এ কোন ব্রাহ্মণবাড়িয়া দেখছি অাজ!
:: লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে..
ক্ষমা করো শৈশব-কৈশোরের প্রিয় বন্ধু কিশু-গৌতম-উত্তম; ক্ষমা করো সুতপাদি-চন্দনদি; প্রাণতোষ মামা অার মামী; অামাদের ক্ষমা করো…
শৈশবে যখন বাড়ি যেতাম, যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে কাটাতাম কৈশোরের দূরন্ত সময়, মনে পড়ে সেই সব দিন। পাইক পাড়ায় অামরা কেউ মুসলিম, কেউ হিন্দু। অামরা সবাই মিলেই যেনো একটি বড়ো পরিবার।
খুব ভোরে সূ্র্য জাগার অাগে জেগে উঠতাম অাজানের সুমধুর সুরে। সুরের ঝর্ণাধারা বইতো সারা দিন। বইতো রাত-বিরাতেও। বদলাতো তাল-লয়; বদলাতো নিবেদনের ধরণ। শুধু বদলাতো না চারপাশ জুড়ে সুরের প্রবহমানতা।
কাছের-দূরের মসজিদ থেকে ভেসে অাসতো ভোরের অাজান। তারপর বেশ কিছুক্ষণ শুনসান নিস্তব্ধতা। তারপর.. তারপর অাশ-পাশের বাড়ি থেকে জেগে উঠতো উলুধ্বনি। কাকি-মাসি-পিসিদের অর্চনার উলুধ্বনি। অাবারও নি:সীম নিস্তব্ধতা। সেই নীরবতা কেটে যেতো রূপালীদি-ইতিদের রেয়াজের সুরে। চারপাশ থেকে ভেসে অাসা মোহাচ্ছন্নতার সুর: সা রে গা মা ..
দুপুরের পর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম, বিভিন্ন বাসা থেকে বেরিয়ে অাসতো অাপা অার দিদিরা। দল বেঁধে এগিয়ে যেতো। গন্তব্য একটাই: সুরসম্রাট ওস্তাদ অালাউদ্দীন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন। হারমোনিয়াম-তবলা-সরোদ-সেতারের সাথে শিক্ষার্থী শিল্পীদের গভীর হৃদ্যতায় বাঁধতেন ওস্তাদজী।
সন্ধ্যা নামলে সেই সুর-লহরি মিলিয়ে যেতো। একে একে ছড়িয়ে মাগরিবের অাজান। পাখিদের বাড়ি ফেরার তাড়া ছাপিয়ে বাড়িতে বাড়িতে শোনা যেতো উলুধ্বনি। সন্ধ্যামালতীর সৌরভের সাথে সাঁঝের মাঙ্গলিক পূজার নিবিড় যোগসূত্র।
অামার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানেই টাউন হল কিংবা মহিলা কলেজ মাঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা কবিতা পাঠের অাসর। সন্ধ্যাদির সুরের মাদকতা, শাহ নূর ভাইয়ের দরাজ গলায় পাগল করা মারফতি-মু্র্শিদি-লোক গান, তপন দা’র তবলার বোল, ওস্তাদ অাফজালুর রহমান চাচার সরোদের যাদু…
অামার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানেই কবি খুরশেদুল ইসলামের উদ্যোগে পরম মমতায় গড়ে ওঠা সাহিত্য একাডেমী আর কচি-কাঁচার মেলা, শিল্পকলা একাডেমি, ত্রিধারা শিল্পী গোষ্ঠী, অামরা ক’জন কিশোর বন্ধুর শিশু সংগঠন ‘ঝিঙে ফুল’…
অামার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানেই তিতাস নদী। অমাবস্যার রাতে দল বেঁধে নৌকায় তিতাস পাড়ি। নির্জন চরের বালুর মাঠে অাড্ডায় মেতে ওঠা। হাসনাতের গানের সাথে আমাদের তুমুল হৈ-হুল্লোড়। গ্যাস ফিল্ডের অগ্নিশিখা আর ওপারের শ্মশ্বান ঘাটে দাহের অাগুন; তিতাসের জলে প্রতিবিম্বিত লালিমার খেলা। বৈঠার তালে তালে এগিয়ে চলা ডিঙি নৌকায় বসে জলে জোছনার আল্পনায় মুগ্ধতা। চরের বালুরাশিতে স্বর্গীয় বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে দেয়া উদার চাঁদ, অবাক পূর্ণিমা…
অামার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানেই নদী পারের জেলে পাড়া; রাত ভর মাছ ধরার পর কাছা দেয়া লুঙ্গির ওপরে গামছা বেঁধে ঘরে ফেরা কাকাদের ব্যস্ত হাঁক-ডাক। আমার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানেই যাত্রাপালার মহড়া দেখা। সাড়া জাগানো পালা-কন্যার সংলাপে আর নাচের নিক্কনে মুগ্ধ কিশোরদল। সরাইলের দুর্ধর্ষ হাউন্ড আর মোরগ লড়াই। ভাদুঘরের বান্নি। মেলার মাঠ ভরে ওঠা হাজারো মানুষ। তিতাসে নৌকা বাইচ। বাজাইন্যা বাড়ি… শাস্ত্রীয় সংগীতের বিমোহিত সুর। ধন মিয়ার পুতুল নাচ। টিনের বিশাল ট্রাংক থেকে নামিয়ে পুতুলগুলো রোদে দেয়া …
অামার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানেই অনির্বান আর ফোর এইচ ক্লাব.. ট্যাংকের পাড় আর বোর্ডিংয়ের মাঠে দূরন্ত ফুটবল… শিশু আর সুভাষের প্রতিরোধ ভেঙ্গে আমার আর রতনের লক্ষ্যভেদী স্ট্রাইকিং জুটি… বৃষ্টি ভিজে কাঁদা-মাঠে খেলা শেষে লোকনাথ দীঘির জলে ঝাপিয়ে পড়া, সাঁতরে এপার-ওপার…
আমার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানেই তৃপ্তি, মহাদেব কিংবা ভগবতী মিস্টান্ন ভাণ্ডার। ছানামূখী, সন্দেশ, রসগোল্লা আর রসমালাই। শরিফ কিংবা কোর্ট কেন্টিনের মিস্টি সিঙ্গারা আর সমুচার সাথে এক কাপ চা
