Main Menu

৭ই মার্চের ভাষণঃ অডিও ও ভিডিও রেকর্ড করার কাহিনী

+100%-

আজ ৭ই মার্চ। ৭১-এর এই দিনে রেসকোর্স ময়দানে এক অসাধারণ কবিতার সৃষ্টি হয়েছিলো। ৭ই মার্চের এই কবিতা বা ভাষণ নিয়ে এর আগে অনেক লেখা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। এর ঐতিহাসিক পটভূমি, এর গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা- সবকিছুই অনেক জ্ঞানী গুণীজন বহুভাবে বিশ্লেষন করেছেন। আমি সেইদিকে যাবো না। আমি বরঞ্চ এই ভাষণটির অডিও এবং ভিডিও ভার্ষন রেকডিং করা নিয়ে কিছু তথ্য সবাইকে জানাতে চাই। এটা আসলে ইতিহাস সংরক্ষণের মতো ব্যাপার।

৭ই মার্চের ভাষনের অডিওকরণঃ

৭ই মার্চের ভাষণ রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা থেকে সরাসরি সম্প্রচারের জন্য প্রস্তুতি আগে থেকেই নেওয়া শুরু হয়। এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন রেডিও পাকিস্তান, ঢাকার তৎকালীন ডিরেক্টর আশরাফুজ্জামান খান। ভাষণের দিন মঞ্চে অবস্থান নেন প্রোগ্রাম অরগানাইজার নাসার আহমেদ চৌধুরী (যার সাথে একটি ব্যক্তিগত পোর্টেবল EMI- টেপ রেকর্ডারও ছিলো) ও এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর আহমেদুজ্জামান। মঞ্চের নিচে অবস্থান নেন দুইজন প্রোগ্রাম অরগানাইজার সামসুল আলম এবং কাজী রফিক। সাভার ট্রান্সমিটার সেন্টারে ছিলেন প্রোগ্রাম প্রডিউসার মীর রায়হান। আশফাকুর রাহমান (প্রোগ্রাম অরগানাইজার) এবং বাহরাম সিদ্দিকী (প্রোগ্রাম অরগানাইজার) ছিলেন ঢাকা রেডিও অফিসে।

৭ই মার্চ সকাল থেকেই রেডিওতে প্রচার করা হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা থেকে সম্প্রচার করা হবে। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ শুরু করবেন, তখন ঢাকা অফিস থেকে রেসকোর্সে ওয়ারল্যাসের মাধ্যমে খবর আসে সম্প্রচার বন্ধ করতে। মেজর সিদ্দিক সালেক ঢাকা অফিসে অবস্থানরত আশফাকুর রহমানকে হুমকী দিয়ে বলেন, তারা যদি ভাষণের সরাসরি সম্প্রচার অব্যাহত রাখে, তাহলে রেডিও অফিস উড়িয়ে দেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু নাসার আহমেদ চৌধুরী তার ব্যক্তিগত টেপ- রেকডারে গোপনে ভাষনটি রেকর্ড করতে থাকেন।

এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর আহমেদুজ্জামান দ্রুত একটি চিরকুটে সম্প্রচার বন্ধ হওয়ার ঘটনাটি লিখে ডিরেক্টর আশরাফুজ্জামান খানের পাঠান, তিনি আবার টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্যের হাতে সেই চিরকুটটি দেন। তিনি চিরকুটটি বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠান। ভাষণ তখন মাঝ পথে। চিরকুটটি এক ঝলক পড়ে সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এইমাত্র খবর পেলাম, তারা ভাষণ সম্প্রচারে বাধা দিচ্ছে” এবং এরপরেই বলেন, “………মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোনো বাঙ্গালী রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙ্গালী টেলিভিশনে যাবেন না…।” (সূত্রঃ নাসার আহমেদ চৌধুরীর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটঃ http://nasarchoudhury.wordpress.com/)

