Main Menu

রাষ্টব্যবস্থায় বিরোধী দল কি অপরিহার্য?

+100%-

গণতান্ত্রিক সিস্টেমে রাষ্ট্রপরিচালনায় বিরোধী দলের অস্তিত্বকে অত্যাবশ্যক বলে জ্ঞান করে থাকেন প্রায় সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং এতদসংক্রান্ত গবেষকগণ। এ ব্যাপারে তাদের যুক্তি হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমতার জোরে যা খুশি করা বা স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেয় কি না এ ব্যাপারে সজাগ থাকে বিরোধী দল। যেকোন আইন পাশ, বৈদেশিক চুক্তি, দুর্নীতি ইত্যাদিতে তারা সরকার পক্ষকে সর্বদাই চাপের মুখে রাখে। এতে করে রাষ্ট্র পরিচালনায় একটি ভারসাম্য বজায় থাকে। এ জন্য যেকোন দেশে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা আবশ্যক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিরোধী দল যতটা শক্ত ততটাই সরকারি দল চাপের মুখে থাকার কারণে তারা ভেবে চিন্তে কাজ করে। অপরদিকে বিরোধী দল ব্যর্থ হলে বা দুর্বল হলে ক্ষমতাসীন দল স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেয়, সহজেই তারা দুর্নীতি করে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার কের রাষ্ট্রের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। এই যুক্তিটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিরোধী দলের অস্তিত্ব আসলেই অপরিহার্য। কারণ, বিরোধী দল ছাড়া রাষ্ট্র অন্যায়ের আখড়া।

আমরা জানি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান কার্যালয় হচ্ছে সংসদ। সংসদে বসেই নতুন নতুন আইন পাশ, বাজেট প্রণয়ন থেকে শুরু করে সমস্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা, অনুমোদন দেওয়া হয় সেই সংসদ থেকেই। অর্থাৎ সংসদই হচ্ছে সরকারি দল ও বিরোধী দলের প্রধান কর্মক্ষেত্র। এখান থেকেই সাংসদগণ আলাপ-আলোচনা, যুক্তিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে কোন একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হোন। একটি দেশের সংসদ যত প্রাণবন্ত সেদেশের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ততটাই স্বচ্ছ এবং সচল।
কিন্তু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, যখন যে দলই বিরোধী দলে গিয়ে থাকুক না কেন, তারা লাগাতার সংসদ বর্জন করার মাধ্যমে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। দেশের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিটি সংসদেই নানা অজুহাতে বিরোধীদলের সংসদ বর্জন রীতিমতো প্রথায় পরিণত করা হয়েছে। পঞ্চম সংসদে (১৯৯১-১৯৯৫) প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ৪০০ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদের বাইরে ছিল ২৬৫ কার্যদিবস। তারা পঞ্চম সংসদে উপস্থিত থাকে ১৩৫ কার্যদিবস। আবার সপ্তম সংসদে (১৯৯৬-২০০১) প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ৩৮২ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদের বাইরে ছিল ২১৯ কার্যদিবস। আর অষ্টম সংসদে (২০০১-২০০৬) কার্যদিবস ছিল ৩৭৩ দিন। এই সংসদে ৩৭৩ কার্যদিবসের মধ্যে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদের বাইরে ছিল ২২৩ দিন।

৯ম সংসদের শেষ অধিবেশনের সমাপনী কার্যদিবস ছিল গত ২০ নভেম্বর। বিভিন্ন অজুহাতে অতীতের মতো পাঁচ বছরের অধিকাংশ দিনই সংসদে অনুপস্থিত ছিল বিরোধী দল বিএনপি।

