“ছাত্রলীগের ইতিহাস- বাঙালির ইতিহাস” ::উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ছাত্রলীগের গৌরবময় ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলেন “ ছাত্রলীগের ইতিহাস-বাঙালির ইতিহাস”। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে, আজকের এই স্বাধীন সাবভৌম বাংলাদেশ হচ্ছে ছাত্রলীগের আন্দোলন, সংগ্রাম আর লড়াইয়ের বাস্তবরূপ। বাঙালি জাতিস্বত্তার জন্য স্বাধীন সার্বভৌম ভূখন্ডের ধারণা ছাত্রলীগই ধারণ করে চূড়ান্ত লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে আসে। ছাত্রলীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগ্রবর্তী বাহিনী – ভ্যানগার্ড – হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। ১৯৪৮ এর ৪ জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগই বায়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তর, সত্তর আর একাত্তুর হয়ে ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। সাধারণত: রাজনৈতিক দলগুলিই রাজনীতির আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছিল। এখানেই ছাত্রলীগের ভূমিকার অনন্যতা।
পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের শাসনের বিরোধিতা করে জন্ম হয়েছিল পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের। একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সুস্পষ্ট ব্যবহারের বিপরীতে গণতন্ত্রের শ্লোগানকে সামনে নিয়ে ছাত্রলীগ যাত্রা শুরু করেছিল। পূর্ব-বাংলায় মানুষের ভাষার অধিকার, স্বায়ত্বশাসনের কথা, ছাত্রদের নানাবিধ সমস্যার কথা সাজিয়ে ছাত্রলীগ তার আন্দোলনের প্ল্যাটফরম তৈরী করেছিল। ছাত্র সংগঠন হিসেবে তখন ছাত্র ফেডারেশন নামীয় কমিউনিস্ট পার্টির একটি সংগঠন কাজ করছিল। আর নিখিল পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে মুসলিম লীগের একটি নামসর্বস্ব ছাত্র সংগঠন ছিল। অমুসলিমদের প্রায় সকলেই ছাত্র ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করতেন। এদিকে ভাষার আন্দোলন চরিত্রগত দিক থেকেই একটি সার্বজনীন জাতীয় আন্দোলন। সুতরাং কোন ছাত্র সংগঠন, যা নামে অথবা কাজে যেভাবেই সাম্প্রদায়িকতার পরিচয়বাহী হলে একটি সার্বজনীন চরিত্রের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হবে। এইসব বিবেচনায় একসময় ছাত্রলীগ তার পরিচিতি থেকে সাম্প্রদায়িক নামাবলী ঝেড়ে ফেলে দেয়।
বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে, চূয়ান্ন সালের নির্বাচনে তদানিন্তন সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ভাষা আন্দোলনের জন্য গড়ে উঠা সংগ্রাম পরিষদে ছাত্রলীগ দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল। নির্বাচনে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ সাড়া দেশ তথা পূর্ব বাংলা চষে বেড়িয়েছিল। দৃঢ় চেতা তরুণ রাজনৈতিক নেতা ও অসাধারণ বাগ্মী শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাদের পথ প্রদর্শক ও মূল নেতা। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মতাদর্শকে সামনে নিয়ে ছাত্রলীগের যাত্রা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। এ সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে উঠে এসেছিলেন এম. এ. আওয়াল, এম.এ. ওয়াদুদ, আব্দুল মমিন তালুকদার, মোঃ কামরুজ্জামান, রফিকউল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ। ১৯৫৮ সনে সীমিত গণতন্ত্রের পাকিস্তানে আইয়ুব খানের নেতৃত্বে সামরিক স্বৈরতন্ত্র ক্ষমতা দখল করলে ছাত্রলীগও অন্যান্যদের মত ক্যাম্পাসভিত্তিক গোপনীয় তৎপরতায় চলে যেতে বাধ্য হয়। সময়ের বহমানতার পথ ধরে চলে আসে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন ও সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির আন্দোলন। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনকে সাথে নিয়ে এ সময়ে পূর্ব-বাংলায় দুর্বার ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ছাত্রলীগ। আর এ সময়েই ছাত্রলীগের কতিপয় নেতৃস্থানীয় নেতার নেতৃত্বে বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে গড়ে উঠে নিউক্লিয়াস বা বিএলএফ। স্বাধীনতার লক্ষ্যে পরিচালিত এই গুপ্ত সংগঠনের পশ্চাতে ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা ও পরামর্শ। এ সংগঠন কাজ করছিল মূলত: ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে। নেতৃত্বে আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ আহমেদ।
পয়ষট্টির পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পট-ভূমিকায় ১৯৬৬ সনের ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় বিরোধী সম্মেলনে ৬ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করলে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে তথা পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের এক বৈপ্লবিক কর্মসূচি উঠে আসে এই ৬ দফার মধ্য দিয়ে। ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ মুজিব তাঁর ঐতিহাসিক ৬ দফার বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। ৬ দফা ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠে পূর্ব বাংলা তথা বাঙালির বাঁচার দাবী। একের পর এক জনসভা বিভিন্ন জেলায়। আর পাশাপাশি একের পর এক গ্রেপ্তার হচ্ছেন শেখ মুজিব। দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠে সারা বাংলায়। নেতৃত্বে ছাত্রলীগ। ছেষট্টির ৬ জুন রাজবন্দীদের মুক্তির দাবীতে হরতাল। সে হরতালের নেতৃত্বেও ছাত্রলীগ। অবশ্য এবার ছাত্রদের সাথে যুক্ত হলেন আমাদের শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক বন্ধুরাও। শহীদ হলেন মনু মিঞাসহ অনেক নাম না জানা শ্রমিক কর্মী। রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে শ্রমিকদের এই সংযুক্তি রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এই আন্দোলন-সংগ্রামের মাঝেই ঘটে যায় এমন এক ঘটনা যা পরবর্তীতে স্বাধীনতার পথ খুলে দেয়।
