পথের মাঝে রক্তাক্ত সাংবাদিক ॥ আবারো শহরে ছুরিকাঘাতের ভয় -আল আমীন শাহীন
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। রাতের ট্রেনে ফিরেছি প্রিয় শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। রিক্সা নিয়ে বাড়ি দিকে,হঠাৎ করে বাম হাতে চিমটি কাটার মতো অনুভব করলাম, পাশে দেখি সাদা চকচকে ছুরি।“দে মোবাইল দে” বলে আবারো আঘাতে উদ্যত দুজন। ব্যাপার কি বুঝে উঠার আগেই, আবারো আঘাত, হাত দিয়ে ফেরানোর চেষ্টা করতেই ছুরি বিঁধেছে হাতে। রিক্সা থেকে লাফিয়ে পড়লাম পথে। সঙ্গে ছিল অপর সাংবাদিক তিনি দেখি মাটিতে শুয়ে আছেন। পাঁচ জনের আক্রমণ। একের পর এক আঘাত ,ছুরির ধাড়ালো ডগা এবার আঘাত করলো আমার ঠিক কপালে, হামলাকারীরা বলছে, দে যা আছে দিয়ে দে। নতুন কেনা ডিজির্ট্যাল ক্যামেরা আর ব্যাগ ছিল হাতে,তা দিয়ে আঘাত ঠেকিয়ে দৌড় দিলাম, পেছনে ছিল কাপড়ের ব্যাগ, এর উপর পড়ছে একের পর এক ছুরির আঘাত। বেশী দূর যেতে পারিনি পড়ে গেলাম পথে, মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফোন দিলাম সদর থানায়, তাৎক্ষণিক ফোন ধরলেন ওসি সাহেব। বল্লেন ,পুলিশ আসছে, ভাগ্য ভাল কিছুক্ষণের মধ্যেই আসলো পুলিশ, পুলিশ ভ্যান দেখে পালিয়ে গেল হামলাকারী ছিনতাইকারীরা। প্রাণে রক্ষা পেলাম, সাথে থাকা সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার সাথের ব্যাগটি নেই, ল্যাপটপ ছিল তা নিয়ে গেছে, হাতের রগ কাটা। পুলিশ আমাদের উঠিয়ে নিল তাদের গাড়ীতে, সাদা গাড়িটি রক্তে লাল, জ্ঞান হারালাম তা দেখে, হাসপাতালের জরুরী বিভাগে এসে জ্ঞান ফিরলো, দেখি আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন, তৎকালীন পুলিশ সুপার মোঃ মনিরুজ্জামান পিপিএম বার। খবর পেয়ে বিশিষ্ট চিকিৎসক আমার ভাই ডাঃ মোঃ আবু সাঈদ নিয়ে গেলেন উনার মধ্যপাড়ার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে, সেখানেই বাকী চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি। এরপর ছিনতাই কথাটি শুনলেই সেই বিভীষিকাময় ভয়াবহ দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে। আমার শরীরে ছুরি চাকুর প্রায় ১৫ টি আঘাতের চিহ্ন, আয়নার সামনে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে।
অনেকদিন পর আবারো এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি। রাতে কাজ করে বাড়ি ফেরা প্রতিদিনের অভ্যেস, বাড়ি ফিরে সেহেরী খেতে বসেছি, এমনি দেখি সাংবাদিক এইচ এম সিরাজের ফোন, “ শাহীন ভাই আমি শেষ, ছুরি মেরেছে আমাকে, শেরপুরে পথে পড়ে আছি, খবরটা পেয়ে খাবার রেখেই মোটর সাইকেল নিয়ে বের হলাম। ঘটনাস্থল শেরপুর, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে, বাইপাস সড়কে উঠতেই, পৈরতলা রাস্তার মোড়ে পাহাড়াদার ডাক “ মামা এতো রাতে, একা কই যান” ? শেরপুরের দিকে তাকিয়ে দেখি অন্ধকার , দাঁড়ালাম, বল্লাম তোমার হাতে যা আছে তা নিয়ে