সমাজহিতৈষী ও দক্ষ প্রশাসক কাজী আবদুল বায়েস -মোঃ তারিকুল ইসলাম সেলিম
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব (অবঃ) কাজী আবদুল বায়েস ছিলেন ইপিসিএস অফিসার ও সরকারের উচ্চুপদস্থ একজন কর্মকর্তা । তিনি অর্ত্যান্ত সৎ, পরিচ্ছন্ন সদালাপী হাস্যউজ্জ্বল একজন উদার মনের মানুষ ছিলেন । সমাজহিতৈষী ব্যক্তিত্বেও তিনি অসাধারন । কাজী আব্দুর বায়েছ অত্যন্ত দূরদর্শী সম্পূণ ছিলেন । নিঃস্বার্থ নিবেদিত প্রাণ মহৎ মানুষটি সব সময় মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন । সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর বহু অবদান আছে, যা আমাদের শুধু তাঁর স্মৃতিকে স্মরণ করিয়েই দেয় না, তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার জন্ম দেয় । সরকারের উচ্চুপদস্থ একজন কর্মকর্তা হওয়ার সত্ত্বেও তিনি খুবই সাদামাটা জীবন করতেন । ইসলামিক চিন্তা -ভাবনা ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন । ইসলাম ধর্ম, ইসলামী জ্ঞান ও দর্শনের প্রতি ছিলেন প্রবলভাবে অনুরক্ত । মাসিক “অগ্রপথিক” সহ বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত তাঁর লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধের মাঝে সমাজ, ইসলাম, দর্শন, বিজ্ঞান, ও সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর গভীর চিন্তা ও অনুশীলনের ছাপ পাওয়া যায় । বিশেষ করে তিনি ‘অগ্রপথিক’ ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর সৃজনশীল মাসিক মুখ্যপাত্রে নিয়মিত লিখতেন ।
ইসলামী চিন্তা-ভাবনা, ধমীয় অনুশাসন ও ইসলামী জ্ঞানের প্রতি প্রবলভাবে অনুরক্ত এই কৃতিপুরুষ ১৯৪১ সালে ১লা মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার ইতিহাসখ্যাত নাওঘাট গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । বাবা কাজী রুমিজউদ্দিন ছিলেন ব্রিটিশ আমলে একজন খ্যাতিমান স্কুল শিক্ষক । ছোটবেলা কাজী আব্দুল বায়েছ লেখাপড়ায় অত্যার্ন্ত মেধাবী ছিলেন । ১৯৫৪ সালে স্থানীয় বিখ্যাত তালশহর এ এ আই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করেন । ১৯৫৬ ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন । ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং ১৯৬২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কৃৃৃৃতিত্বের সাথে এম.এ পাস করেন। তিনি পড়ালেখা শেষ করে কর্মজীবনের শুরুতে নাজিরহাট ডিগ্রী কলেজে অধ্যাপনা করেন । ১৯৬৬ সালে তিনি তৎকালীন প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন । ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কালেক্টর ও মুহকুমা প্রশাসক হিসেবে চুয়াডাঙ্গা, মৌলভী বাজার, বরিশাল, পিরোজপুর, মঠবাড়িয়া, ঝালকাঠি, ভোলা ও হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালন করেন ।
১৯৮১ সালে তিনি সিনিয়র সার্ভিস পুলে অন্তভুক্ত হয়ে উপ-সচিব হিসেবে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন এবং সংস্থাপন মন্ত্রনালয়, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রনালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রনালয়, তথ্য মন্ত্রনালয়, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়, প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, এফডিসি-র এমডি পদে কর্মরত ছিলেন । তিনি এক সময় বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন এবং বাংলাদেশ দূতাবাস লিবিয়ায় কাউন্সিলর (শ্রম) হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। চাকুরিকালে তিনি বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, সেমিনার-ওয়ার্কশপ ও কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ব্রিটেন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা ও নিউজিল্যান্ড সফর করেন । সমাজহিতৈষী ও দক্ষ প্রশাসক জনবান্ধব একজন কর্মকর্তা হিসেবে সব ক্ষেত্রেই তিনি বিশাল জনপ্রিয় ছিলেন । দীর্ঘ ৩৬ বছরের চাকুরিকালে তিনি সততা, দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রচুর