বঙ্গবন্ধুর পথই আমাদের পথ হোক : র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে সম্পূর্ণ আদর্শিক কারণে। তাঁকে হত্যা করে যাঁরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁরা যতটা না ব্যক্তি মুজিবের বিরুদ্ধে ছিলেন তার চেয়ে অধিক ছিলেন মুজিবাদর্শের বিরুদ্ধ শক্তি। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের আদর্শিক প্রত্যয়সমূহ (Concept) অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র তথা বৈষম্যহীন সমাজ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো আর বাঙালির জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বঙ্গবন্ধুরও আদর্শিক প্ল্যাটফর্ম ছিল। বস্তুত, বলা চলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সূচনা থেকেই বঙ্গবন্ধু এসব আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং এসব আদর্শকে তাঁর রাজনীতির প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তবে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে তিনি বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরৎ বোস মিলে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলা যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন ২৬ বছরের তরুণ ও অসামান্য সাংগঠনিক প্রতিভার অধিকারী শেখ মুজিবকে তা দারুণভাবে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছিল। সাতচল্লিশের ভারত বিভক্তির পর তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়।
পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠার নেপথ্য নায়ক ছিলেন মুজিব। ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বৃহত্তর রাজনীতির মাঠেও তাঁর পদচারণা দেখতে পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন তিনি এবং ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের মাটিতে তাঁর কারাবরণের পালার সূত্রপাত হয়। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে অবিচল থাকার কারণে মুচলেকা দেননি বলে বহিষ্কৃত হন ছাত্রত্ব থেকে। একাডেমিক পড়াশোনার পালা চুকে যায় মুজিবের, জীবনের পাঠশালায় শুরু হয় প্রকৃত পাঠের। কারাগারে থেকেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন। তরুণ যুব সমাজের মাঝে তাঁর প্রভাব বলয় তৈরি হতে থাকল। আর এ কারণেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কমিটিতে কারাগারে থেকেও মাত্র ২৯ বছর বয়সে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। কারামুক্তির পর তাঁর প্রস্তাবে মুসলিম শব্দের ভার থেকে আওয়ামী লীগ মুক্ত হয় এবং সত্যিকার অর্থে একটি জনগণের দল হিসেবে গড়ে ওঠার পথ খুঁজে নেয়। মুজিব হলেন দলের সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রলীগও ইতোমধ্যে তাঁরই রাজনৈতিক প্রভাবে মুসলিম শব্দের বোঝা মুক্ত হয়। বাঙালির পার্টি ও সংগঠন হিসেবে উভয়ই গড়ে ওঠার সুযোগ পায়। সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবমুক্ত হয়ে সর্বজনের পক্ষের রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন তথা বাঙালির স্বাধিকার হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদের দর্শনের প্রভাবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, এরই পটভূমিতে গড়ে ওঠা বাঙালি সংস্কৃতির আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট ও চুয়ান্নর নির্বাচন মুজিবের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাংগঠনিক তৎপরতার সাক্ষ্য বহন করে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও এবং মওলানা ভাসানীর রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করেও মুজিব স্বতন্ত্র ধারার পথে চলতে সক্ষম হন। ১৯৫৭ সালে শেখ মুজিব স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব ছেড়ে সংগঠনকে মজবুত ভিত দিতে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েন। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকে তিনি বাঙালির সংগ্রাম পরিচালনার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি জানতেন যে, পাকিস্তানের গঠন প্রকৃতি ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাপনই এমন যে এখানে গণতন্ত্রের কোন স্থান হতে পারে না। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের প্রতিনিধিরা গণতন্ত্রের অবশেষটুকুতে শেষ পেরেক মেরে দেয়। শুরু হয় এক দীর্ঘস্থায়ী একনায়কতান্ত্রিক সমরতান্ত্রিক শাসনের; যে ধারা থেকে আজ পাকিস্তান (এমনকি কখনও কখনও মনে হয় বাংলাদেশও) মুক্ত হতে পারেনি।
পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকে পাকাপোক্ত করতে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সূচনা করেছিল। যুদ্ধাবসানে এরই পটভূমিতে ১৯৬৬ সালে মুজিব ৬ দফা উপস্থাপন করেন, যা অচিরেই বাঙালির মুক্তির সনদে পরিণত হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধুকে ডান-বাম উভয় পক্ষের রাজনীতির অপকৌশলের মোকাবেলা করে এগুতে হয়েছে। তাঁকে মার্কিনীদের দালাল বলে ডান-বামেরা গালাগাল দিল। নিপীড়ন আর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানো হলো তাঁর ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের ওপর। কিন্তু জনগণের অজেয় শক্তির ওপর আস্থাশীল মুজিব হাল ছাড়েননি ও ভেঙে পড়েননি। ৬ দফা কর্মসূচী তুলে ধরে তিনি বাঙালি স্বার্থের প্রায় একক প্রতিনিধি ও মুখপাত্র হয়ে ওঠেন।
একের পর এক মামলা ঠুকে এবং বার বার কারাগারে নিক্ষেপ করেও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী স্বস্তি পায়নি। তারা তাঁকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পাকিস্তান ভাঙা প্রচেষ্টার অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে তাঁর বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের ব্যবস্থা নেয়া হলো। অভিযোগ উত্থাপিত হলো, মুজিব কতিপয় বেসামরিক ও সামরিক আমলাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতীয়দের সহযোগিতায় পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পাকিস্তানীদের অভিযোগের সত্যাসত্য যাই হোক না কেন, এ মামলার ফলে শেখ মুজিব বাঙালি স্বার্থের একক মুখপাত্রে (Sole Spokesman) পরিগণিত হলেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধানতম পুরুষ হয়ে উঠলেন। বাঙালিরা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিপক্ষে মুজিবের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে একক অবিনশ্বর মুজিব-নেতৃত্বকে উদ্ভাসিত করে তুলল। লাখো কোটি মানুষের নেতা মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির একচ্ছত্র নেতৃপদে বৃত হলেন তিনি।
সংগ্রাম, আন্দোলন আর স্বাধীনতার প্রতীক মুজিবকে হত্যা না করে প্রতিক্রিয়ার শক্তি বাংলার মাটিতে দাঁড়াতে পারছিল না বলেই পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনব্যাপী যে সব আদর্শকে লালন-পোষণ করেছেন তাঁর মৃত্যুতে সে সব আদর্শ দৃশ্যপট থেকে অপসারণ করা যাবে এমনটা চিন্তা করেই ওরা কাজ করেছে। মুজিব হত্যার সুদীর্ঘ ৩৬ বছর পর ইতিহাসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেকে আজ প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে, প্রতিক্রিয়ার শক্তি কি সত্যি সত্যি জয়যুক্ত হয়ে গেল? উত্তরণের কি কোন পথ নেই? আর এর জবাব একটাই। বঙ্গবন্ধু যেমনটা জনগণের ওপর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাসকে তাঁর রাজনৈতিক কর্ম কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে কাজ করে গেছেন, আমরাও যদি তা প্রকৃতভাবে অনুসরণ করতে পারি, তা হলে মুজিবাদর্শ তথা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের চাদরে বাংলাদেশকে ঢেকে দিতে পারব।