Main Menu

জাপার রাজনীতিতে কাজী মামুনের ‘নাটকীয়’ উত্থান!

[Web-Dorado_Zoom]

জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে হঠাৎ উত্থান এবং পরে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা নেতা কাজী মামুনুর রশীদের যাত্রা যেন নাটকীয়তায় ভরপুর। ওষুধ কোম্পানির মাঠকর্মী থেকে নিকাহ রেজিস্ট্রার, সেখান থেকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসেন রাতারাতি। শুধু তাই নয়, এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা, রওশন ও জিএম কাদেরপন্থীদের সঙ্গে কখনো ঘনিষ্ঠতা এবং বারবার রাজনৈতিক অবস্থান পাল্টে দলের ভেতরে নানা আলোচনা-সমালোচনারও জন্ম দিয়েছেন তিনি। সবশেষ, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় জাতীয় পার্টির রওশনপন্থী অংশের মহাসচিব কাজী মো. মামুনুর রশীদ গ্রেফতার হয়ে আবারও আলোচনায় এসেছেন।

জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা বলছেন, ২০১৫ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর দ্রুতই উচ্চপর্যায়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন কাজী মামুন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি জড়ান একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে। সবশেষ স্পর্শকাতর মামলায় গ্রেফতার হয়ে তার রাজনৈতিক ‘পতন’ যেন নিশ্চিত হয়ে গেছে।

বিদিশা-বিরোধিতা থেকে ঘনিষ্ঠতা, পরে রওশন শিবিরে

২০১৯ সালের মাঝামাঝি, এরশাদের মৃত্যুর চার মাস পর বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্ক বাসভবনে যান বিদিশা সিদ্দিক। তার এই আগমনে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম বৈঠকে কড়া প্রতিবাদ জানান মামুনুর রশীদ। হুমকি দেন প্রয়োজনে টেনে হিঁচড়ে বের করে দেওয়ার। কিন্তু অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ভোল পাল্টান কাজী মামুন। বিদিশার ঘনিষ্ঠ হয়ে যান এবং এরশাদ ট্রাস্টের ট্রাস্টি পদে জায়গা নেন। এরপর বিদিশাকে সামনে রেখে ঘোষণা দেন ‘জাতীয় পার্টির নতুন কমিটি’, যেখানে নিজেই ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। দলের ব্যানারে নানা অনুষ্ঠানও করেন।

তবে সেখানেও বেশিদিন টিকেননি। বিদিশার সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হলে কাজী মামুন এবার রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠ হন। ব্যাংককে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় রওশনের সান্নিধ্য পেয়ে দলীয় কাউন্সিল আয়োজনে গঠিত প্রস্তুতি কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক হন।

একাধিক পক্ষ বদল, বহিষ্কার ও আলোচনায় ফেরা

২০২০ সালে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন কাজী মামুন। পরে বিদিশা এরশাদের সঙ্গে মিলে ‘জাতীয় পার্টি’ নামে একটি নতুন দলীয় গ্রুপ গঠনের চেষ্টা করেন, যেখানে বিদিশা চেয়ারম্যান ও মামুন মহাসচিব হন।

২০২৩ সালের দিকে রওশন এরশাদের পক্ষে নির্বাচন কমিশনে একটি চিঠি পাঠিয়ে ফের আলোচনায় আসেন মামুন। নিজেকে রওশনের মুখপাত্র দাবি করে সেই চিঠি জমা দিলেও রওশন পরবর্তী সময়ে বিষয়টি অস্বীকার করেন।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের ছেলে এরিক এরশাদের মামলায় তার বিরুদ্ধে সার্চ ওয়ারেন্ট জারি হয়। এতে তার রাজনৈতিক অবস্থান আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির (রওশনপন্থী) মহাসচিব হিসেবে দায়িত্বে আছেন। বিভিন্ন সময় অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য এবং বিবৃতি দিয়ে কিছুটা আলোচনায় ছিলেন মামুন।

কে এই কাজী মামুন?

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া কাজী মামুন এক সময় টেকনো ড্রাগস লিমিটেডের মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৫ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েই দ্রুত পদোন্নতি পান প্রথমে যুব সংহতির ভাইস প্রেসিডেন্ট, পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং মাত্র ৬ মাসের মাথায় হন শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক। সর্বশেষ তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য পদেও আসীন হন।

এরশাদকে ব্যবহার করে অঢেল সম্পদের মালিক

দলের ভেতরে আলোচনা রয়েছে, কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পাওয়ার পর থেকেই এরশাদের ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে কাজী মামুন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে ঠিকাদারির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন তিনি।

এরশাদের বাসভবনের চতুর্থ তলায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নিয়মিত তার সান্নিধ্যে যান মামুন। সেখান থেকেই জাহিদ মালেক (তৎকালীন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী) এর সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে একক আধিপত্য তৈরি করেন মামুন। বারিধারা, বেইলি রোড, মৌচাক—এলাকায় রয়েছে তার একাধিক ফ্ল্যাট ও দোকান। নরসিংদী এবং নিজ এলাকায়ও রয়েছে বিপুল সম্পদ।

জাতীয় পার্টির একজন সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কাজী মামুনের তো কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তিনি চেয়ারম্যানকে ব্যবহার করে সম্পদ গড়েছেন। সময় বুঝে যার ঘনিষ্ঠ হয়েছেন, তাকেই নিজের বলয় করেছেন।’

যে মামলায় ধরা খেয়ে রিমান্ডে

গত ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিন্টো রোডে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরির সময় মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বর্তমান সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন। এই অভিযোগে রমনা থানায় ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইনে’ মামলা হয়।

পুলিশি তদন্তে উঠে আসে, এনায়েত করিমের আগমনে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা, আবাসন ব্যবস্থা ও ব্যয়ভার বহনের দায়িত্বে ছিলেন কাজী মামুন। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে গত রোববার রাতে গুলশান থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) মামুনকে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ্ ফারজানা হকের আদালতে হাজির করা হয়। তদন্তের স্বার্থে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে আদালত ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

মামলার অভিযোগে যা আছে

রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে, কাজী মামুনুর রশীদসহ অজ্ঞাতনামা আরও কিছু ব্যক্তি এনায়েত করিমের সঙ্গে যোগসাজশে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেন।

এছাড়াও তারা সরকারের পতনের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক, প্ররোচনা ও সহায়তা করেন এবং প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তি বিনষ্টের ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। মামলার সঙ্গে মামুনের জড়িত থাকার বিষয়ে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য ও প্রমাণ পাওয়া গেছে।

তদন্ত কর্মকর্তার দাবি, এনায়েত করিমসহ পলাতক আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশে কাজী মামুনুর রশীদ একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে কাজ করছেন।






Shares