Main Menu

নাসিরনগরে বিদ্যালয়ের কক্ষে ৫ শিশুকে ধর্ষণচেষ্টা

+100%-

সকাল তখন পৌনে ৯টা। ঈদুল আজহা ও গ্রীষ্মকালীন টানা ২০ দিনের ছুটি শেষে বিদ্যালয়ে এসেছে তারা। দ্বিতীয় তলার তালা খোলা হয়নি। তাই নিচতলার ফ্লাড সেন্টারে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। সংখ্যায় তারা পাঁচ। এ সময় স্থানীয় দুই কিশোর জোর করে দ্বিতীয় তলায় তুলে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়।

বুধবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার টেকানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘটে এ ঘটনা। সৌভাগ্যক্রমে তখনই ঘটনাস্থলে আসেন বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সালমা আক্তার। তাঁর উপস্থিতি টের পেয়ে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।

সালমা আক্তারের বর্ণনামতে, তিনি বিদ্যালয়ে এসেই দেখতে পান বিদ্যালয়ের নিচতলায় গেইটের নিচ দিয়ে ফাঁকা ও কিছুটা ভাঙা। তালা খুলে ওপরতলায় যেতেই শিশুদের শব্দ শুনতে পান। শিশু শ্রেণির কক্ষের দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢোকেন। সেখানে দেখেন, পাঁচ শিশুর মধ্যে তিনজন বিবস্ত্র অবস্থায় কাঁদছে। তাদের কাছেই ধর্ষণচেষ্টার কথা জানতে পারেন।

ওই শিশুরা জানায়, তারা গল্প করছিল। হঠাৎ দুই কিশোর এসে তাদের জাম্বুরা খেতে বলে। তারা না খেতে চাইলে বিদ্যালয়ের ওপরতলায় যেতে বলে। কিন্তু তারা যেতে না চাইলে টানাহ্যাঁচড়া করে ওপরতলায় তোলে দুর্বৃত্তরা। এক শিশু চিৎকার করলে তার মুখ চেপে ধরে এক কিশোর। শিশু শ্রেণির কক্ষে তাদের নিয়ে বিবস্ত্র করে।

ভুক্তভোগী এক শিশু জানায়, ‘দুইডা পোলা আমরারে থাপরাইছে। এর পর আমরারে ডর দেখাইয়া কাপড় খোলতে কইছে। মেডাম (শিক্ষক সালমা আক্তার) আওনের শব্দ হুইন্যা এরা পলাইয়া গেছেগা।’

বিদ্যালয়টি পড়েছে নাসিরনগর সদর ইউনিয়নে। শিশুদের বর্ণনায় হামলাকারী একজনের পরিচয় জানা গেছে। সে টেকানগর উত্তরপাড়ার বাসিন্দা, পড়ে নাসিরনগর আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তার সহযোগীর নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

সহকারী শিক্ষক সালমা আক্তার বলেন, স্কুলে ঢুকে যা দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। শিক্ষার্থীদের চোখের জল, আর এ ভয়ংকর দৃশ্য আমার চাকরি জীবনের সবচেয়ে খারাপ ঘটনার একটি।

এ ঘটনার পর বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে চরম উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, কিছুদিন পরপর এই বিদ্যালয়ে নানা দুর্ঘটনার কথা শোনা যায়। কিন্তু বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির লোকজন কোনো পদক্ষেপ নেয় না। কিছুদিন আগেও এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়। নাসিরনগর থানায় মামলাও হয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি।

এলাকাবাসী জানান, বিদ্যালয়ের আঙিনায় স্থানীয় বখাটে কিশোর-তরুণরা প্রায়ই জুয়ার আড্ডা ও মাদকের আসর বসায়। এসব বন্ধ না হলে এমন ঘটনা আরও ঘটতেই থাকবে।

এসব বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় সরেজমিন। বিদ্যালয়ের চারপাশেই পানি জমে আছে। হাঁটুপানি মাড়িয়ে যেতে হয় সেখানে। নিচতলায় বেশ কয়েকজন যুবককে লুডু খেলতে দেখা যায়। বিদ্যালয় চলাকালে আড্ডা জমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তারা দ্রুত সটকে পড়ে।

পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী জানায়, গ্রামের কয়েকটি ছেলে তাকে আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করে। সে শিক্ষকের কাছে বিচার দিয়েছে। এখন বাড়িতে গিয়েও যন্ত্রণা দেয়। তার ভাষ্য, ‘মাই (মা) কইছে, আমার পড়ালেহা বন্ধ কইরা দিব। কিন্তু আমি পড়ালেহা করতাম চাই।’

প্রধান শিক্ষক রৌশন আরা বেগম বলেন, ‘আজ যে ঘটনা ঘটেছে এতে আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চরমভাবে আতঙ্কিত। আমরা ভয়ে আছি।’

নিচতলায় সকাল-বিকেল-রাতে জুয়া ও মদের আড্ডা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। কোনো অভিযোগের কথা ঊর্ধ্বতন
কর্তৃপক্ষ শুনতে চায় না। বহুবার বহু ঘটনা জানিয়ে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টো আমাকে ম্যানেজ করে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়।’ প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

বিদ্যালয়ে ‘টুকটাক সমস্যা’র কথা স্বীকার করেন পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. জসিম। তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভা হলে এসব বিষয়ে কথাও হয়। কিন্তু আজকের ঘটনাটি খুবই জঘন্য। প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’

নাসিরনগর সদর ইউপি চেয়ারম্যান পুতুল রানী বিষয়টি জানতে পারেন স্থানীয় এক ইউপি সদস্যের মাধ্যমে। তিনি মাদক ও জুয়ার বিষয়ে মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভায় আলোচনার আশ্বাস দেন। পুতুল রানী মনে করেন, শিক্ষার্থী-শিক্ষকের বিদ্যালয় যাত্রা নিরাপদ করতে ইউএনও ও প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

সংবাদকর্মীদের কাছে শুনে ঘটনাস্থলে যান নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোহাগ রানা। তিনি বলেন, ‘তদন্ত করেছি। ঘটনার সত্যতাও মিলেছে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে-ও আরেকটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।’

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ইকবাল মিয়ার ভাষ্য, প্রধান শিক্ষক তাঁকে কল দিয়েছিলেন। ধরতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন। ইউএনও মোহাম্মদ ইমরানুল হক ভূঁইয়ার চোখে এটি খুবই ভয়াবহ ঘটনা। তিনি বলেন, স্কুলের ভেতর এমন ঘটনা কল্পনাই করা যায় না। তদন্তের পর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

স্থানীয় শিশু বিশেষজ্ঞ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আজকের ঘটনাটি সমাজের জন্য খুবই ভয়ংকর। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে মা, শিশু ও কিশোরদের নিয়ে নিয়মিত মা সমাবেশ করতে হবে। কৈশোরকালীন বিষয়ে জানতে হবে ও তাদের জানাতে হবে।’ অন্যথায় ভুক্তভোগী শিশুরা মানসিকভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হবে বলে মনে করেন তিনি। এই বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, তাদের স্বাভাবিক চলাফেরা ও লেখাপড়া বিঘ্নিত হতে পারে– এমন বিষয়ে অভিভাবককে সচেতন থাকার পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। ছেলেমেয়েরা যেন সামাজিকভাবে বুলিংয়ের শিকার না হয় সে বিষয়েও নজর রাখার পরামর্শ দেন তিনি।






Shares