আরেকটি অজুহাতের হরতাল
২২ অক্টোবরের মধ্যে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার না করলে ২৬ অক্টোবর হরতাল ডেকেছে সম্মিলিত ইসলামী দল। এবং ইতোমধ্যে হরতাল কার্যকরের ঘোষণাও দিয়েছে দলটি। সংবাদটি পড়ে আমি খুব অবাক হয়েছি। মহানবী, হজ্ব, তাবলিগ জামাত এবং প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয়কে আপত্তিকর মন্তব্য করায় লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রিত্ব গেছে, দলের প্রেসিডিয়াম পদ গেছে, সাধারণ সদস্যপদ যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হয়েছে, একাধিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আইন বলে দেশে ফিরলেই তিনি গ্রেফতার হবেন। তারপরও তাকে গ্রেফতারের দাবিতে হরতাল কেন? আমি বোকা বলে অবাক হয়েছি, যাদের চোখ কান খোলা, তারা একটুও অবাক হননি। হরতালের আসল কারণটা দেখি আমি ছাড়া সবাই জানে।
আগামী ২৬ অক্টোবর নাকি বেগম খালেদা জিয়ার মামলার হাজিরার তারিখ। হাজিরা এড়াতেই নাকি এ হরতাল। এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বরও একই কারণে জাতি একটি হরতাল উপহার পেয়েছিল। তখন ‘অজুহাতের হরতাল‘ শিরোনামে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে অনেক গালি খেতে হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর প্র
তিবাদে ডাকা এই হরতালটি যৌক্তিক। হতেই পারে, বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিবাদে বিএনপি একটি হরতাল ডাকতেই পারে। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের নয় মাস পর আচমকা হরতালের আসল কারণটি বলতে দেখি সবারই আপত্তি। আমি বো্কার মত আসল কারণটি বলে দিয়ে গালি খেয়েছি। আসল কারণটি যে সত্যি সত্যি খালেদা জিয়ার হাজিরা এড়ানো, তা বোঝা গেছে, কারণ হরতাল ডাকলেও বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠে ছিল না। সেই হরতাল সফল করার জন্য কোনও চেষ্টাই করেনি কেউ।
আগামী ২৬ অক্টোবর নাকি বেগম খালেদা জিয়ার মামলার হাজিরার তারিখ। হাজিরা এড়াতেই নাকি এ হরতাল। এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বরও একই কারণে জাতি একটি হরতাল উপহার পেয়েছিল।
এবার সম্ভবত বিএনপির হরতাল ডাকতে লজ্জা লেগেছে। তাই সম্মিলিত ইসলামী দলকে ভাড়া করেছে। যতই গালি দিক, বোকা আমি এই হর
তালের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেই যাবো।
বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান থেকে আলিয়া মাদ্রাসায় যেতে অনেক কষ্ট হবে, এই জন্যই হাজিরার দিনে না যাওয়ার অজুহাত সৃষ্টি করেন তিনি। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় মোট ৪১টি দিবসের মধ্যে মাত্র ৫ বার হাজির হয়েছিলেন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আগেও দেখেছি, খালেদা জিয়ার মামলার দিনেই হরতাল ডাকে বিএনপি। আর না হলে অসুস্থতা, নিরাপত্তাহীনতা– নানা অজুহাত দেখিয়ে খালেদা জিয়া বারবার আদালতকে উপেক্ষা করেছেন।
খালেদা জিয়ার অনেক বয়স হয়েছে। বারবার আদালতে হাজিরা দেয়া হয়তো তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু কয়েকদিন আগে খালেদা জিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জনসভা করে এসেছেন। আগামী ২৩ অক্টোবর যাবেন নীলফামারী, ৩০ তারিখ নাটোর, ৬ নভেম্বর কুমিল্লা এবং ১২ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ যাবেন। খালেদা জিয়ার এই ব্যস্ততা দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। যাক, দেরিতে হলেও বিএনপি বুঝতে পেরেছে, বিদেশী কূটনীতিকরা নয়, সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। তাই বিএনপি চেয়ারপারসন জনগণের কাছে যাচ্ছেন। কিন্তু সব জায়গায়
যেতে পারবেন, খালি আদালতে যেতে পারবেন না, এটা ঠিক নয়। আমি নিশ্চিত, ২৬ অক্টোবরের পরে মামলার যে তারিখ পরবে সেদিনও কোনো না কোনো অজুহাতে আরেকটি হরতাল আসবে। হরতালের তারিখ আসলে বিএনপি নয়, ঘোষণা করেন আদালত।