উঠ আমার সাথে, তিনি উঠলেন,কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে দেখি অন্ধকারে রক্তাক্ত শরীরে পথে পড়ে আছে সাংবাদিক সিরাজ, পড়নের পাঞ্জাবীটা লাল,ছিন্ন বিছিন্ন। ভয়ার্ত কম্পিত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে সে বল্ল“ ভাই আমি শেষ,” দ্রুত তাকে মোটর সাইকেলে উঠিয়ে নিলাম। পুলিশের একটি দলও এসেছে এই সময়ে, তাদের বল্লাম , হাসপাতালে যেতে সহযোগিতা করুন।
সিরাজের অবস্থা দেখে আমার পূর্বের দৃশ্য ভেসে উঠলো, হাসপাতালে বেডে শুয়াতেই উন্মুক্ত হলো সিরাজের শরীরের আঘাত গুলো। জরুরী বিভাগের ডাক্তার বসার রুমটি অন্ধকার, ভেতরের রুমেও দরজা বন্ধ। দরজায় কড়া নেড়ে ঘুম থেকে জাগালাম হাসপাতালের জরুরী কর্মীদের। কর্মীরা রোগী দেখে বল্ল, কিভাবে সেলাই করবো, সরকারী না বেসরকারী? এই প্রশ্নে বুঝলাম সরকারী চিকিৎসার প্রয়েজনীয় উপকরণ নেই, বল্লাম সরকারী বেসরকারীই যাই হোক, যা খরচ লাগে দেব, আগে চিকিৎসা করান, এরি মাঝে সাংবাদিকদের কয়েকজনকে ফোন দিলাম, তাৎক্ষণিক ছুটে আসলেন সাংবাদিক মফিজুর রহমান লিমন, জরুরী কর্মীরা বারবারই টিকেটের টাকা চাইছে,চিকিৎসার উপকরণ বাইরে থেকে আনতে হবে, রোগীকে জরুরী বেডে শুইয়ে ছুটে গেলাম বারান্দায় হাসপাতালের সামনের সবকটি দোকানই বন্ধ, ফিরে এসে বল্লাম,এখন কি করবো? রোগীর পরিচয় এবং আমাদের পরিচয় দিলাম, এবার জরুরী কর্মীরা নড়ে চড়ে উঠলো। জরুরী বিভাগ থেকে দূরে একটি রুম থেকে ঘুম জড়ানো আবহে এলেন, জরুরী ডাক্তার সাহেব। দূর থেকে দাঁড়িয়ে বল্লেন , কি হয়েছে, রোগীর কাছে আসলেন না , ক্ষতও দেখলেন না , দূর থেকেই বল্লেন , কই টিকেট কই, বলে চলে গেলেন।
জরুরী বিভাগের ডাক্তার রুমে না বসে তিনি গেলেন পূর্বের সেই বিশ্রাম রুমে। ডাক্তারের আচরণ সন্তোষজনক না হওয়ায় সহকর্মী লিমনকে বল্লাম, তুমিই যাও, লিমন কিছুটা রেগে গিয়েছিল, তাকে বল্লাম, রাগ নয় রোগীর চিকিৎসা করতে হবে। সে ঠান্ডা হলো। কাঁটা ছেঁড়া দেখতে যে মনোবল দরকার , তা না থাকলেও সহকর্মীর মাথায় হাত বুলিয়ে ক্ষত বিক্ষত অংশ জোড়া দিতে দেখছি, নানা কথায় তাকে সামলানোর চেষ্টা করছি, মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ হলেই চোখের সামনে সেই পূর্বের আমার রক্তমাখা শরীর আর সিরাজের দৃশ্য। সিরাজের শরীরের অংশে সেলাই হচ্ছে, লিমন দেখি চোখ মুখ খিছাচ্ছে,বিভৎস রক্তমাখা দৃশ্য দেখে। ডাক্তার ফিরে এলেন না, লিমন রেগে আছে, বল্লাম, হাসপাতালের পাশেই প্রেস ক্লাব, আমরা প্রতিবেশী আর বর্তমানে যিনি তত্বাবধায়ক তিনিও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান আমাদের কাছের মানুষ, এখন রাগ করে লাভ নেই অনিয়মের অভিযোগটা উনাকেই জানাব, আমাদের সাথে সদর থানার একটি পুলিশ দলও ছিল, লিমন বারবারই বলছিল, আমাদের চিকিৎসা পেতে যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ মানুষের কি অবস্থা হবে। যা হোক সিরাজের শরীরের একাধিক