আমার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানেই আম্মার আদর, আব্বার অপার স্নেহ। ভাই-বোনের খুনসুটি। টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টি। বাড়ির পুকুর পাড়ে কলা গাছের সারি। বাড়ি জুড়ে সিঁদুরে আমের ম ম গন্ধ। কলার ভেলায় চড়ে পুকুরের জলে আনন্দ-সফর। বৃষ্টি নামলেই পানিতে ঝাঁপ, উদ্দাম সাঁতার। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জ্বরের ভয়ে আম্মার বকুনি। উঠোনে গোলাপ, গন্ধরাজ, সন্ধ্যামালতী আর রক্তজবা। ভোরে উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা শিউলি কুড়ানো।
আমার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানেই শবে বরাতের রাত। আম্মার হাতের রুটি-গোস্ত; টুপি মাথায় দল বেঁধে বেরিয়ে পড়া। বড়ো মসজিদে রাত ভর নামাজ। ঈদে, বিশেষ করে হিন্দু বন্ধুদেরকে বাসায় দাওয়াত দেয়া। সবাই মিলে কোরমা-পোলাও আর সেমাই-পায়েসে মন ভরানো।
বারো মাসে তেরো পার্বণে মেতে ওঠার কথা মনে পড়লেই স্মৃতিপটে জেগে ওঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। দল বেঁধে মহাদেবের প্রতিমা দেখতে যাওয়া। শহর জুড়ে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে আনন্দে মেতে ওঠা। ধূপের গন্ধে ছেয়ে যাওয়া কালীবাড়িতে পূজা-অর্চনা। ঢাক-ঢোলের উদ্দামতায় মন মজানো কীর্তন। হাত বাড়িয়ে চেয়ে নেয়া কলাপাতায় প্রসাদ। কখনো লক্ষী, কখনো স্বরস্বতী, কখনোবা দূ্র্গা দেবী-যে পূজা-ই হোক, মাসি-পিসি-দিদিরা আমাদের জন্য সযত্নে তুলে রাখতেন মণ্ডা-লাড্ডু-নাড়ু। সেই স্বাদ আজো জিভে জল আনে। সেই স্নেহ আজো আপ্লুত করে…
আমার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানেই অন্নদা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়। সহপাঠী বন্ধু হাবিব-রিপন-অজিতাভ-অরুণাভ…। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী কলেজ। এসএসসি পেরুতেই হাতে লাল বই। শ্রেণীহীন-বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন। হৃদয় জুড়ে দূরন্ত সাহস। কলেজের করিডোরে তেজোদ্দীপ্ত ঝাঁঝাঁলো মিছিল। মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊর্ধমূখী; খোলা গলায় দৃপ্ত স্লোগান: ‘দুনিয়ার মজদুর-এক হও লড়াই করো’, ‘রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়’…
জানি, শৈশব-কৈশোরে আর ফেরা যায় না। আর কোন দিন ফিরে আসবে না স্বপ্নময় সেই সময়। অাজ এতো বছর পর-ও আমি চাই, আগের চেয়ে আরো সুন্দর, আরো উন্নত হোক ব্রাহ্মণবাড়িয়া। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ধারণ করুক; প্রাকৃতিক সম্পদ আর ভৌগলিক অবস্থানগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য-উন্নয়নের ধারা আরো বেগবান হোক। বিরাজ করুক শান্তির সুরধারা…
ব্রাহ্মণবাড়িয়া এখন আমার কাছে আব্বা-আম্মা-বড়ো দুই ভাইয়ের কবরের পবিত্র জমিন। আমার জন্মস্থান, অনেক স্মৃতির শহর। আমি চাই, তুমি ভালো থাকো। অনেক, অনেক ভালো থাকো। তোমায় আমি খুব ভালোবাসি, প্রিয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
আজ যারা অন্যায়ের বন্যায় কলংকিত করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পবিত্র মাটি, আমি তাদের বিচার চাই। এক ব্যক্তির অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোর নামে পবিত্র এই মাটিতে মন্দিরে-মন্দিরে আর বাড়িতে-বাড়িতে হামলা করেছে যারা; প্রতিমা ভেঙ্গেছে যারা; মাসি-পিসি-দিদিদের শংকিত রেখেছে যারা; আমি তাদের কঠোর শাস্তি চাই। যে ব্যক্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে, তার দৃষ্টান্তমূলক সাজা হোক। কিন্তু এক ব্যক্তির জন্য যারা একটি সম্প্রদায়ের ওপর তাণ্ডব চালিয়েছে, সেই সন্ত্রাসীরা যেনো পার পেয়ে না যায়। যে অন্যায়ের বন্যা বইয়ে দিয়েছে ওরা, তা প্রতিকারে আইনের প্রয়োগ হোক কঠোরতম।
আমি ফিরে পেতে চাই মানবিক সম্প্রীতির সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া। হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্যের যে পবিত্র ভূমি থেকে সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ সাহেব বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন কল্যাণের সুর; সেই সুরধারায় নতুন করে সিক্ত হোক প্রাণের জনপদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।