বর্তমান সরকার খুব সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। কারণ মামলাগুলো তাদের আমলে করা নয়। ওয়ান–ইলাভেনের সময় রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে করা ঢালাও মামলায় শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা হয়েছিল। এই মামলা দুটিও তখন করা। সরকার এখন বলছে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হলেও বেগম জিয়ারগুলো করা হয়নি। হওয়া উচিত ছিল, হলে ভালো হতো, আমাকে আজকের এই লেখা লিখতে হতো না।
শুধু শেখ হাসিনার মামলা নয়, বর্তমান সর
কার ক্ষমতায় আসার পর রীতিমত কমিটি করে ‘রাজনৈতিক’ বিবেচনায় দায়ের করা হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু মামলাগুলো সত্যি সত্যি রাজনৈতিক বিবেচনায় দায়ের করা হয়েছিল কিনা তাও নির্ধারণ করা হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। কারণ বর্তমান সরকার শুধু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু ওয়ান–ইলাভেনের সরকার শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের রাজনৈতিক মামলা করেছে, আর বিএনপির নেতাকর্মীরা সব দাগী আসামী, তাদের মামলা প্রত্যাহার করা যাবে না– এটা কোনও আইনের শাসনের দেশে হওয়া উচিত না। আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছে, তার মানে এটা শুধু আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সরকার নয়। সরকার দেশের প্রতিটি মানুষের। যতই সমালোচনা করি, আমাকে সরকারকে মেনে নিতে হয়। তাই সরকারের কাছ থেকে সব ক্ষেত্রেই সমতা কাম্য।
বর্তমান সরকার খুব সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। কারণ মামলাগুলো তাদের আমলে করা নয়। ওয়ান–ইলাভেনের সময় রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে করা ঢালাও মামলায় শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা হয়েছিল। এই মামলা দুটিও তখন করা। সরকার এখন বলছে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হলেও বেগম জিয়ারগুলো করা হয়নি।
কিন্তু মামলা যেহেতু বিচারাধীন, তাই আশা করবো, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রচলিত আইন মেনে চলবেন। বেগম খালেদা জিয়া আসলে দুর্নীতি করেছেন কিনা, সেটা আদালতের বিচার্য। খালেদা জিয়া বলতে পারতেন, এই সরকার অবৈধ, এই সরকারের অধীনে বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়। তাই এই আদালতে আমি যাবো না। কিন্তু তেমন স্পষ্ট অবস্থান নেয়ার মত সৎ সাহস দেখাতে পারেননি তিনি। কিন্তু তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আদালতের সাথে যে ইদুর–বিড়াল খেলছেন তা খুবই দৃষ্টিকটু।
সবসময় বলা হয়, আইন তার নিজের গতিতে চলবে। এরচেয়ে হাস্যকর কথা আমি কখনও শুনিনি। আসলে আইনের কোনও নিজস্ব গতি নেই। সরকার যেমন চায়, আইনের গতি তেমনই হয়। আইনের গতি নিজস্ব হলে শেখ হাসিনার পাশাপাশি বেগম জিয়ার মামলাও প্রত্যাহার হয়ে যেতো। আবার এটাও ঠিক, বেগম জিয়া বারবার যে কৌশল করছেন, অন্য কেউ হলে এতদিন গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়ে যেতো। এখানেও আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে না। আমার ধারণা খালেদা জিয়ার কৌশল নিয়ে বিপাকে পড়েছে আদালতও।
প্রত্যেকবারই খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি নিয়ে আদালত কড়া ভাষায় কথা বলেন এবং পরবর্তী তারিখে বেগম জিয়ার উপস্থিতি নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। আইনজীবীরা বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রাখতে পারেন না। হঠাৎ করে হরতাল এসে তাদের পথরোধ করে দাঁড়ায়।
লেখক: সাংবাদিক ও অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।
ইমেইল: probhash2000@gmail.com
সূত্র : বাংলাট্রিবিউন