বৃদ্ধাশ্রম: আমাদের উপলব্দি-মোহাম্মদ লোকমান
মাঝে মধ্যেই বিশেষ করে দুই ঈদে টিভিতে বৃদ্ধাশ্রমের উপর প্রতিবেদন দেখানো হয়। এবারও ঈদের পরের দিন একটি টিভি চ্যানেলে দেখছিলাম সেরকম একটি প্রতিবেদন। কিন্তু এবারের দেখা আর আগের অনেকবার দেখার মধ্যে বিরাট একটা পার্থক্য অনুভব করলাম।
ঈদের আগের দিন আমি ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হই। জ্বরের সাথে চরম মাথা ও শরীরব্যথা। আমার মাঝে মধ্যে এরকম জ্বর হয় এবং তিন থেকে পাঁচদিন পর্যন্ত কষ্ট দেয়। অসুস্থতার সময় প্রিয়জনের সান্বিধ্য এবং সেবা শুশ্রষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা ব্যখ্যার দাবী রাখে না। মহান আল্লাহর অসীম রহমত, পারিবারিক মায়া মমতা এবং স্নেহ ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ পরিবারগুলির মধ্যে আমার পরিবারকেও শামিল রেখেছেন। আমার স্ত্রী ও ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে সার্বক্ষনিক সেবা-শুশ্রষা এবং সান্বিধ্যে থেকে আমার সুস্থতা ত্বরান্বিত করার চেষ্টায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেনি। পাঁচ আর দশবছর বয়সী বাচ্চা দুটোও খেলাধুলার চেয়ে আব্বুর পাশে থাকটা পছন্দ করছিল।
আমি স্ত্রী ছেলে মেয়েদের সেবাযত্ন আর সান্বিধ্যে ধন্য হয়ে যখনই আত্মতৃপ্তি অনুভব করতেছিলাম তখনই টিভির পর্দায় ভেসে উঠল বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অশ্রুঝরা করুণ মুখচ্ছবি। কেউ কেউ গোপন করার চেষ্টা করলেও কয়েকজন অকপটে বলে ফেললেন, তাদের প্রতি তাদেরই উত্তরসূরীদের অবহেলার গল্প। সাক্ষাত করতে আসা একজনের ভাগ্নে বললেন, মামাকে কয়েক বছর সাথে রেখেছেন কিন্তু বিরক্ত করার কারনে এখানে রেখে গেছেন। মামার ছেলেরা বাহিরে থাকেন। এসব আশ্রিত মানব মানবীরা একসময় যুবক-যুবতী ছিলেন, ছিলেন শারিরীক ও মানসিক শক্তিসামর্থ্যের অধিকারী। অথচ আজ এমন অসহায়,আশ্রমের দায়িত্বশীল একজন বললেন,এখানে মারা যাওয়ার পর মৃতদেহ নেওয়ার জন্যও অনেকের অত্মীয় স্বজন পাওয়া যায়না। হায়রে নিয়তি!
মনে পড়ে গেল আবুধাবীতে ২০ বছর আগে পরিচয় হওয়া ঢাকার সেই হক সাহেবের কথা, যিনি প্রবাসের রক্তপানি করা পরিশ্রমের টাকায় দুই ছেলেকেই বিলাত পাঠিয়েছিলেন উচ্চডিগ্রী নিয়ে তাদের মুখ উজ্জল করার জন্য। বিনিময়ে যা পেয়েছিলেন তা হলো-সার্বক্ষনিক মলিন বদনে কিছুক্ষণ পরপর একেকটি দীর্ঘশ্বাস। কারণ ছেলেরা সেখানে গিয়ে লীভটুগেদার/ মেয়েবন্ধু আরো কত কী করে নিজেদের মুখ উজ্জল(?)রাখায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এতদিনে হক সাহেব বেশ বৃদ্ধ হওয়ার কথা। জানি না বেঁচে আছেন,নাকি কোন ওল্ডএইজ হোমের বেডে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে অশ্রু ঝরাচ্ছেন।
চট্রগ্রামের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বন্ধুর আক্ষেপ,”আমার ছেলেটি যদি বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নিত তাও আমার জন্য ভাল হতো,অন্তত কাছে থেকে বাবা বলে ডাকতো”। এই ধন্যঢ্য ব্যক্তির একটি মাত্র ছেলে দেশে না আসার দৃপ্ত শপথে বলীয়ান হয়ে পশ্চিম জগতের বাসিন্দা হয়ে উল্টাপাল্টা জীবন উপভোগে ব্যস্ত হয়ে আছে।