পুরো ১৯ মিনিটের ভাষণটি গোপনে রেকর্ড করে ফেলেন নাসার আহমেদ চৌধুরী। পরের দিন এই রেকর্ডকৃত ভাষণটিই রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা অফিস থেকে সম্প্রচার করা হয়। এ প্রসঙ্গে সেই সময়ে ঢাকা অফিসে অবস্থানরত আশফাকুর রহমান ২০০৫ সালের ৬ই মার্চ বিডিনিউজ২৪.কম –এ বলেছেন, “তখন আমার বয়স মাত্র ২৮। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে অনুষ্ঠান সংগঠক হিসেবে সদ্য যোগ দিয়েছি। …………….আমাদের নেতৃত্ব দিতেন রেডিওর আঞ্চলিক পরিচালক আশফাকুজ্জামান খান। তিনিই গোপনে আমাদের জানান, আমরা সেনা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রেডিওতে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করবো। সে-কি উত্তেজনা আমাদের মধ্যে! ৬ মার্চ রাতেই রেডিওর প্রকৌশলীরা রমনা রেসকোর্স মাঠে যে মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন, সেখানে টেলিফোনের তার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বসা।
৭ মার্চ বেলা ২টায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার কথা।

বেলা ১২টা থেকে আমরা রেডিওতে কিছুক্ষণ পর পর ঘোষণা দিতে থাকি, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচার করা কথা। বঙ্গবন্ধু একটু দেরিতে বেলা ২টা ২০মিনিটের দিকে মঞ্চে আসেন।

এদিকে একই সময় রেডিও অফিসে মেজর সিদ্দিক সালেক টেলিফোনে মেসেজ পাঠান: নাথিং অব শেখ মুজিবুর রহমান উইল গো অন দ্য এয়ার আনটিল ফারদার অর্ডার।…

এই মেসেজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রতিবাদ হিসেবে রেডিওর সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে অফিস ছেড়ে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে চলে যাই। ওই দিন আমরা রেডিওর অনুষ্ঠান বয়কট করি। সাভারে একটি বিকল্প শক্তিশালী ট্রান্সমিটার ছিলো। সেখান থেকে যেনো আবার অনুষ্ঠান প্রচার করা না হয়, সে জন্য সেখানে ট্রাংকল করে খবর দেওয়া হয় সকল রেডিও কর্মীকে আত্নগোপন করার জন্য। ওইদিন রেডিওতে আর কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়নি।
ওই সন্ধ্যায় আমরা এলিফ্যান্ট রোডের এক বাসায় গোপন বৈঠকে বসি। রাতে আমাদের নেতা আঞ্চলিক পরিচালক আশফাকুজ্জামান খবর নিয়ে আসেন, সেনাবাহিনী রাজি হয়েছে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করতে। তবে শর্ত হচ্ছে, সবাইকে কাজে ফিরে যেতে হবে। পরদিন ৮ মার্চ সকাল ৭টায় আমরা আবার কাজে যোগ দেই। রেডিওতে প্রচার করা হয় রেকর্ড করা বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, …এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম…”। (সূত্রঃ How the speech went on air, লেখকঃ বিপ্লব রহমান, বিডিনিউজ২৪ডটকম, ৬ মার্চ, ২০০৫)