আঘাতে ১৫/১৬ টি সেলাই , ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা হয়েছে। তার পাঞ্জাবীটি ছিন্ন বিছিন্ন , প্যান্ট কেটে আঘাতের স্থান উন্নুক্ত করা হয়েছে, ব্যথায় সে বিধ্বস্ত। বৃষ্টি পড়ছে তখনো , বৃষ্টি ভিজে সিরাজকে তার বাসায় পৌছে দিয়ে বাড়ি ফিরছি। চোখে আমার সেই বিভৎস দৃশ্য। ভোর হয়ে গেছে,রাস্তা জনশূন্য, পুলিশও নেই , একা ফিরছি , মনে তখন শুধু ভয়, যদি পথে কিছু হয়।
ভয়টা ছিল না গত কয়েক বছর, আমি আক্রান্ত হওয়ার পর সহকর্মী সাংবাদিক নজরুল ইসলাম শাহজাদার বাবাও ছিনতাইকারীর কবলে ছুরিকাহত হয়েছিলেন, তিনি পেটে পায়ে মাথায় বয়ে বেড়াচ্ছেন আমারই মতো বেশ কয়েকটি ছুরির আঘাত । উনার চিকিৎসার সময় হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে পাশে ছিলাম,অল্পের জন্য তিনি প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন, এই দৃশ্যগুলো চোখে যেন আবারো স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সারারাত কাটিয়ে সকালে ভয়ার্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছি, ক্লান্ত হলেও ঘুম নেই চোখে। মনে ভাবনা আর কত?
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ছিনতাই ঘটনা নতুন কিছু নয়, একসময় ভয়াবহ ছিল, প্রকাশ্য দিবালোকে জনসম্মুখে শহরের প্রাণকেন্দ্রে ছিনতাই হয়েছে নানা কায়দায়। ছিনতাইকারীর আঘাতে একাধিক প্রাণহানীর ঘটনাও রয়েছে, ইদানিং সর্বত্রই বলাবলি হচ্ছে, আবারো ছিনতাই প্রবণতা উকিঝুকি দিচ্ছে, আবারো শহরে মানুষের মনে ভয়। যা হোক ছিনতাইকারীর কবল থেকে রক্ষার দায়িত্বে সংশ্লিস্ট মহল আছেন, তাদের কাছে শুধু ভয়ের ব্যাপারটি জানালাম। আমি, সিরাজ, শাহজাদার বাবা, অগ্রজ সাংবাদিক মোহাম্মদ আরজু ভাই সহ অনেকের মনে এই ভয় স্পষ্ট। এমন ঘটনার শিকার শহরের অনেকেই আছেন, আমাদের ভাগ্যে যা ঘটেছে তা আর না ঘটুক সেই কামনা করি।
আর হাসপাতালের জরুরী বিভাগ জরুরী চিকিৎসা সেবার জন্যই , রাত দিন কোন পার্থক্য নেই বরং হাসাপাতালে রাতের বেলায় আরও আন্তরিকসেবা প্রদান করা প্রয়োজন সরকারী সেবকদের, সরকারী হাসাপাতালে সরকারী সেবাই প্রত্যাশা করে মানুষ বেসরকারী সেবা নয়। আশা করবো সিরাজের ঘটনায় জড়িতরা দ্রুত গ্রেপ্তার হবে। শেরপুর, পৈরতলা , পুনিয়াউট , কাজীপাড়া ,পিটিআই ,ছয়বাড়িয়া ,কোকিল টেক্সটাইল মিল সড়ক, ঘাটুরা যেন ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য না হয় সে ব্যাপারে পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, ছিনতাইকারীদের চিহ্নিত করতে সামাজিক সহযোগিতা বিস্তৃত হবে এবং শহর বাসীর মন থেকে ছুরি চাকু, রক্ত, ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়া আর মালামাল হারানোর ভয় না থাকুক এমনই সুন্দর সময় প্রত্যাশা করি।
————————————————————————–
লেখক ঃসিনিয়র সহ সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব ,সম্পাদক নতুন মাত্রা।