কার কাছে বিচার চাইব?:: লেখকের পর এ বার প্রকাশককে কুপিয়ে খুন ঢাকায়, আক্রান্ত আরও তিন



জুলফিকার রাসেল:: এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়কে নির্মমভাবে কুপিয়ে খুন করা হয়। তার পর দিন ২৭ ফেব্রুয়ারি তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে লেখক-শিক্ষক-সহ সাধারণ মানুষ। ওই সমাবেশে শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুল কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে সবাইকে বলেছিলেন, ‘কার কাছে বিচার চাইব?’ শনিবার সেই আহমেদুর রশিদ টুটুলই জঙ্গিদের গুলিতে রক্তাক্ত। এ ছাড়া, একই দিনে শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক আরেফিন ফয়জল দীপনকে কুপিয়ে খুন করে জঙ্গিরা। এ দিনও যেন আমাদের বিচার চাওয়ার কেউ নেই।
অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েই বলতে চাই, শনিবার দুপুরে ঢাকার লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয়ের ভিতরে ঢুকে তিন জনকে কুপিয়ে ও গুলি করে জখম করে দুষ্কৃতীরা। নিরাপত্তা বাহিনী ও মিডিয়ার চোখ তখন এই ঘটনার দিকে। আমিও এ ঘটনা নিয়ে সন্ধ্যায় লিখতে বসেছি। ঠিক তখনই খবর এল—জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক আরেফিন ফয়জল দীপনকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। জানতে পারি, দীপনকে খুন করে আজিজ সুপার মার্কেটের মধ্যে জাগৃতির দোকানের ভিতর তাঁর দেহ রেখে বাইরে থেকে শাটার নামিয়ে চলে যায় দুষ্কৃতীরা।
আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, এই হামলার পিছনে আছে মৌলবাদী জঙ্গিরা। যারা বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, এটা তাদেরই কাজ। তারা এখন আর চোরাগোপ্তা হামলা নয়, ঘরে-ঘরে কিংবা অফিসে ঢুকেও খুন করার সাহস দেখাতে শুরু করেছে।
শুদ্ধস্বর প্রকাশক কিংবা জাগৃতি প্রকাশকের অপরাধ কী ছিল?
টুটুলের অপরাধ ছিল নিহত বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের বই ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব: উৎপত্তি এবং অস্তিত্বের সাম্প্রতিকতম ধারণা’, ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (প্রথম সংস্করণ) ও ‘সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ প্রকাশ করা। আর দীপনের অপরাধ ছিল, অভিজিতের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (দ্বিতীয় সংস্করণ) প্রকাশ করা। অভিজিৎ রায়ের খুনের পর থেকেই টুটুলের উপর হুমকি আসছিল। এ নিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় বন্ধু-মহলে সংশয় প্রকাশ করেছেন। এমন কী পুলিশের কাছে অভিযোগও দায়ের করেছিলেন টুটুল। কিন্তু কিছুই কাজে আসেনি। শেষ পর্যন্ত নিজের কার্যালয়ের ভিতরেই তাঁকে খুনের চেষ্টা করা হল। তাঁর সঙ্গে আরও দু’জন লেখকও আহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন, কবি তারেক রহিম ও লেখক-গবেষক রণদীপম বসু। এই লেখাটি যখন লিখছি, তখনও তাঁরা শঙ্কামুক্ত নন। তাঁদের চিকিৎসা চলছে।
মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা মানুষদের জন্য বাংলাদেশ আর নিরাপদ নেই। এ বছর অভিজিৎ রায় ছাড়াও ওয়াশিকুর রহমান (৮ মার্চ, ২০১৫), অনন্ত বিজয় দাস (১২মে, ২০১৫), নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় (৮ আগস্ট, ২০১৫) মৌলবাদীদের হামলার শিকার। তাঁরা সবাই লেখালেখির কারণেই খুন হয়েছেন।
লেখকের পর এ বার প্রকাশককে কুপিয়ে খুন ঢাকায়, আক্রান্ত আরও তিন
তাঁদের মধ্যে অনন্ত বিজয় দাস ছিলেন অভিজিৎ রায় পরিচালিত ‘মুক্তমনা’ ব্লগের লেখক। এমনকি অভিজিতের একটি বইয়ের ভূমিকাও লিখেছিলেন অনন্ত বিজয় দাস। এ জন্য তাঁকে টার্গেট করে জঙ্গি গোষ্ঠী। এখন অভিজিতের বইয়ের প্রকাশকের উপরও হামলা হল!
তা’হলে কি বাংলাদেশ ক্রমশ জঙ্গিদের আস্তানা হিসেবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে? এমন প্রশ্ন সবার মতো আমারও মনে হয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের আওয়ামি লীগ সরকার শুরু দিন থেকেই জঙ্গিদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসছে। এমন কী সম্প্রতি ব্লগার খুনের কিনারা করতে পেরেছেন বলে দাবি করছে পুলিশ। তবুও কেন যে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা সম্ভব হচ্ছে না জঙ্গিদের? এত জঙ্গি ধরা পড়লেও তবু কেন নিরাপদ নন মুক্তমনা লেখকরা?
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে লড়াই করেছিল একটি ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র্র নির্মাণের। আজ সেই দেশেই মুক্তমত প্রকাশ করা অসম্ভব হয়ে উঠছে। লেখকরা মার খাচ্ছে, মারা পড়ছে, দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
এখন অস্ত্র প্রকাশকদের উপরও ঠেকছে। এ যেন প্রকাশকদেরও হুমকি দেওয়া। তাঁদের বলে দেওয়া—‘যদি তোমরা বই প্রকাশ করো, তবে তোমাদেরও কোপানো হবে।’
কোন দিকে যাচ্ছে আমাদের সোনার বাংলাদেশ? যে দেশের স্বাধীনতা এসেছে ৩০ লাখ মানুষ, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। এখানে আজ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিরা একের পর আক্রান্ত হবে, আর বিপক্ষ শক্তিরা শক্তিশালী হয়ে উঠবে? এটাই কি আমাদের নিয়তি?
তবু ভয় নেই। ভয় দেখিয়ে আমাদের কোনও লাভ হবে না। আমরা আমাদের লড়াই চালিয়ে যাবই। এই লড়াই কলমের সঙ্গে চাপাতির। কলমকে জয়ী করতেই হবে। কত রক্ত ওরা নেবে? কত জনকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করবে? তাই, আমরা আজ কারও কাছে বিচার নিয়ে যেতে চাই না। আমরা লড়াই চালিয়ে যেতে চাই। কারণ বিচার দেওয়ার মতো কেউ নেই।
লেখক: বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক।