সুন্দর-ই কাল হলো দীনার / রাকীবের অন্তরে ছিল লাম্পট্য
মোহাম্মদ মাসুদ, নাসিরনগর থেকে ফিরেঃ
সুন্দর সুশ্রী-ই কাল হলো কলেজ ছাত্রী দীনার। পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার দীনার চেহারা ছিল অত্যন্ত নিষ্পাপ ও লাবণ্যময়ী। রাকীবের মুখে ছিল প্রেম। অন্তরে লালন করতো লাম্পট্য। মাঝে মধ্যে দীনার পেছনে বাহিনী লেলিয়ে দিত রাকীব। প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে রাকীবের হুকুম না শুনলেই বিপদে পড়তো দীনা। লিটন দেব নাথের কোচিং সেন্টার থেকেই তাদের প্রেমের সূত্রপাত। লাজুক প্রকৃতির এ মেয়েটি ছিল চাপা স্বভাবের। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহন করা দীনা সবসময় মা বাবাকে নিয়ে ভাবতো। বখাটেদের গালমন্দ অত্যাচার নানা নির্যাতন নিরবে সইত। পরিবারকে টেনশনে ফেলতে চাইত না কখনো। ইভটিজারকে হাতে নাতে ধরেও ছেড়ে দেওয়ায় কলেজ কর্তৃপক্ষকে সন্দেহের চোখে দেখছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনার পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। কলেজ কর্তৃপক্ষের নেই কোন অনুভূতি ও কর্মসূচী। ঘটনাটি ক্যাম্পাসের বাইরে বলে সাফ উড়িয়ে দিচ্ছেন অধ্যক্ষ। সম্প্রতি সরজমিনে গেলে নাসিরনগরে কলেজ ছাত্রীর ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যার নেপথ্যে বেরিয়ে আসে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি ও দীনার পরিবার জানায়, দীনা কলেজকে সব সময় করে রেখেছে প্রাণবন্ত। সদা হাস্যজ্জোল এ মেয়েটি কলেজের শিক্ষার্থীদের চকলেট দিত। চকলেট দিত তার প্রভাষকদের। তার সবকিছুই আজ শুধু স্মৃতি। কলেজ মোড়ে সিএনজি ষ্ট্যান্ড সংলগ্ন শাফী মোল্লার একটি টিনের ঘর ভাড়া নেন লিটন দেব নাথ নামের এক লোক। তার বাড়ি দাঁতমন্ডল গ্রামে। তিনি গত তিন বছর ধরে এখানে কোচিং সেন্টার চালাচ্ছেন। শুরুতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়াতেন লিটন। পরে কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াতে শুরু করেন। সকাল ৭টা থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে কোচিং। এ কোচিং সেন্টারে পড়তো দীনা। এখান থেকেই দীনার সাথে রাকীবের পরিচয় ও প্রেমের সূত্রপাত। তাদের প্রেমে সহায়তা করতেন লিটন। দীনা প্রথমে প্রেমে সায় না দিলেও এক সময় রাকীবকে মন উজাড় করে ভালবেসে ফেলে। চতুর রাকীব কৌশলে দীনাকে ঘায়েল করে ফেলে। বিয়ের লোভ দেখায়। দীনাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। দীনার সাথে করে ডেটিং। দীনাকে বার বার কাছে পেতে চায় রাকীব। সুযোগে দীনার বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর ছবি ক্যামেরাবন্ধী করে রাকীব। এক পর্যায়ে রাকীব দীনাকে ব্লেকমেইলিং করার চেষ্টা করে। তখনই আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়ে সহজ সরল দীনার। বেপরোয়া হয়ে পড়ে রাকীব। ১০/১২জন বখাটে যুবকের সমন্বয়ে গড়া একটি বাহিনকে রাকীব প্রায়ই দীনার উপর লেলিয়ে দিত। তার বন্ধুদের মনজয় করার অফার দিত দীনাকে। এ ধরনের আবেদনে সাড়া না দেওয়ায় দীনার উপর ক্ষুদ্ধ হয় রাকীব। প্রত্যাখ্যান করে তিন বছরের প্রেম। অশ্লিল ভায়ায় গালমন্দ করে দীনাকে। গালি থেকে রেহাই পায়নি দীনার মা বাবাও। এ সব নিরবে নিভৃতে সহ্য করতো মেয়েটি। কিছু বিষয় মাকে জানালেও বাবাকে কিছুই জানায়নি দীনা। দিশেহারা হয়ে এক পর্যায়ে দীনা হয়ে পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বন্ধ হয়ে যায় তার খাওয়া ঘুম। গত ১৭ ফেব্র“য়ারী দীনা কলেজে বাংলা ক্লাশ করছিল। এ সময় রাকীব বাহিনীর কয়েকজন শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করে। দয়াল মল্লিক নামের এক বখাটে প্রভাষকের সামনেই দীনাকে অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়ে উড়নায় টান দেয়। দীনা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। আর অধ্যক্ষ বলেন কিছু না। সে পক্ষী দেইখ্যা ভয় পাইছে। প্রভাষকরা বখাটে দয়ালকে আটক করেন। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারনে দয়ালকে থানায় না দিয়ে ছেড়ে দেন। দুঃখে কষ্টে ১৯ ফেব্র“য়ারী দীনা আত্মহত্যা করেছে। কলেজ মোড়ের একাধিক সিএনজি চালক ও ব্যবসায়ী জানায়, লিটন দেব নাথ এখানে কোচিং-এর নামে মিনি পতিতালয় খুলে বসেছে। সে এখানে ভাই দিবস বোন দিবস পালনের নামে নানা অসামাজিক কাজ করে যাচ্ছে। এখানে ভালবাসার নামে যৌন খেলা হয়। অনেক সুন্দরী ছাত্রীকে লিটন কৌশলে ভোগ করে। ব্লেকমেইল করে। সে ছেলে মেয়েদের প্রেমের ঠিকাদারী করে। সারাদিন ঘরটির সামনের দরজা বন্ধ থাকে। ক্ষমতাসীন দলের অনেক ব্যক্তি লিটনের শেল্টার। তাই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে লোকজন ভয় পায়। তার কোচিং সেন্টারে দীনার সাথে রাকীবের অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে। লিটন সব জানত। লিটন দেব নাথ বলেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। দীনা আমার কাছে পড়তো। আমি কোন প্রভাষক বা শিক্ষক নয়। তারপরও অনেক শিক্ষার্থীকে পড়ায়। দীনার বাবা এ বি ছালেম বলেন, আমি বিষয়টি কয়েকবার রাকীবের মা বাবা ও চাচা মালেককে জানিয়েছি। তারা কোন ব্যবস্থা নেননি। ১৭ তারিখের ঘটনাটি আমি ইউএনও স্যারকে জানাতে বলেছিলাম। কিন্তু কলেজের কেউ আমলে নেননি। ওইদিন রাতে বাংলার প্রভাষক মোঃ জামিল ফোরকান ও রাষ্ট বিজ্ঞানের প্রভাষক মোঃ আমিনুল ইসলাম আমার বাসায় এসে বলে গেছেন, ধৈর্য্য ধরুন। আমরা বিষয়টি দেখছি। দীনার মা স্কুল শিক্ষিকা শাহানা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আমার মেয়েকে যে বখাটেরা আত্মহত্যার প্ররোচনা যুগিয়েছে আমি তাদের ফাঁসি চাই। নাসিরনগর কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ আলমগীর হোসেন বলেন, এটা কলেজের কোন বিষয় নয়। এটা তাদের পরিবারের বিষয়। মুছলেকা সাংবাদিককে দেওয়া যাবে না। বখাটে দয়ালকে থানায় না দিয়ে ছেড়ে দিলেন কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে নিরব থাকেন অধ্যক্ষ। তিনি বলেন, দীনার প্রতি আমাদের সহমর্মিতা আছে। ঘটনা যেহেতু কলেজ ক্যাম্পাসের বাহিরে তাই আমরা কোন কর্মসূচী দিব না। প্রসঙ্গতঃ গত ১৯ ফেব্র“য়ারী প্রেমিকের অত্যাচার নির্যাতন অশ্লিল গালমন্দ সইতে না পেরে নাসিরনগর আধুনিক প্রাইভেট হাসপাতালের পাঁচ তলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ে আত্মহত্যা করেছে কলেজ ছাত্রী দীনা। গত ২১ ফেব্র“য়ারী দীনার বাবা এ বি ছালেম বাদী হয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে বখাটে রাকীব সহ তিন জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ৪/৫ জনকে আসামী করে নাসিরনগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।