নারীর মর্যাদা
ফারহান আহমেদ ফুয়াদ: আমি এমন একটি বিষয় নিয়ে লিখতে যাচ্ছি, যা একটি জাতীয় পর্যায়ের বিষয়। নারীর মর্যাদা নির্ণয় করতে বাকাইল গ্রামের অনু চৌধুরী বনাম বড়াইল গ্রামের গণু মিয়া একদিন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। সেই বিতর্কের সারাংশটুকু লেখার প্রয়াস করেছি।
ইসলাম তথা পবিত্র কোরআনে যা বলা হয়েছে, তা চিরন্তন , কেউ বদলাতে পারবে না। তবে ‘মানুষ’ ,আমরাই কাউকে পায়ের নিচে রাখি, আবার কাউকে মাথায় রাখি। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তার রয়েছে বেশুমার মেধাশক্তি এবং তার স্বাক্ষর রেখেও যাচ্ছে এই ধরণীতে। তেমনি রেখে যাচ্ছে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা। লোকে বলে “মানুষের এই কর্ম দেখে শয়তানও নাকী চমকে উঠে”। যাক, মূল প্রসঙ্গে এগোয়।
হীরা, স্বর্ণ, মণি-মুক্তা মহা মূল্যবান বস্তু, কেননা, তা দুষ্প্রাপ্য। এগুলোর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা কঠোর এ হিসেবে নারীর মূল্য বেশী নয়, কারণ, সমাজে নারী দুষ্প্রাপ্য নয়। পানি জিনিসটা নিত্য প্রয়োজনীয় অথচ এটা দামে সস্তা। কিন্তু যদি কখনো পানির একান্ত অভাব হয় তখন এক ফোটাঁ পানির জন্য শ্রেষ্ঠ রত্নটি দিতে কেউই ইতস্তত করবে না। তেমনি আল্লাহ না করুক, যদি কোন দিন সংসারে নারী বিরল হয়ে উঠেন, সেই দিনই নারীর যথার্থ মূল্য কত, সে তর্কের নিষ্পত্তি তখন হয়ে যাবে- আজ না। আজ নারী সস্তা।
শ্রী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধে লিখেছেন- “নারীর জন্য সোনার লঙ্কা নিপাত হইয়াছিল, ট্রয় রাজ্য ধ্বংস হইয়া গিয়াছিল। আরও ছোটবড় কত রাজ্য হয়ত ইতিপূর্বে নষ্ট হইয়া গিয়েছে, ইতিহাস সে কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া রাখে নাই”। তাহলে নারীতে এমন কি ছিল যে সাম্রাজ্য ভাসাইয়া দিতেও মানুষ দ্বিধা করে নাই, এমনকি প্রাণ দিতেও। এখন আমাদের খাতায় জায়গা কত যে নারীর দাম আমি কষিয়া বের করব ? তবু পুরুষের মনের দিকে চেয়ে বলতে পারি, কতটা যে নারীর দিকে চেয়ে আর কতটা যে নিজের অসংযত আর উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তির দিকে চেয়ে রাজ্য আর জীবন বিসর্জন দিয়েছে- সে জবাব কে দিবে ? এখন ইউরোপ আমেরিকা এমনকি কিছু উগ্রপন্থী মানুষ এ দেশের মানুষকে চোখ রাঙ্গাইয়া বলে ” তোমরা নারীর মূল্য দিতে জানো না, মর্যাদা বোঝ না, আমোদ-ফুর্তিতে তাদের যোগ দিতে দাও না, ঘরের কোণে আবদ্ধ করে রাখো,– তোমরা বর্বর, মধ্যযুগীয় “। তখন আমরা হাদিস-কোরআন হতে বাণী উদ্ধৃতি দিয়ে পাল্টা জবাবে বলি “আমরা মা-বোনের মুখে রঙ লাগিয়ে, শ্যাম্পেন মদ পান করিয়ে, উত্তেজিত করে, সভা-সমিতিতে নাচাইয়া ফিরি না। আমরা ঘরের কোণে ইবাদত করি। তোমাদের ঐ বলডান্সের পোশাক দেখে লজ্জায় অধোবদন হই, নাচ দেখে চোখ বুজি। আমরা বরং বর্বর হয়ে চিরদিন মা-বোনকে ঘরের কোণে বদ্ধ করিয়া রাখিব কিন্তু তাহাঁদের মর্যাদা বাড়াইবার জন্য প্রকাশ্যে ভিড়ের মধ্যে নাচাইতে পারব না। ঐ সাহেবেরা অবশ্য – এ তিরষ্কার গ্রাহ্য করে না। যারা ইতিহাস পড়েছেন, তাঁরা জানেন নারীর মর্যাদা কী ছিল?
বিভিন্ন উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও রমণীরা চিরদিন যে নিপীড়িত হয়ে আসতেছে তা সহস্র প্রকারের উদাহরণ দিয়ে প্রকাশ করতে পারা যায়। এই জগত সংসারে মানবজাতি কোন অবস্থায় নারীর উপর প্রথম নির্যাতন শুরু করেূছিল, কে বলবে”?