২০০৯ সালে যাত্রা শুরু হওয়া নবম সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৪ জানুয়ারি। এ সংসদের শেষ অধিবেশনের সমাপনী কার্যদিবস ছিল গত ২০ নভেম্বর। এ পর্যন্ত ৪১৮ কার্যদিবসের মধ্যে বিরোধী দল ৩৪২ দিনই সংসদের বাইরে ছিল। আর বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সংসদে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১০ কার্যদিবস। দেশের ইতিহাসে এ সংসদেই সবচেয়ে বেশি কার্যদিবস ও সবচেয়ে বেশি ২৭১টি বিল পাস হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধন বিল পাসসহ পাঁচ বছরে সংসদে দুটি বেসরকারি বিলসহ মোট ২৭১টি বিল পাস হলেও তামাদি হয়েছে বর্তমান সংসদে উত্থাপিত ১৭টি বিল। এর মধ্যে ৬টি সরকারি বিল ও ১১টি বেসরকারি বিল।

পাঁচ বছরে সংসদের ১৯টি অধিবেশনে মোট ৪১৮ কার্যদিবসে পাঁচটি অর্থবছরের বাজেট পাসসহ কয়েকটি সাধারণ আলোচনা হয়েছে। বিরোধী দল এ সমসয় ২৮৩ কার্যদিবস সংসদ বর্জন করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। একটানা ৬৪ কার্যদিবস বর্জনের পর বিরোধী দল চতুর্থ অধিবেশনে সংসদে যোগ দিলেও বাজেট অধিবেশনে মাত্র একদিন যোগ দেওয়ার পর আবারও সংসদ বর্জন শুরু করে তারা। পরে আবার একটানা ৭৪ কার্যদিবস বর্জনের পর বিরোধী দল ২০১১ সালের প্রথম এবং সংসদের অষ্টম অধিবেশনের মাঝামাঝি সময় ১৫ মার্চ যোগ দেয়। ২৪ মার্চ সমাপনী দিনে তারা সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে। পরে নবম অধিবেশন থেকে তারা আর যোগ দেয়নি। নবম, দশম ও একাদশ এ তিনটি অধিবেশন টানা বর্জনের পর দ্বাদশ অধিবেশনের শেষের দিকে ২০১২ সালের ১৮ মার্চ সংসদে যোগ দিলেও ২০ মার্চ থেকে আবার বর্জন শুরু করে। এরপরে ১৩তম থেকে ১৮তম অধিবেশনে যোগ দেয়নি তারা। ১৯তম অধিবেশনে একদিন সংসদে যোগ দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাব উত্থাপন করে সংসদ থেকে ওয়াকআউটের পর আর সংসদে ফেরেননি বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। অবশ্য এদিন বিরোধীদলীয় নেতা সংসদে আসেননি।

পাঁচ বছরে পাস হওয়া ২৭১টি বিলের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) বিলটি। নবম অধিবেশনে এ বিলটি পাসের সময় বিরোধী দল সংসদে উপস্থিত ছিল না। এ ছাড়া ১১তম অধিবেশনে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দু’ভাগে বিভক্ত করতে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) সংশোধন বিল ও উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) বিল দুটি বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে মাত্র ৯ মিনিটে পাস হওয়ার বিষয়টিও ছিল আলোচিত। তবে চার বছরে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের জমা দেওয়া সাড়ে ৬ শতাধিক মুলতবি প্রস্তাবের একটিও গৃহীত হয়নি।
সংসদ সচিবালয় সূত্র থেকে জানা যায়, ৪১৮ কার্যদিবসে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত ৩ হাজার ৪৯৩টি প্রশ্নোত্তর অধিবেশনে উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭৯৩টির জবাব দেন। আর বিভিন্ন মন্ত্রীর উত্তরদানের জন্য ৬০ হাজার ১৪৭টি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে তারা ৩২ হাজার ৬৮৮টি প্রশ্নের জবাব দেন।

এছাড়াও সাংসদদের ব্যক্তিগত উপস্থিতির তালিকা দেখলে আরো হতাশ হতে হয়। একদিকে বিরোধী দল সংসদে অনুপস্থিত থেকে যেমন জনগণের অর্পিত দায়িত্ব পালন না করার মাধ্যমে তাদের সাথে কার্যত প্রতারণা করেছে তেমনি তারা সংসদ সদস্য হিসেবে বেতন ভাতাসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা গ্রহণে মোটেও পিছপা হয় না। অনেক সময় বিরোধী দল সংসদের হাজির হয়েছে কেবল তাদের সংসদ সদস্যপদ টিকিয়ে রাখার জন্য। বাংলাদেশের অতীত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে আমরা দেখতে পাই যে, শুধুমাত্র বিরোধীতা করার খাতিরেই বিরোধী দল পাঁচ বছর যাবত সরকারের সকল কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে যায়। সেটা হোক ভালো কিংবা হোক মন্দ। এমনও দেখা যায় সরকার দলীয় বাজেটের বিরোধিতা করতে হবে, তাই বাজেট পাশ হওয়ার আগেই বিরোধী দল বিকল্প বাজেট তৈরি করে। এ ঘটনা শুধু বাজেটের ক্ষেত্রেই নয়, সবকিছুতে বিরোধিতা করা বিরোধী দলের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপরিচালনা কিন্তু মোটেও থেমে থাকে না। অতীতে লাগাতার সংসদ বর্জনের ঘটনা অন্তত আমাদেরকে তাই শিক্ষা দেয়। কিন্তু এতে করে সরকারের বেপরোয়া সিদ্ধান্ত, স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিরোধ করা কি কোনভাবে সম্ভব? যদি তারা যা খুশি তাই করে যায় তাহলে কে বাধা দেবে? বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে যে পদ্ধতির বিরোধী দল অবস্থান করে তাতে তাদের থাকা আর না থাকা একই কথা। তারা সরকারকে কোনরকম চাপেই রাখতে পারে না। সুতরাং সরকারও বিনা বাধায় যা ইচ্ছা তা করে যায়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঠিকই তারা বেতন-ভাতা নিয়মিত উত্তোলন করে যান।

এ ব্যাপারে আমরা আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখতে পাই, ইসলামে বিরোধী দলের কোন অস্তিত্বকেই স্বীকার করে না। যারাই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন তারা সবার মতামত নিয়ে কাজ করেন। যারা সরকারের কাজে বিরোধিতা করে তারা দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হয়। অথচ বিরোধী দল না থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেরা কোন অন্যায় করেন না বা করতে পারেন না। কারণ তারা দুনিয়াতে ভয় করে ন্যায়-নীতিকে এবং সেই সাথে জনগণের কাছে জবাবদিহিতাকেও। কারণ ইসলাম জনগণকে এমন অধিকার দিয়েছে যে তারা প্রয়োজনে রাষ্ট্রনেতাদের কলার চেপে জবাবদিহিতা চাইতে পারেন। অর্ধ-পৃথিবীর খলিফা ওমর (রাঃ) এর মসজিদে কলার চেপে অতিরিক্ত কাপড় পাওয়ার ঘটনাটা এখানে স্মরণ করা যায়। অপরদিকে ইসলামের রাষ্ট্রনায়করা জনগণের কাছে ফাঁকি দেওয়া ছাড়াও আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয় করেন। সুতরাং তারা কিছুতেই রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে অন্যায় করতে পারেন না।

অন্যদিকে বস্তুতান্ত্রিক ও ভোগবাদী গণতান্ত্রিক শাসকরা অন্যায় করতে এ ধরনের ভয় করেন না। তারা একদিকে জনগণকে ফাঁকি দেন, অপরদিকে কোন কোন সময় তাদের এ অন্যায় কাজ প্রকাশ হয়ে গেলেও কোন সমস্যা নেই। আইনের মারপ্যাঁচে তারা পার পেয়ে যান। বিরোধী দলও এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করে না। কারণ তারা সবাই একই গোহালের গরু। আর প্রবল বস্তুবাদী আত্মাহীন হওয়া পরকালের ভয় তো তাদের মোটেই নেই। তাই গণতান্ত্রিকগণ রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহন করতে পারলে হয়ে উঠেন অপ্রতিরোধ্য ও বেসামাল। তাই রাষ্ট্রীয় অন্যায় রোধ করার জন্য কোন পথই খোলা থাকে না, তা দেশে যত শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতিই থাক না কেন।(সংগৃহীত)






Shares