রেডিও পাকিস্তানের বাইরে আরেকটি অডিও রেকর্ডের কথা জানা যায়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ ডঃ মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবুল খায়ের এমএনএ। তাঁরা আগেই সিদ্ধান্ত নেন, যেভাবেই হোক ভাষণের রেকর্ডিং করতে হবে। ………….পরিচালক আবুল খায়ের গোলাপগঞ্জ থেকে নির্বাচিত এমএনএ ছিলেন, তিনি ১৯৬৩ সাল থেকে ফিল্ম করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ‘জয় বাংলা’ ফিচার ফিল্মের তিনি প্রযোজকও ছিলেন। তাঁর সঙ্গে তখন অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান ছিলেন এনএইচ খন্দকার। ……………….আবুল খায়ের এমএনএ-র তত্ত্বাবধানে মঞ্চের নিচে এ এইচ খন্দকার সম্পূর্ণ ভাষণের কথাই রেকর্ড করতে সক্ষম হলেন। বেতারের কর্মকর্তারাও ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার করতে না পারলেও এটির পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড করাতে তাঁরা সক্ষম হন, যা পরদিন বেতারকর্মী এবং জনগণের দাবির কারণে বেতার থেকে প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষে ফিল্ম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এইচএম সালাহউদ্দিন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভাষণটির একটি রেকর্ড প্রকাশের ব্যবস্থা দ্রুত সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। …………

………………এর পর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করলে করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ভাষণের ৫০০টি রেকর্ড ৪৮, ইন্দিরা রোডস্থ অফিসের নিচে বস্তায় যত্ন সহকারে মাটিতে পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করেন। কয়েকটি রেকর্ড কলকাতায় পাঠানোরও ব্যবস্থা করা হয়। হিজ মাস্টার্স ভয়েস (এইচএমভি) কম্পানি রেকর্ডটি এপ্রিল মাসে পায়। তারা এর তিন হাজার কপি বিনামূল্যে বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রবাসী সরকারও বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি তখন বহির্বিশ্বে বিতরণের ব্যবস্থা করে। ঢাকা থেকে রেকর্ডটি ‘ঢাকা রেকর্ড’ নামে প্রকাশিত হয়। এই রেকর্ডে ভাষণটি যৎসামান্য সম্পাদনা করা হয়, যে সব বক্তব্য ভাষণে দুবার উচ্চারিত হয়েছিল, তা একবার রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মূল ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণার কথাটি দুবার উচ্চারিত হয়েছিল। ‘ঢাকা রেকর্ড’ তা একবার রেখেছিল। অন্যদিকে ঢাকা বেতার তা অটুটু রেখেছিল। তবে ঢাকা বেতারের কপিটি নানা বাধা-নিষেধের কারণে বাইরে প্রচারে তেমন আসতে পারেনি। কিন্তু ঢাকা রেকর্ডটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং স্বাধীনতার পর নানাভাবেই প্রচারিত হওয়ার সুযোগ পায়। এটি তাই সর্বাধিক প্রচারিত অভিও ভাষণ।” (সূত্রঃ ৭ই মার্চের ভাষণ : অডিও-ভিডিওকরণ, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৭ মার্চ, ২০১২)

৭ই মার্চের ভাষনের ভিডিওকরণঃ

বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন সরকারের ফিল্ম ডিভিশনের (ডিএফপি) কর্মকর্তা (পরে অভিনয়শিল্পী হিসেবে খ্যাত) মরহুম আবুল খায়ের। তিনি সচল ক্যামেরা বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি মঞ্চের এক পাশে সচল ক্যামেরা নিয়ে চিত্র ধারণ করতে থাকেন। ক্যামেরার আকার বড় থাকায় খুব বেশি নড়চড়া করতে তিনি পারছিলেন না। বিশেষত ভাষণের পরিবেশ শুরু থেকে শেষ অবধি এতটাই আবেগ, উত্তেজনা ও দৃষ্টিকাড়া ছিল যে কোনো ক্যামেরাম্যানের পক্ষেই নড়াচড়া করার তেমন সুযোগ ছিল না। সে কারণে তিনি একটা দূরত্বে থেকে একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার দৃশ্য যতটুকু পেয়েছেন ততটুকুই ধারণ করেছেন। ফলে দেখা যায় বক্তৃতার ভিডিও দৃশ্যটি ১০ মিনিটের। (সূত্রঃ ৭ই মার্চের ভাষণ : অডিও-ভিডিওকরণ, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৭ মার্চ, ২০১২)