সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী
মিঠু সূত্রধর পলাশ,নবীনগর প্রতিনিধি: সংগীত জগতের কিংবদন্তি শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশের মাইহারে মৃত্যুবরন করেন। তিনিই প্রথম বাঙালী যিনি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যে এই উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে পরিচয় করিয়ে দেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে বিখ্যাত এক সংগীত শিল্পী পরিবারে আনুমানিক ১৮৬২ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁ ছিলেন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ। আলাউদ্দিনের ডাকনাম ছিল ‘আলম’।
বাল্যকালে অগ্রজ ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর কাছেই সংগীতে তাঁর হাতেখড়ি হয়। সুরের সন্ধানে তিনি দশ বছর বয়সে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছেড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এক যাত্রাদলের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। ওই সময় তিনি জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, পাঁচালি প্রভৃতি গানের সঙ্গে পরিচিত হন। অতঃপর কলকাতা গিয়ে তিনি প্রখ্যাত সংগীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নুলো গোপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তবে গোপাল কৃষ্ণ একটি শর্তারোপ করলেন আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণের সময়, কমপক্ষে ১২ বছর একনাগাড়ে সংগীত সাধনা করতে হবে তার কাছ থেকে। আলাউদ্দিন খাঁ রাজি হয়ে গেলেন আরোপিত শর্তে। কিন্তু সাত বছরের শেষ দিকে হঠাৎ প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন সংগীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ।
পিতৃহীনের মতো দুঃখ-শোকে কিছুদিন পাথর হয়ে রইলেন আলাউদ্দিন খাঁ। ক্রমে শোকের ভার কমলে হঠাৎ কণ্ঠ সংগীত সাধনা ছেড়ে দিয়ে তিনি যন্ত্র সংগীত সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন করলেন। স্টার থিয়েটারের সংগীত পরিচালক অমৃত লাল দত্ত ওরফে হাবু দত্তের নিকট তিনি বাঁশি, পিকলু, সেতার, ম্যাডোলিন, ব্যাঞ্জু ইত্যাদি দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন। সেই সঙ্গে তিনি লবো সাহেব নামে এক গোয়ানিজ ব্যান্ড মাস্টারের নিকট পাশ্চাত্য রীতিতে এবং বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ অমর দাসের নিকট দেশীয় পদ্ধতিতে বেহালা শেখেন। এছাড়া হাজারী ওস্তাদের নিকট মৃদঙ্গ ও তবলা শেখেন। এভাবে তিনি সর্ববাদ্য বিশারদ হয়ে ওঠেন।
আলাউদ্দিন খাঁ কিছুদিন ছদ্মনামে মিনার্ভা থিয়েটারে তবলা বাদকের চাকরি করেন। অতঃপর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার জগৎ কিশোর আচার্যের আমন্ত্রণে তার দরবারে সংগীত পরিবেশন করতে যান। সেখানে ভারতের বিখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ আহমেদ আলী খাঁর সরোদ বাদন শুনে তিনি সরোদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁর নিকট পাঁচ বছর সরোদে তালিম নেন। এরপর ভারতখ্যাত তানসেন বংশীয় সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর নিকট সরোদ শেখার জন্য তিনি রামপুর যান। ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ রামপুরের নবাব হামেদ আলী খাঁর সংগীত গুরু ও দরবার সংগীতজ্ঞ ছিলেন। আলাউদ্দিন খাঁ তাঁর নিকট দীর্ঘ ত্রিশ বছর ‘সেনী ঘরানায়’ সংগীতের অত্যন্ত দুরূহ ও সূক্ষ¥ কলাকৌশল আয়ত্ত করেন।
মাইহারের রাজা ব্রিজনাথ আলাউদ্দিন খাঁকে নিজের সংগীত গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত করলে তিনি মাইহারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বেরিলির পীরের প্রভাবে তিনি যোগ, প্রাণায়াম ও ধ্যান শেখেন। এভাবে জীবনের একটা বড় অংশ আলাউদ্দিন শিক্ষার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন। অতঃপর শুরু হয় তাঁর কৃতিত্ব অর্জনের পালা।
