রবলভাবে । যার কারণে তিনি ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছিলেন । এ জন্য পরে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং নিজেকে শোধরে নেবার চেষ্টাও করেছেন ।
মহান প্রভু তাঁর এ তওবা কবুল করুন । আর তাঁকে দান করুন বেহেশতের শ্বাশ্বত শান্তি । (আমীন) ।
________
(উৎস : The leader, 18th April,1983 Karachi, Pakistan)
সৌজন্যে : মাসিক ‘নতুন কলম’, আগস্ট ২০০২ সংখ্যা