নাছিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা
জজ মিয়া নাটকের পূনরাবৃত্তি ঘটবে না- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
এস.এম.বদিউল আশরাফ:: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দিরে ও বাড়িতে হামলাকারীরা যেই হোক তাদের ছাড় দেয়া হবেনা বলে আশ্বস্ত করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি বলেন,আমরা জজ মিয়ার নাটক তৈরি করি না। আমরা যাদের ধরি তথ্য ও প্রমান সহ ধরি। তবে উপযুক্ত প্রমান সহ তাদের ধরতে একটু সময় লাগবে।
আইজিপি শহিদুল হক এই হামলার ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, প্রশাসন আহলে সুন্নত ও হেফাজতকে সমাবেশের অনুমতি না দিলেও পারতো।
ঘটনার নয় দিন পর মঙ্গলবার নাসিরনগর উপজেলা সদরের আশুতোষ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের খেলার মাঠে আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
সর্বদলীয় সুধী সমাবেশ নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ এ সমাবেশের আয়োজন করে। বেলা একটা থেকে পৌনে চারটা পর্যন্ত এ সমাবেশ চলে।
এতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা বসে বসে জজ মিয়ার নাটক তৈরি করছি না। হামলাকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। যারা ধর্মের নামে এ কাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের শাস্তি পেতে হবে। এর বিকল্প নেই। কোনো ধর্ম মানুষ হত্যা, হামলা, লুটপাটের কথা বলে না। তাহলে কেন রামুর মতো ঘটনা ঘটছে?’
তিনি বলেন, রামুর বিষয়ে সবাই দেখেছে। কাবা শরিফের ছবি বিকৃত করা হয়েছে। ব্লগারদের কুরুচিপূর্ণ লেখা ফেসবুকে পোস্ট করা দেখেছে লোকজন। ৯১ দিনের অগ্নিকাণ্ড, বিদেশিদের হত্যা, বিভিন্ন ধর্মের গুরুদের হত্যা করে একটি গোষ্ঠী অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তখন তারা ব্যর্থ হয়েছি। এরপর তারা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায়। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী দেশের আপামর জনতাকে ঘুরে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছিলেন। ওই গোষ্ঠী সেসব ঘটনা থেকে ব্যর্থ হয়ে নতুন হামলা শুরু করেছে।
তিনি মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হককে সৎ ও দক্ষ হিসেবে অবহিত করে বলেন, তার সততার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যারা এটা করেছে, ‘তারা মনে করে, তারাই বিজ্ঞ, আমরা কিছু জানি না। আমাদের প্রশাসন আছে। কারা ঘটিয়েছে, আমরা চিনতে পেরেছি। হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু সবকিছুই বেরিয়ে আসবে। আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট। কারও ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর কেউ যেন আঘাত না আনে। যদি কেউ আঘাত হানে, তাদের আইসিটি আইনের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
সুধী সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের (নাসিরনগর) সংসদ সদস্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার। সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক, অতিরিক্ত আইজি (এসবি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী ধ্রুবেশানন্দজী মহারাজ, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি জয়ন্ত সেন, খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও, বাংলাদেশ ইসকনের উপদেষ্টা কৃষ্ণকীর্তন দাস ব্রহ্মচারী, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সাজেদুর রহমান।
সভাপতির বক্তব্যে ছায়েদুল হক হামলার নেপথ্য ব্যক্তিদেরও খুঁজে বের করতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, গত ৩০ অক্টোবর রোববার হামলার দিন হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলা থেকে ১৪টি ট্রাকে কারা লোক এনেছিল, বিষয়টি খুঁজে বের করুন। কারা এর খরচ দিয়েছে সেটাও খুঁজে বের করুন। তিনি বলেন, ‘তিনটি কারণে আমার উপজেলায় হামলা চালানো হয়েছে। দুষ্কৃতকারীরা চায়, আমি যেন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই, রাজনীতি থেকে সরে যাই, আমি যেন মরে যাই। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি কখনো এ আসন থেকে পাস করেনি। আল্লাহ সহায় থাকলে রাজনীতির মাঠে থাকব।’
আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ভিডিও চিত্র, তথ্য ও অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এ পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দ্রুত তদন্তকাজ শেষ করে আদালতে সাক্ষীদের হাজির করা হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে যে তথ্য এসেছে, তা থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, নাসিরনগরে হামলায় টুপি পরা, দাড়িওয়ালা, মাদ্রাসার ছাত্ররা জড়িত ছিল না।
হামলার দিন সমাবেশের আয়োজন করা আহলে সুন্নত ওয়াআল জমাতকে উদ্দেশ করে আইজিপি বলেন, ‘আপনারা সমাবেশের আয়োজন করেছেন। নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। এখন এর দায়িত্ব নিতে হবে।’
তিনি হামলার জন্য প্রশাসনের গাফিলতিকে দায়ী করে বলেন, ওই দিন প্রশাসন ওই সমাবেশের অনুমতি না দিলেও পারত। এ দেশে ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম। যেখানে মুসলিমদের সংখ্যা এত বেশি, সেখানে একজন হিন্দু লোক মুসলিম ধর্মকে অবমাননা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিকৃত ছবি পোস্ট করবে—এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ জড়িত ব্যক্তিদের নিশ্চিহ্ন করা হবে উল্লেখ করে বলেন, ‘বিষবাষ্পের খেলা আর দেখতে চাই না। আগেও দুষ্কৃতকারীদের আমরা ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি খুঁড়ে বের করে ধ্বংস করেছি। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদেরও খুঁজে বের করব। বিচারের মুখোমুখি করব। আমরা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেব। দেশের প্রশ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যেন এ ধরনের হামলা করতে এসে কেউ ফিরে যেতে না পারে।’
হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার জন্য সমাবেশে ক্ষমা চান চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘হামলার জন্য কারা ট্রাক ভাড়া করে দিয়েছে। কারা ছবি পোস্ট করেছে। কারা ছবি প্রিন্ট করেছে। তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত আপনারা যত বড় রাজনীতিবিদ হোন না কেন, আমাদের জালে আটকা পড়লে, তদন্তে ধরা পড়লে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তবে ওই দিন নিরাপত্তা দিতে না পারায় আমি সবার কাছে ক্ষমা চাইছি। দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে ওই দিন সমাবেশের পর সেখানে নিরাপত্তা দিতে পারিনি।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার বলেন, পার্শ্ববর্তী উপজেলা মাধবপুর থানার বিএনপি জামাতের লোকেরা ট্রাকে করে এসে নাসিরনগরে হিন্দুদের মন্দিরে ও বাড়ি ঘরে হামলা ও ভাংচুর করেছে। নাসিরনগর বিএনপি নেতা হান্নান এ ধ্বংসযজ্ঞের নেতৃত্ব দেন।
প্রসঙ্গত, ফেসবুকের একটি ছবিকে কেন্দ্র করে গত ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরের ১৫টি মন্দির ও হিন্দুদের শতাধিক বাড়িঘরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এর চার দিন পর বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফায় আবার হামলা হয়। পরিস্থিতি সামালে ব্যর্থতার দায়ে প্রথমে নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদেরকে এবং পরে ইউএনও চৌধুরী মোয়াজ্জাম আহমদকে প্রত্যাহার করা হয়।