১৯৩৫ সালে তিনি নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তিনি উদয় শঙ্কর পরিচালিত নৃত্যভিত্তিক কল্পনা শীর্ষক একটি ক্ল্যাসিকধর্মী ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন। আলাউদ্দিন খাঁ সরোদে বিশেষত্ব অর্জন করেন। সহজাত প্রতিভাগুণে তিনি সরোদ বাদনে ‘দিরি দিরি’ সুরক্ষেপণের পরিবর্তে ‘দারা দারা’ সুরক্ষেপণ পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। সেতারে সরোদের বাদন প্রণালী প্রয়োগ করে সেতার বাদনেও তিনি আমূল পরিবর্তন আনেন। এভাবে তিনি সঙ্গীত জগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন, ‘যা আলাউদ্দিন ঘরানা’, ‘মাইহার ঘরানা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
আলাউদ্দিনের পরামর্শ ও নির্দেশে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবিত হয়। সেগুলোর মধ্যে ‘চন্দ্র সারং’ ও ‘সুর শৃঙ্গার’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি অনেক রাগ-রাগিনীও সৃষ্টি করেন। যেমন হেমন্ত, দুর্গেশ্বরী, মেঘবাহার, প্রভাতকেলী, মেহবেহাগ, মদন মঞ্জুরি, মোহাম্মদ (আরাধনা), মানঝ খাম্বাজ, ধবল শ্রী, সরস্বতী, ধনকোশ, শোভাবতী, রাজেশ্রী, চন্ডিকা, দীপিকা, কেদার, ভুবনেশ্বরী ইত্যাদি। তিনি দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে আর্কেস্টার স্টাইলে একটি যন্ত্রীদল গঠন করে নাম দেন ‘রামপুর স্ট্রিং ব্যান্ড’।
বহুসংখ্যক যোগ্য শিষ্য তৈরি তাঁর অপর কীর্তি। তাঁর সফল শিষ্যদের মধ্যে তিমির বরণ, পুত্র আলী আকবর খান, জামাতা পন্ডিত রবিশঙ্কর, ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুর হোসেন খান, কন্যা রওশন আরা বেগম (অন্নপূর্ণা), ফুলঝুরি খান, খাদেম হোসেন খান, মীর কাশে খান, পন্ডিত যতীন ভট্টাচার্য, পান্নালাল ঘোষ, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, পৌত্র আশীষ খান, ধ্যানেশ খান, খুরশীদ খান, ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
ব্রিটেনের রাণী তাঁকে ১৯৩৬ খ্রি. ‘সুর স¤্রাট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অতঃপর ভারত সরকার তাঁকে একে একে ‘সংগীত নাটক আকাদেমী সম্মান’ (১৯৫২ খ্রি.), ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৭১ খ্রি.), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ‘দেশীকোত্তম’ (১৯৬১ খ্রি.) এবং দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডক্টর অব ল’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫৪ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক প্রথম সঙ্গীত নাটক আকাদেমীর ফেলো নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল তাঁকে আজীবন সদস্যপদ দান করে। এসব দুর্লভ সম্মান ও খেতাব সঙ্গীতবিদ্যায় আলাউদ্দিন খাঁর অসাধারণ কীর্তি ও সাফল্যকেই প্রমাণ করে। তিনি ভারত বর্ষে পরিচিত হন বাবা আলাউদ্দিন নামে। কিন্তু জন্মভূমির টানে একপর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে এসে বসবাস শুরু করেন। এই বাড়িটিতে এখন শাস্ত্রীয় সংগীতের শিক্ষা দেয়া হয়। ২০১৬ ও এ বছরের ২০২১ সালে শুরুর দিকে হেফাজতের উগ্র মৌলবাদীরা এই ‘দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গ’টি অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে।
‘দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গ’নের সম্পাদক কবি আবদুল মান্নান সরকার জানান বিশ্ব বিখ্যাত সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বাংলাদেশে অত্যন্ত অবহেলিত। এমনকি নব্বই দশকের আগে বাংলাদেশের রেডিও টিভিতে তার মৃত্যু বার্ষিকী পর্যন্ত পালিত হতো না। বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীত সাধক আলাউদ্দিন খাঁর আজ ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।