গৃহবন্দি অবস্থায় মানসিক অবসাদ কাটাবেন কী ভাবে?
লকডাউনের সময় এখন আমাদের গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে। অথচ আমরা সামাজিক জীব। মানুষের সঙ্গে মেলামেশা না করতে পারলে আমরা অস্বস্তি বোধ করি। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে বলে আমাদের সেই সুযোগটা আর এখন নেই। ফলে, ঘরে থেকেও আমরা খুব একা বোধ করছি। এক ধরনের বিষণ্ণতা গ্রাস করছে আমাদের। এই ধরনের জীবনযাপনে অভ্যস্ত নয় বলে এই গৃহবন্দিত্ব আমাদের কাছে একঘেয়ে হয়ে উঠছে। তার ফলে, দেখা দিচ্ছে মানসিক অবসাদ। নানা ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। কাল বাজারে গিয়ে কী পাব আর কী পাব না, জানি না। কাল বাড়িতে চাল ফুরিয়ে গেলে কী হবে, জানি না। মাছ ফুরিয়ে গেলে বাজারে পাব কি না, বাড়ির প্রবীণরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে কোন ডাক্তারের কাছে যাব, হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে রোগীকে ভর্তি করাতে পারব কি না, এমন সাতসতেরো চিন্তায় এখন দিন কাটাতে হচ্ছে আমাদের। যা আমাদের কার্যত মানসিক ভাবে অসুস্থ করে দিচ্ছে।
মনোরোগ চিকিৎসক আবীর মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এটা লকডাউনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। যদিও ৫ বছর থেকে ২৫/৩০ বছর বয়সিদের এই সমস্যায় খুব বেশি ভুগতে দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে যাঁরা শহরে থাকেন তাঁদের ক্ষেত্রে। কারণ, শহরে খেলাধুলো বা বাইরে বেরনোর জায়গা বা সুযোগ উত্তরোত্তর কমে যাওয়ায় এই বয়সিদের বেশির ভাগই ছোটবেলা থেকে নানা ধরনের অনলাইন গেম বা ইন্ডোর গেম, ভিডিও, মোবাইল বা হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে অভ্যস্ত। তাই তাঁদের অভ্যাসের সঙ্গে লকডাউনের দিনগুলির রোজনামচায় খুব একটা বদল ঘটছে না। ফলে, তাঁদের অস্বস্তি, অবসাদ বরং অনেকটা কম। কিন্তু ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী বা তার চেয়েও প্রবীণদের নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। কারণ, ছোটবেলা থেকে তাঁরা মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেই অভ্যস্ত। এতটা বয়সে পৌঁছে লকডাউনের জন্য তাঁদের সেই অভ্যাস হঠাৎ বদলে যাওয়ায় তাঁরা বিষণ্ণ হয়ে পড়ছেন, ভুগতে শুরু করেছেন মানসিক চাপ ও অবসাদে। তাঁরা বাজারে বেরতে পারছেন না। পাড়ার লোকজনের সঙ্গে আড্ডাও মারতে পারছেন না। আবার কম্পিউটার, মোবাইল, হোয়াটসঅ্যাপে এই প্রবীণদের বেশির ভাগই তেমন সড়গড় নন বলে এই সব নিয়েও তাঁরা বাড়িতে সময় কাটাতে পারছেন না।
তবে মনোরোগ চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, লকডাউনের সময় ইতিমধ্যেই বহু স্কুল ও কলেজে অনলাইন ক্লাস চালু হয়ে গিয়েছে। ফলে, ৫ বছর থেকে ২০/২৫ বছর বয়সীদের বাড়িতে পড়াশোনা করে সময় কাটাতে বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে না। বরং, লকডাউন তাঁদের সামনে বাড়ির লোকজনকে বোঝা ও বাড়ির লোকজনের প্রতি আরও বেশি দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে। সময় কাটাতে বাড়ির বেশ কিছু কাজ এখন তাঁরা করতে পারছেন, যা আগে তাঁরা হয়তো করতে শেখেননি বা করেননি কোনও দিন।
আবীরের কথায়, ‘‘এই বয়সীদের মধ্যে যাঁরা শহরে থাকেন, তাঁদের বাড়ির নানা ধরনের কাজে রপ্ত হয়ে ওঠার সুযোগ এনে দিয়েছে এই লকডাউন। যাঁরা গ্রামে থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথা খাটে। গ্রামের অল্পবয়সিরা এই সময় একাকিত্ব বা বিষণ্ণতা কাটাতে নানা ধরনের ইন্ডোর গেম খেলতে পারেন। কম্পিউটার থাকলে সময় কাটাতে পারেন নানা ধরনের অনলাইন গেমে। দাবা খেলতে পারেন। বাড়ির নানা ধরনের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারেন।’’
তবে সমস্যাটা বেশি ৩০ বছর থেকে ৫০ বছর বয়সীদের বা তার চেয়েও বেশি প্রবীণদের। কারণ, তাঁরা এমন ধরনের জীবনযাপনে কোনও দিনই অভ্যস্ত হননি। তাঁরা এখনকার প্রজন্মের চেয়ে সামাজিক ভাবে অনেক বেশি মেলামেশা করে এসেছেন ছোটবেলা থেকে।
আবীর জানাচ্ছেন, বাড়ি থেকেই এখন প্রবীণদের সেই সামাজিক যোগাযোগটা বজায় রেখে চলতে হবে। আর তা করতে হবে টেলিফোনে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে। আর টেলিভিশনে খবরটার উপর নিয়মিত নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে সরকারি ঘোষণা বা বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে। যাতে বাইরের জগতের সঙ্গে তাঁরা আপডেটেড থাকতে পারেন। তবে টেলিভিশনে মৃত্যু বা দুঃখ, শোকের খবর থেকে নিজেদের যদি তাঁরা দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন, তা হলে সেটাই সবচেয়ে ভাল। সে ক্ষেত্রে টেলিভিশনে করোনা আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যার খবরে সারা দিন ধরে নজর রাখার দরকার নেই। তার পরিবর্তে তাঁরা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, মন ভাল করা টিভি সিরিয়াল বা পুরনো দিনের সিনেমা দেখতে পারেন। শুনতে পারেন পুরনো দিনের আনন্দের গান। বাড়িতে নিয়মিত ভাবে ব্যায়াম করতেও পারেন।