শিক্ষা নাগরিকের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার, সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করনই টেকসই সমাধান
শিক্ষা’ শব্দের তাৎপর্য যার কাছে যেমন, তার উপরেই নির্ভর করে শিক্ষা ও শিক্ষকদের মূল্যায়নটাও। সমগ্র জীবনটাই আসলে শিক্ষা। শেখার সুযোগ আজীবন, আর জীবনের প্রতিটি পর্বই শিক্ষণীয়। মহান স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলে ও দেশের নাগরিকের শিক্ষার অধিকার বা শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক অধিকারের বিষয়ে মূল্যায়নের এই বৃহত্তর উপলব্ধি এখনো জাগ্রত হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশ আর কত পথ পাড়ি দিলে নাগরিকদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার শিক্ষা ও শিক্ষকদের মূল্যায়নের তাৎপর্য উপলব্ধি করবে? কিন্তু শিক্ষার একেবারে গোড়ার দিকটার পর্বটা শুরু হয়েছিল যে ক্লাসরুম থেকে, সেই ক্লাসরুমের নির্মল পরিবেশে শিক্ষকরা এই দীক্ষাই দিয়েছিলেন, আকাশের কাছ থেকে উদারতার শিক্ষা নিতে, পাহাড়ের কাছ থেকে মহান অথচ মৌন হওয়ার শিক্ষা নিতে, মাটির কাছ থেকে সহিষ্ণুতা শিখতে, পাষাণের কাছ থেকে কাঠিন্য আর চাঁদের থেকে মাধুর্য শিখে নিতে বলেছিল। মৌলিক উপলব্ধিটা সেই অপার আনন্দেই নিহিত। এই উপলব্ধি শুধু একটা কবিতার সারকথা কিন্তু নয়, এটা আসলে জীবনেরই সারকথা। এই উপলব্ধি যাঁর রয়েছে, শিক্ষা এবং শিক্ষকের গুরুত্ব তথা তাৎপর্য তাঁর কাছে নিঃসন্দেহে মহত্তর। সেই ক্লাসরুমের নির্মল পরিবেশে শিক্ষকরাই যাদেরকে আকাশের কাছ থেকে উদারতার শিক্ষা নিতে দীক্ষা দিয়েছিলেন তারাইতো আজ শিক্ষকদের তথাকথিত ভাগ্য গড়ার কারিগর ও সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নকারী। তবে কেন আজো সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করন করে প্রান্তিক জনগোষ্টীর শিক্ষার সুযোগ অবারিত করা হলো না ? কেন মানুষ গড়ার কারিগর বেসরকারী শিক্ষক সমাজকে সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হলো?
নানাবিধ বঞ্চনার শিকার দেশের ছয় লক্ষাধিক বেসরকারী শিক্ষক , মহান স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলে ও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো সরকারী, বেসরকারি, মাদ্রাসা ,কারিগরি সহ বহুধা বিভক্ত। সারা দেশের এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে ২% সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বল্প ব্যয়ে পড়াশুনা করছে দেশের পুজিপতি ধনিক শ্রেণীর সন্তানেরা, বাকী ৯৮% বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছে সুবিধা বঞ্চিত ,নিন্মবিত্ত , নিন্ম মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্টীর সন্তানেরা যাদের সামর্থ সীমিত অথচ শিক্ষা খাতে ব্যয় অনেক বেশী । এই সব প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছে চার কোটির বেশী শিক্ষার্থী। শিক্ষা ব্যবস্থার দুই ধারা সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে এমপিওভুক্ত,নন এমপিওভুক্ত,খন্ডকালীন,প্যারা শিক্ষক সহ বহুধারায় বিভাজিত সমযোগ্যতার শিক্ষক রয়েছে, তাদের বেতন ভাতায় ও ব্যাপক বৈষম্য বিরাজমান। দিন দিন এ বৈষম্য বেড়েই চলেছে। প্রাথমিক,মাধ্যমিক ও উচ মাধ্যমিক পর্যায়ে এই বৈষম্য খুবই তীব্র। দেশের এমপিওভুক্ত সাড়ে ৫ লক্ষ, এমপিও বিহীন এক লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারীরা তাঁদের ন্যায্য পাওনা সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক সুযোগ সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে বারবার আবেদন-নিবেদন করার পর ও স্বাভাবিক ভাবে বেচে থাকার নিশ্চয়তা না পেয়ে রাজপথে নেমে মানববন্ধন সহ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেছে ।
সর্বশেষ ২০১৫ সালে ঘোষিত জাতীয় বেতন কাঠামোতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতন স্কেলের সাথে ৫% বার্ষিক প্রবৃদ্ধি সহ সুযোগ-সুবিধার আশ্বাসে টাইমস্কেল বন্ধ করে দেয়া হয়। জাতীয় বেতন কাঠামো কার্যকর হওয়ার দুই বছর অতিক্রম করলেও এখনো বেসরকারী শিক্ষকদের ৫% বার্ষিক প্রবৃদ্ধি কার্যকর হয়নি। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সমগ্র চাকুরী জীবনে একটি মাত্র টাইমস্কেল পেতেন,অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্বারক নং ৩৭.০০.০০০০.০৭৪.০২৯.০০৫.২০১৫.৩৭০ তারিখ: ০৭/০৮/২০১৬ খ্রিঃ বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ এর অনুচ্ছেদ ৪ ও ৬ অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখের পরবর্তী সময়ে টাইমস্কেল,সিলেকশন গ্রেড ও উচ্চতর স্কেল বিলুপ্ত হওয়ায় তা প্রদানের সুযোগ নেই মর্মে পরিপত্র জারি করে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের আট বছর চাকুরীর মেয়াদপূর্তিতে প্রদত্ত টাইমস্কেল বন্ধ করে দিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে নতুন করে আরেকটি বৈষম্য সৃষ্টি করল শিক্ষা মন্ত্রণালয় । ২০১৫ সালে ঘোষিত জাতীয় বেতন কাঠামোতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের গ্রেড অনুযায়ী মূল বেতন , বাড়ি ভাড়া ভাতা ১,০০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, উৎসব ভাতা মূল বেতনের চারভাগের একভাগ। বৈশাখীভাতা স্বয়ংক্রিয় ভাবে পাওয়ার কথা থাকলেও বেসরকারী শিক্ষকরা এবছর ও বৈশাখীভাতা পায়নি ফলশ্রুতিতে শিক্ষকরা রাস্তায় নেমে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। এতেও কোন সুফল আসেনি , উল্টো গত ১৫ ও ২০ জুন ২০১৭ পৃথক দুইটি গেজেটের মাধ্যমে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের বিদ্যমান চাঁদার হার ৬% এর পরিবর্তে মূল বেতনের ১০% উন্নীত করেন, চাঁদার হার বাড়ালেও শিক্ষকদের অবসর সুবিধা থাকবে আগের মতোই। এরপর থেকেই অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে সাড়ে ৫ লক্ষ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যার প্রতিফলন ঘটে দেশের শীর্ষ স্থানীয় দৈনিক সংবাদ পত্র সমূহে । অবশেষে গত ২০/০৭/২০১৭ ইং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় এক বিবৃতির মাধ্যমে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টে অতিরিক্ত কর্তনের গেজেট অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেও গেজেট বাতিল ,জাতীয় বেতন কাঠামো অনুযায়ী ৫% বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ,সরকারী অনুরুপ বাড়ী ভাড়া সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে কোন ঘোষনা না থাকায় আবারো অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে সাড়ে ৫ লক্ষ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে । এবং জাতীয়করনের একদফা দাবীতে সংগঠিত হতে থাকে সারা দেশের বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীরা।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা ৫% বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, মূল বেতনের ৪৫% বাড়ি ভাতা, ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, ১০০% উৎসব ভাতা, ২০% বৈশাখী ভাতা ,যাতায়াত ভাতা শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, ভ্রমন ভাতা, স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ ,আবাসন সুবিধা,পেনশন সহ সরকারের দেয়া সকল সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, এ ছাড়াও কোন সরকারী কর্মকতা/ কর্মচারীর অকাল মৃত্যু হলে আট লক্ষ টাকা এককালীন অনুদান সহ অবসরকালীন প্রাপ্য অন্যান্য যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা যথারীতি পাবেন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত শ্রীলংকা সহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মানী প্রদান করা হয়। শিক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব রাষ্ট্রের যেখানে সরকারী বেসরকারি বিভাজন থাকতে নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ শুধুমাত্র মূল বেতন ও নামমাত্র সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন।
২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদানের অঙ্গীকার রয়েছে,পর্যায়ক্রমে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করনের সুপারিশ রয়েছে। যা আজও আলোর মুখ দেখেনি। অথচ সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই সিলেবাস ও একই যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষকরা শিক্ষা দিয়ে থাকেন। সঙ্গত কারণে কেন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা আজো এই বৈষম্যের শিকার? কেন শিক্ষকগণ তাঁদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হবেন? মূল বেতন স্কেল প্রদান করা স্বত্ত্বেও কেন তাঁরা আনুসাঙ্গিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত? কেন বেসরকারি শিক্ষকরা বৈশাখীভাতা, পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাতা, পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাভাতা, পূর্ণাঙ্গ উৎসবভাতা ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট থেকে বঞ্চিত? কেন সকল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহকে একযোগে জাতীয়করণ করা হচ্ছে না? কেন আংশিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হচ্ছে? কেন বেসরকারি শিক্ষকদের অবহেলায় চোখে দেখা হচ্ছে? দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈশাখী ভাতা, ইনক্রিমেন্ট এবং পূর্ণাঙ্গ উৎসব বোনাস, বাড়ি ভাড়া ভাতা ও চিকিৎসা ভাতাসহ বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ জাতীয়করণের দাবিতে মানববন্ধন, মিছিল, সভা-সমাবেশ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্ঠি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট এমপিওভুক্ত-ননএমপিও শিক্ষকদের ন্যায্য দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পারলে তিনি নিশ্চয়ই বেসরকারি শিক্ষকদের চাকুরী জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়ে সরকারী বেসরকারি বৈষম্য দূরীকরণে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহন করবেন ।
যেমনি ভাবে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যুদ্ধ বিধ্বস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব নিয়েই বঙ্গবন্ধু উপলব্দি করেছিলেন প্রাথমিক পর্যায়ে যতদিন শিক্ষার ভিত্তি মজবুত হবে না ,ততদিন এদেশের বিপুল জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করা সম্ভব নয় এবং তিনি এটাও উপলব্দি করেছিলেন প্রাথমিক পর্যায় থেকেই মানসম্মত শিক্ষার কাজ শুরু করতে হবে। তাই তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে কয়েকটি মৌলিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যার অন্যতম ছিল প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ। ১৯৭৩ সালে একটি ঘোষণায় দেশের ৩৬,১৬৫ (ছত্রিশ হাজার একশত পয়ষট্টি) টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করন করে শিক্ষকদের বেতন ভাতার ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ধনী , দরিদ্র ,শহর গ্রামের শিশুদের একই শিক্ষা কাঠামোর অর্ন্তভুক্ত করে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে বৈষম্যহীন, সকলের জন্য শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং বাঙ্গালী জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করে নবদিগন্তের সূচনা করেছিলেন। জাতির পিতার আদর্শের ধারাবাহিকতায় তাঁরই সুযোগ্য কন্যা একবিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালী জাতির আইকন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারী ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষাকে পূর্ণতা দান করেছিলেন । সেই দিন আর বেশীদুরে নয়, যেদিন বঙ্গবন্ধু কন্যা সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করন করে এদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নত দেশগুলোর কাতারে পৌছেঁ দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রনী ভুমিকা পালন করবেন ।
তাই এদেশের সাড়ে পাঁচ লক্ষ এমপিওভুক্ত, এক লক্ষ এমপিও বিহীন বেসরকারি শিক্ষকদের বিশ্বাস, তিনি অচিরেই বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসা সমুহকে জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সাবেক শিক্ষা সচিব মো. নজরুল ইসলাম খান বিগত ৩০ নভেম্বর ২০১৫ ইং সোমবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে গেলে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা জাতীয়করণে সরকারের ব্যয়ের হিসাব জানতে চেয়েছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারি সুযোগ-সুবিধার বাইরে মোট কতটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা জাতীয়করণে সরকারের অতিরিক্ত কত খরচ হতে পারে তাও জানতে চেয়েছিলেন । প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে সাবেক শিক্ষা সচিব মো. নজরুল ইসলাম খান জানিয়েছিলেন, সারাদেশে প্রায় ৩০ হাজারের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের বাইরে রয়েছে। এগুলো জাতীয়করণ করতে সরকারের প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। সাবেক শিক্ষা সচিব মো. নজরুল ইসলাম খান কর্তৃক প্রদত্ত জাতীয়করণে সরকারের আর্থিক সংশ্লেষের হিসাব শুনে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেছিলেন, ঠিক আছে, জাতীয়করণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার মানোন্নয়নে কষ্ট করে হলেও এ টাকা খরচ করতে হবে।
পরিশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকারী সকল সুযোগ সুবিধার অর্ন্তভুক্ত পক্ষান্তরে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত, এমপিওবিহীন,খন্ডকালীন,প্যারা শিক্ষক সহ বহুধারায় বিভাজিত। সমযোগ্যতার শিক্ষকদের বেতন ভাতায় ব্যাপক বৈষম্য বিরাজমান যা কোন ভাবেই কাম্য নয়। দিন দিন এ বৈষম্য বেড়েই চলেছে। প্রাথমিক,মাধ্যমিক ও উচ মাধ্যমিক পর্যায়ে এই বৈষম্য খুবই তীব্র । এদেশের সাড়ে পাঁচ লক্ষ এমপিওভুক্ত ,এক লক্ষাধিক এমপিওবিহীন বেসরকারি শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি নিবেদন সরকারী বেসরকারি বিভাজন আর নয়,এখনই সময় বৈষম্য দূর করে শিক্ষা ব্যবস্থায় সমতা ফিরিয়ে এনে সুবিধা বঞ্চিত ,নিন্মবিত্ত , নিন্ম মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্টীর সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ অবারিত করা। অব্যাহতভাবে এ কাজ চালিয়ে যেতে পারলে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ শুধু একটি মধ্যম আয়ের দেশ হবে না, শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ একটি মধ্যম মানের উন্নত শিক্ষিত দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করবে।বাংলাদেশের মতো একটি দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে শিক্ষা খাতে যথাযথ বিনিয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে আমাদের গতিশীল পদচারণা স্তিমিত হয়ে আসবে এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমাদের সাফল্যের সক্ষমতা সংকুচিত হয়ে পড়বে। শিক্ষাকে প্রতিটি মানুষের অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের বিকাশ ত্বরান্বিত হবে।তাইতো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা পূর্ব সত্তরের নির্বাচনী ভাষণে বলেছিলেন সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর হতে পারে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের পনেরো এবং সতেরো নম্বর অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে বাংলাদেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শহর-গ্রাম,সরকারী-বেসরকারী এমপিওভুক্ত, এমপিওবিহীন খন্ডকালীন,প্যারা শিক্ষক সহ সকল ধরনের বৈষম্য দূর করে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করনের মাধ্যমেই শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান অসমতা নিরসন করা সম্ভব। এখনই সময় সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করন করে দেশের সকল নাগরিকের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির জনকের স্বপ্নের বৈষম্যহীন ক্ষুধা দারিদ্রমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ বিনির্মান করা ।
শাহাব উদ্দিন মাহমুদ
মাষ্টার ট্রেইনার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, সেইভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ।
কো-অর্ডিনেটর ও শিক্ষক প্রতিনিধি
আগ্রাবাদ সরকারী কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়,চট্টগ্রাম।
*** মতামত বিভাগের লেখা লেখকের একান্তই নিজস্ব। ব্রাহ্মণবাড়িয়া২৪ডটকম -এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া২৪ডটকম কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।