তবে দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, মহামানব মোহাম্মদ (সাঃ)-ই নারীকে মর্যাদাবান করেছেন। প্রত্যেক জাতির মধ্যেই, তিনি সুসভ্য হউন আর অসভ্যই হউন, নর-নারীর সম্বন্ধটা এতই রহস্যে ডাকা যে, বাহিরের লোকেরা বাহির হইতে দেখে কিছুই বলবার জো নেই। কারণ নারী মমতাময়ী, নারী কল্যাণীয়া, নারী মাতা, বোন, স্ত্রী।
এখন দেখুন বাস্তবে আমরা কিভাবে নারীর মূল্য দিচ্ছি। নারীরা সেমিনার আয়োজন করে মর্যাদা দাবী করছে, আর কেমন মর্যাদা দাবী করে? সমান মর্যাদা দাবী করছে। আমার জ্ঞাতব্য হলো, নারীর মূল্য, নর অপেক্ষা বেশী। সমান অধিকারের দাবীদাররা কী অংক কষে দেখবেন, তাদের মর্যাদা কত বেশী? প্রকৃতপক্ষে, তারা ডিমোশান চাই। এসব বিবেচনায় আমি কী ধীরে ধীরে অভদ্র, অসভ্য ও কঠিন মনের হয়ে যাচ্ছি ? আগে মহিলাদের জন্য নিজ আসন ছেড়ে দিতাম। এটা হতো যাত্রা পথে।
এখন তাদের জন্য আসন ছেড়ে দিতে মনের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। মন বলে, দিস নে! দিস নে!।
বিশেষ করে এমনটা হচ্ছে সিএনজি চালিত গাড়িতে(গাড়িগুলো সিএনজি নামেই পরিচিত)। সিএনজি’র পিছনে তিনটে সিট এবং ড্রাইভারের পাশে দুটি (ড্রাইভারের পাশের দুটা সিটই অনুমোদনহীন)। ড্রাইভারের পাশে বসা মানে রীতিমত ঝুলে থাকা। তাই স্বাভাবিকভাবে কোনে মেয়ে বা মহিলা সামনে বসে না আর বিভিন্ন সময় পুরুষকেই বাধ্য হয়ে পেছনের সিট ছেড়ে দিয়ে ড্রাইভারের সাথে ঝুলে থাকতে হয়। এইখানে আমি কঠিন মনোভাব দেখায়। অবশ্য আসন ছেড়ে দেয় ঠিকই তবে দু-চার বাক্যে জ্বাল মিটিয়ে। আমি যুক্তি দেয় এই বলে, নারী-পুরুষ সমান অধিকার, আমি বসতে পারলে তারা পারবে না কেন? হ্যাঁ , খুব শক্ত অবস্থান নেয় আমার যুক্তিতে। তবে কোনো রুপসি রমণী দেখলে হিরূ সালমান শাহ হওয়ার চেষ্টা করি না বরং এই রূপসিদের প্রতি বাক্যগুলো হয়ে থাকে, আরো কঠিন থেকে কঠিনতর। তখন কিছু সজ্জন নারী বলে, “ভাই, সব নারী ত আর সমান না, যারা সমান অধিকারের দাবিদার, তারাই বেশী অপমানিত হয়ে থাকে”।তখন নিজকে মনে মনে বলি, আমার মা, বোনদের প্রতি আমি সদয়, পরিচিত চাচী, খালাদের প্রতি সদয়, পরিচিত নারীদের প্রতি সদয়। কখনো তাদের প্রতি সমান অধিকারের প্রশ্ন মনে আসেনি। তখন উত্তর আসে, আমার সেই আত্মীয়রাও ত কখনো সমান অধিকারের প্রসঙ্গ তুলেনি!
পরিশেষে একজন নারীর বক্তব্য উদ্বৃত্ব করে লেখার ইতি টানতে চাই –
আমি বিবি হাওয়া। আমাকে পুরুষের পাঁজর থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। আমি পুরুষের অর্ধাংশ। আল্লাহ পাক যখন আদম (আ:) কে পৃথিবীর খলিফা বানিয়ে একাকী পাঠান, তখনও আমিই ছিলাম আপনার সাথি। এরপর থেকে পৃথিবীতে আমি আপনার মা, আমি আপনার বোন, আমি আপনার কন্যা, আমি আপনার স্ত্রী। স্ত্রী হিসেবে আপনার ঘরের ব্যবস্থাপনা, আপনাকে চিন্তামুক্ত রাখা এবং আপনার শান্তি ও প্রশান্তি বিধানের সার্বিক দায়িত্ব আমি পালন করে আসছি। আমি নারী, প্রচণ্ড শক্তিশালী। আপনাকে এবং গোটা মানবজাতিকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি, দুধপান করিয়েছি, প্রতিপালন করেছি, গড়ে তুলেছি। আমি মরিয়ম, আমি খাদিজা, আমি আয়েশা, আমি ফাতেমা। আমি নবীদেরও মা, নবীদেরেও স্ত্রী এবং নবীদের কন্যা। আমি যখন আপনার মা, তখন আমার পদতলে আপনার জান্নাত।