সুনাম অর্জন করেন । এজন্য সহকর্মী বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়- স্বজনসহ সমাজে সবার কাছেই শ্রদ্ধা সম্মান ও ভালবাসার পাত্র ছিলেন । এলাকার যোগাযোগ ও শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা বিরাট । তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বহুুুমূখী উন্নয়ন । ১৯৯৬ সালে তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ে থাকাকালে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয় । তখন স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী ছিলেন প্রায়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ।
এই মহান সৃষ্টিশীল মানুষটি স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মান ও অবকাঠামো উন্নয়ন-সহ বহু রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভাট নির্মাণ করেছেন । তিনি তালশহর এ. এ. আই উচ্চ বিদ্যালয়, তালশহর করিমিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, সোহাগপুর আছিয়া সাফিউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রসংশনীয় অবদান রাখেন । তিনি বড়হরণ থেকে নাওঘাট গ্যাং কোয়াটার পর্যন্ত রেল লাইন পাশ দিয়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মান করেন (উল্লেখ যে রাস্তাটি বর্তমানে কোন কোন স্থানে সংস্কার না হওয়ার কারণে প্রায়ই বিলীন হয়ে যাচ্ছে) । এছাড়া নাওঘাট – বড় হরণ সড়ক থেকে রেল লাইনের উত্তর পাশে ব্রিজ দিয়ে ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া গ্রামে ভিতর ২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মান করেন । কাজী বাড়ি মসজিদ নির্মানের জন্য জমি দান করেন । এছাড়া তিনি আশুগঞ্জ বন্দর শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আশুগঞ্জ উপজেলার কৃতি-সন্তান নির্ধারণী ও সম্মাননা প্রদান কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। নাওঘাট কল্যাণ সমিতির সম্মানিতপদেষ্টাও ছিলেন । শিক্ষাবান্ধব অকৃত্রিম বন্ধুর জনহিতিকর কাজের জন্য তাঁর ভূমিকা অতুলনীয় । তালশহর এ. এ. আই উচ্চ বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ‘তাঁর সম্মান ও স্মৃতিরক্ষার্থে ‘কাজী আব্দুল বায়েস’ এর নামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠিতা করেন ।
কাজী আব্দুল বায়েছ ব্যক্তিগত জীবনে জাহানারা বায়েছ-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করেন । তিনি দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। বড় ছেলে কাজী আনোয়ারুল আদিম (বাপ্পী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ. এমবিএ করেন। বর্তমানে তিনি আমেরিকায় কর্মরত আছেন । ছোট ছেলে কাজী আনোয়ারুল আজিম (রিপন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ. এমবিএ করেন। তিনি বর্তমানে ডার্চ বাংলা ব্যাংকের এসেস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছেন । মেয়ে হূমায়রা জাহান জলসা ইডেন মহিলা কলেজ থেকে মাস্টাস পাস করে । তার স্বামী সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া ডিপুটি সেক্রেটারি । তাদেরও সুখের সংসার । কাজী আব্দুল বায়েছ উত্তরা ৭ নাম্বার সেক্টর ১৫ নাম্বার রোডে ৬ নাম্বার বাড়ি স্বপরিবার নিয়ে বসবাস করতেন । ১৭ই ডিসেম্বর ২০০৪ সালে এই রোদ্র-ছায়াময়, সুখ-দুঃখ ঘেরা পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন । অনেকটা অকালেই শদ্ধীয় কাজী আব্দুল বায়েছ লোকান্তরিত হয়েছেন। তাঁর অন্তর্ধানে আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বহুমূখী উন্নয়নে অপূরনীয় যে ক্ষতি হলো তা সহজে পূরণ হবার নয় । গুণী এই মানুষটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান তাকে স্মরণী করে রাখবে । আমি তাঁর বিদেহী আত্মার চির শান্তি কামনা করি।
লেখক: লোক-সাহিত্যনুরাগী, রাজনীতিক কর্মী ও সংগঠক।
« আশুগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের লক্ষে সেমিনার অনুষ্ঠিত॥ (পূর্বের সংবাদ)