ওল্ডাএইজ হোম বা বৃদ্ধাশ্রম যে নামেই ডাকা হোক না কেন এটি বাংলাদেশী কালচার নয়। এটি হচ্ছে ওয়েস্টার্ন কালচার। পশ্চিমাদের আরো অনেক কালচারের সাথে এটাকেও আমরা গ্রহণ করতে যাচ্ছি হয়ত। ওয়েস্টার্ন মানেই সবকিছু খারাপ নয়,তবে ওনাদের “গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালা” মন্ত্রের দিক্ষা না নেয়াতেই আমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে আমি মনে করি। সুখের বিষয় হচ্ছে,আমাদের ধর্মীয়(সকল) এবং মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কালচারের উপর উক্ত ওল্ডএইজ হোম কালচার এখনো জয়ী হতে পারেনি এবং পারবেও না হয়ত। বৃদ্ধ এবং মৃত্যু পথযাত্রীদের প্রতি এদেশের মানুষের সম্মান,ভালবাসা এবং মায়া-মমতা অতুলনীয়।
লিখাটি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে,তার পরও একটি চলমান ঘটনা শেয়ার করার লোভ সমলানো যাচ্ছে না। ইউ,এ,ই প্রবাসী বড় ব্যবসায়ী আমার এক বন্ধু চট্রগ্রামের আবুল হাসেম ভাই। ছোট বেলায় মা’কে হারিয়েছেন,বৃদ্ধ বাবাকে প্রবাসে সাথে রেখেছেন বেশ কয়েক বছর যাবৎ। বর্তমানে অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা,গোসল,টয়লেট ইত্যাদিও করতে অক্ষম তার বাবা। যার কারণে এই ঘটনার অবতারনা তিনি হচ্ছেন আমাদের রেনু ভাবী,হাসেম ভাইয়ের স্ত্রী। এই শিক্ষিত ভদ্র মহিলাটি হাসী মুখে নিরলস ভাবে তাঁর শ্বশুরের এ টু জেড সেবা যত্ন করে চলেছেন একটি ছোট শিশুকে যে ভাবে করা হয় তদ্রুপ। খুব নিকট থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল,ভাবীর এই মহৎ গুনটি দেখে নিজের অজান্তেই অশ্রু ঝড়েছিল আমার। শ্বশুরের প্রতি অবহেলা হওয়ার ভয়ে বেড়াতে যাওয়াও সীমিত করেছেন তিনি। আমাদের চারপাশে এমন হাজার হাজার মহৎপ্রাণ মানুষ আছে বলেই আমাদের সামাজিক বন্ধন এখনো বিশ্বজোড়া।
সর্বশেষ একটি অপ্রীয় সত্য বলতেই হয়। তাহলো,আমরা মা বাবারা আমাদের সন্তানদেরকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পেছনে যথেষ্ট সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে থাকি কিন্তু তাদেরকে মৌলিক মানবীয় এবং ধর্মীয় গুনাবলীর শিক্ষা দেয়ার বিষয়টা এড়িয়ে যাই অনেকাংশে। কোন এক ব্যক্তি কৌতুক করে বলেছিলেন,”যেসব মা তাদের শিশুকে শিশুআশ্রমে (চাইল্ড কেয়ার) রেখে নিজেরা আমোদ ফুর্তিতে কাটিয়েছেন তাদের শিশুরা বড় হয়ে তাদের মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে তার প্রতিশোধ নেবে”।
এটি নিছক কৌতুক হলেও একেবারে ফেলে দেয়ার মত নয়। কারণ এতে সন্তানের সাথে মা বাবার ভালবাসা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায় না। অনেক বাবা এমন আছেন যারা সন্তানদের সাথে ফ্রি হওয়া, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা এবং কোন কাজে তাদের মতামত নেয়াকে অপমান মনে করে থাকেন। এমন কি বিয়ে শাদীর মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও নিজের মত চাপিয়ে দেয়ার মত ভুল করে বসেন। মনে রাখতে হবে যেসব মা বাবা আদর ভালবাসা,সুশিক্ষা ও প্রাপ্য স্বাধীনতা দিয়ে সন্তান মানুষ করবেন সে সন্তান কখনো তার বৃদ্ধ মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে ঠেলে দেবে না,জীবনের বিনিময়েও না। তাই আসুন আমরা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমকে ‘না’বলার পরিবেশ তৈরী করার চেষ্টা করি।