১৯৬৮ সনে পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক আইয়ূব শাহী শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাকে জড়িয়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন পূর্ব বাংলা গঠনের ষড়যন্ত্রের দায় দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করে। সেই সাথে বাংলার স্বাধীনতা যে অলীক বিষয় নয় তাও মানুষের নিকট প্রতিভাত হয়ে উঠে। স্বাধীনতার প্রশ্নে বাংলার জনগণের মাঝে একটি ধারণা গড়ে উঠতে থাকে। বিষয়টিকে কার্যকরভাবে কাজে লাগায় ছাত্রলীগ। ৬ দফাকে ১ দফার দাবীতে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায় ছাত্রলীগ। এ দিকে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবীতে আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় হয়ে উঠে। ষাটের দশকের এই উত্তাল সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে উঠে আসেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মনি, কে এম ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, আব্দুর রাজ্জাক , সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আব্দুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী প্রমুখ। এই রাজনৈতিক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের। ভেসে যায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। নিঃশর্ত মুক্তিপান শেখ মুজিবুর রহমান। তোফায়েল আহমেদ এ আন্দোলনের মুখ্য নেতা। ডাকসুর সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি (পরবর্তীতে ছাত্রলীগের সভাপতি) তিনি। মুক্ত শেখ মুজিবকে প্রদত্ত লাখো মানুষের সংবর্ধনায় তোফায়েল তাঁকে বঙ্গবন্ধু অভিধায় অভিষিক্ত করেন।
সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগ পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ৬ দফা না হলে ১ দফা এই বক্তব্য নিয়ে ছাত্রলীগ মাঠে নেমেছিল এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলার গণমানুষের পক্ষে কথা বলার একমাত্র দাবীদার হিসেবে বেড়িয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু হন বাংলার একমাত্র মুখপাত্র। এই নির্বাচনে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে। এ সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখ। ছাত্রলীগের এই নেতৃত্বের জোরালো ভূমিকাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন আর মুক্তির যুদ্ধে ছাত্র-যুব সমাজের পক্ষে কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠে। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় একাত্তরের ১ মার্চ পাকিস্তানের রাজনীতির অবসান ঘোষণা করে ২ মার্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তথা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গনে। এর আগে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ স্বপন কুমার চৌধুরী ছিলেন এই প্রস্তাবের উপস্থাপক। তবে কৌশলগত কারণে এই প্রস্তাব প্রকাশ্যে আনা হয়নি।
১৯৭২ সনে ছাত্রলীগ ভাগ হয়ে যায়। মূলধারার ছাত্রলীগ মুজিববাদের বক্তব্য নিয়ে অগ্রসর হয়। অন্যভাগ জাসদ গঠনের অগ্রীম বক্তব্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অতি বিপ্লবী ও হঠকারী বামপন্থার আশ্রয় নিয়ে অগ্রসর হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ ১৯৭৪ সনে ছাত্রলীগের একটি ক্ষুদ্র অংশ মহসিন হলের ৭ ছাত্র হত্যাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ থেকে বেড়িয়ে যায়। অনেক চড়াই উৎড়াই সত্বেও ছাত্রলীগের মূলধারা মুজিবাদর্শকে বুকে নিয়ে এগিয়ে যায়। এ সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে উঠে এসেছিলেন শেখ শহীদুল ইসলাম, ইসমত কাদির গামা প্রমুখ। অন্যদের সম্পর্কে কোন কথা আজকের প্রেক্ষাপটে না বলাই উত্তম হবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর ছাত্র রাজনীতি আরেক রূপ পরিগ্রহ করে সে নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। আমরা মনে করি ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টের পূর্বে ছাত্রলীগের বিলুপ্তিতে জাতীয় ছাত্রলীগের গঠনের যে প্রয়াস বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন তা নিয়ে ইতিহাসের পাতায় নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল যা ১৫ আগস্ট’ ৭৫ এ পরিসমাপ্ত হয়ে যায়।’ ৭৫ পরবর্তীতে সম্পূর্ণ নতুনরূপে ছাত্রলীগের যাত্রা শুরু হয়েছিল যা আজও অব্যাহত আছে।
৭৫ পরবর্তী ছাত্রলীগের যে নতুনরূপ তা নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। আমরা মনে করি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাওয়াই আজকের দাবী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আদর্শের পথে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন এক সমাজব্যবস্থার কথা ছাত্রলীগের মাঝ দিয়ে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর আদর্শের এই লক্ষ্যমাত্রা আজও অর্জিত হয়নি। আমরা মনে করি জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশিত পথে তাঁর হাত ধরে ছাত্রলীগ পারবে তার অভীষ্ট লক্ষ্য মুজিবাদর্শের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। সেই প্রতিক্ষায় রইলাম আমরা — যারা একদিন ছাত্রলীগের কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম ঘনিষ্ঠভাবে। জয়তু ছাত্রলীগ।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সংসদ সদস্য, সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী।