আশুগঞ্জ সার কারখানার নাইট্রোজেন কেনার নামে কোটি টাকা আত্মসাত!



ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সার কারখানার বাণিজ্যিক বিভাগের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মো. মেহেদি ইসলামের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। তিনি কারখানার জন্য নাইট্রোজেন কেনার নামে এক কোটি ২১ লাখ ৮১ হাজার ৯৩৯ টাকা আত্মসাত করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে।
কারখানা কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক তদন্তে বাণিজ্যিক বিভাগের স্থানীয় ক্রয় শাখার সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মেহেদি হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত ও সংশ্লিষ্টতা/দায়িত্ব অবহেলা ও সহযোগিতার অভিযোগে আরো ১১ কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) কর্তৃপক্ষ।
কারখানা সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর ধরে দেশীয় রাসায়নিক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান লিন্ডি বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে আশুগঞ্জ সার কারখানা কর্তৃপক্ষ তরল নাইট্রোজেন কিনে আসছিল। কারখানার বাণিজ্যিক বিভাগের অনুবিভাগ স্থানীয় ক্রয় শাখা প্রত্যক্ষভাবে এ ক্রয় করে থাকে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মেহেদি ইসলাম তরল নাইট্রোজেন না কিনেই লিন্ডি বাংলাদেশ লিমিটেডের ভুয়া ক্যাশ মেমো তৈরি করে রাসায়নিক ক্রয় দেখিয়ে আসছিলেন। শুধু তাই নয়, রাসায়নিক না কিনলেও একই কায়দায় তিনি কারখানার কয়েক কর্মকর্তার নকল সিল তৈরি, ব্যবহার ও স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এসব তরল রাসায়নিক কারখানায় প্রবেশও দেখিয়ে আসছিলেন। পরে কারখানা থেকে এসব মালামাল ক্রয়ের মূল্য পরিশোধে চেক নিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে নিজেই সেই টাকা আত্মসাত করতেন।
গত মাসের শেষ দিকে কারখানার ক্রয় শাখায় লিন্ডি বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি বিক্রয় রশিদ নিয়ে সন্দেহ হলে তা কারখানার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। কারখানা কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তা তাদের বিক্রয় রশিদ নয় বলে জানায়।
কারখানা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্তে প্রশাসন বিভাগের ব্যবস্থাপক মো. দেলোয়ার হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি চলতি মাসের ১ এবং ৯ তারিখে দু’দফা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।
প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, মেহেদি বেশ কয়েক বছর ধরে কারখানা কর্তৃপক্ষের মোট ১১টি চেকের মধ্যে ১০টি চেকের বিপরীতে জালিয়াতির মাধ্যমে কারখানার হিসাব থেকে মোট এক কোটি ২১ লাখ ৮১ হাজার ৯৩৯ টাকা তুলে আত্মসাত করেছেন। এ ছাড়া মেহেদি ইসলামের অফিস কক্ষ তল্লাশি করে তাঁর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একাধিক কর্মকর্তার নকল সিল, লিন্ডি কোম্পানির অনেক নকল প্যাডও উদ্ধার করে।</p>
কারখানা কর্তৃপক্ষ বিসিআইসির নির্দেশনা অনুসারে মেহেদি ইসলামকে চাকরি থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেন। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কর্মস্থল ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং কেন তাঁর বিরুদ্ধে চাকরি থেকে বরখাস্ত ও অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এ মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া প্রাথমিক তদন্ত অনুসারে আরো ১১ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্বে অবহেলা বা জড়িত থাকার সন্দেহে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
ওই ১১ কর্মকর্তা হলেন ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মো. হাবিবুর রহমান, ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মো. হারুন-অর-রশিদ মোল্লা, মহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন) ড. মোফাজ্জল হোসেন সরকার, রসায়নবিদ ফরিদ উদ্দিন, উপ-প্রধান রসায়নবিদ মো. আলমগীর হোসেন, নির্বাহী প্রকৌশলী (রসায়ন) মোতালেব হোসেন, উপ-প্রধান রসায়নবিদ নাজমুল ফারুক, নির্বাহী প্রকৌশলী (রসায়ন) ওহেদুল ইসলাম মোল্লা, ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মো. সেলিম রেজা, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রসায়ন) শচীন্দ্র নাথ হালদার, নির্বাহী প্রকৌশলী (রসায়ন) শিমুল পোদ্দার।
এদিকে, বিসিআইসি কর্তৃপক্ষও গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিষয়টির স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বৃহৎ দুর্নীতির সঙ্গে আরো কারা জড়িত তা তদন্তে বিসিআইসির হিসাব নিয়ন্ত্রক গোলাম ফারুককে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
কমিটির অপর সদস্যরা হলেন বিসিআইসির আইন উপ-বিভাগের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. সাইফুল ইসলাম ও জিপিইউএফপি ঢাকা লিয়াঁজো অফিসের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মো. শহীদুল্লাহ। কমিটি এর সঙ্গে আরো কেউ জড়িত রয়েছে কিনা তা তদন্ত করে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে আশুগঞ্জ সার কারখানার তদন্ত কমিটির সদস্য মো. দেলোয়ার হোসেন (ব্যবস্থাপক প্রশাসন) বলেন, ‘আমরা আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছি। প্রাথমিকভাবে অভিযুক্তের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে। কর্তৃপক্ষ পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেবেন।’
এ ব্যাপারে আশুগঞ্জ সার কারখানার বাণিজ্যিক বিভাগের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মো. মেহেদি ইসলাম বলেন, ‘কারখানার কোনো বিষয়ে আমার কথা বলা নিষেধ করেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান। আমাকে কর্তৃপক্ষ আমার বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন।’
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একজন আনসার সার্বক্ষণিকভাবে মেহেদি ইসলামের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে কাউকে দেখা করতে দিচ্ছেন না।
আশুগঞ্জ সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কারখানার গঠিত কমিটির তদন্তে প্রাথমিকভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাত ও কাগজে আর্থিক গড়মিলের সত্যতা পাওয়া গেছে। অভিযুক্তকে সাময়িক অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই তদন্ত কাজ শুরু হবে। তদন্তে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে মেহেদি হাসানকে আটক রাখার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘তাঁকে আটক বা কোনো হয়রানি করা হচ্ছে না।’